রবিবার ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


প্রেক্ষাগৃহ: উত্তরা, পূরবী ও উজ্জ্বলা

১৯৫১ সাল অরুণ তথা উত্তম-র জীবনটাকে যেন তছনছ করে দিয়ে গেল। বাড়িতে গৌতম হাঁটি হাঁটি পা পা করে চারিদিক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, অন্য-দিকে অনন্ত চোরাবালির মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে তাঁর শিল্পী সত্তা। একই বছরে পরপর দুটি ছবি সুপার ফ্লপ কোনও মানুষের চেতনার জগৎকে কতটা আর সজীব রাখে!
সাংবাদিক হিসাবে পরবর্তীকালে খ্যা তিমান পশুপতি চট্টোপাধ্যায় কেরিয়ারের প্রথম দিকে চিত্র পরিচালক ছিলেন। তিনি ১৮ বছরের ফিল্মি কেরিয়ারে মোট ১১টি ছবি পরিচালনা করেছিলেন। তিনিই ব্য র্থ নায়ক উত্তম কুমারকে সুযোগ দিলেন।

ছবির নাম ‘নষ্ট নীড়’।

প্রযোজনায় এমপি প্রোডাকশন।
প্রোডাকশন হাউসের তত্ত্বাবধানে একঝাঁক গুণী ব্যমক্তিদের সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন পরিচালক মশাই। কাহিনীকার শশিশেখর শর্মা, গীতিকার শৈলেন রায়, সুর সংযোজনায় রবীন চট্টোপাধ্যায়, সম্পাদনায় কমল গাঙ্গুলী, শব্দযন্ত্রী সুনীল ঘোষ। এ বলে আমায় দেখ তো ও বলে আমায়। চিত্রনাট্য-র দায়িত্ব নিজেই পালন করলেন পশুপতিবাবু।
শরৎকাহিনীর ভালো চিত্রনির্মাতা রূপে যাঁদের খ্যােতি সেসময় মুখে মুখে ঘুরত পশুপতিবাবু তাঁদের মধ্যেয় অন্যলতম ছিলেন। ‘নষ্টনীড়’ নির্মাণের সময় ভারতীয় ছবির ক্ষেত্রে নতুন এক আইন প্রবর্তিত হল। ছবির স্বার্থে এ আইন প্রয়োজন ছিল। ১৯৫১ সালের ১৫ জানুয়ারি বোম্বেতে ‘কেন্দ্রীয় ফিল্ম সেন্সার বোর্ড’ তৈরি হল। ছবিতে নায়িকা হিসাবে মনোনয়ন পেলেন সুনন্দা দেবী। এখান থেকেই গোলমালের সূত্রপাত হল। গোলমাল মানে ইগোর লড়াই বা অন্যো কোনও আকচা আকচি নয়।
ক্যা মেরাকে আপন করে নেওয়ার যে দক্ষতা উত্তম, বাবা সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে মেট্রো সিনেমাতে বসে হলিউড মুভি থেকে আয়ত্ব করেছে সেগুলো প্রয়োগ করতে গেলেই কোথায় যেন সুনন্দা দেবী অচেনা হয়ে যাচ্ছেন।

বাংলা সিনেমার শৈশব অবস্থার টিপিক্যাইল ম্যাননারিজমসর্বস্ব থেকে নায়িকাকে কোনওমতে মুক্ত করা যাচ্ছে না।সেসময় সুনন্দা দেবীর যা স্টারডম উত্তম তো নয়ই পরিচালক পর্যন্ত কিছু বলার সাহস পাচ্ছেন না। ছবির কাহিনীতে যে সাধারণ টানাপোড়েনের বাঁধাছক ব্যটবহৃত হতো এ বারেও তার ব্যহতিক্রম হল না। নাগরিক জীবনের আটপৌরে ব্যা পারকে সাহিত্য্গুণ অপেক্ষা সেলুলয়েডি মাস্তানি দেখাতেই পরিচালক মশাই বেশি যত্নবান ছিলেন। ফলও পাওয়া গেল হাতেনাতে।
পরবর্তীকালে উত্তম যখন সম্রাটের আসনে তখন এর থেকেও অনেক নিম্নমানের ছবিতে শুধু উত্তম ম্যাষজিক দিয়ে ছবি হিট হয়ে গিয়েছে। কারণ উত্তমও তখন বুঝে গিয়েছেন দর্শক শ্রোতারা কোন যাদুতে বশ হন। ছবিটিতে বাকি কলাকুশলীদের কারও ছবি হিট হবার ওপর দায়বদ্ধতা ছিল না। সুনন্দা দেবীর নাম প্রচারপত্রে যত ফলাও করে ছাপা হল ছবির লম্বা দৌড়ে ততই পিছিয়ে যেতে থাকল। নির্মাতারা উত্তম কুমার নামক একজন নতুন নায়ককে দর্শকসমাজে উপহার দিতে চাইছেন কিন্তু ম্যাুনেজমেন্ট নামক বিষয়টাকে তারা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গিয়েছেন।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪: কবে আসবে তুমি মননের সে ‘সহযাত্রী’? [০৯/০৩/১৯৫১]

সোনার বাংলার চিঠি, পর্ব-১: প্রায় ৭০ একর পাহাড়ী বনভূমির মন্দিরে মহালয়াতেই দেবীপক্ষের সূচনা হয়

প্যারিস, ইউট্রেকট, আমস্টারডাম হয়ে ব্রাসেলস—স্বপ্নের ভ্রমণ ডেসটিনেশন/১

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৭: রান্নাবান্নার ঠাকুরবাড়ি

সুনন্দাদেবীর একক অভিনয়সমৃদ্ধ ছবি ‘নষ্ট নীড়’ কখনওই নয়, তবুও তাঁর কাঁধে ভর দিয়ে ব্যমবসায়িক সাফল্যে আনার ভুল পথে নির্মাতারা পা বাড়ালেন। বেচারা উত্তম কুমার একা ফিল্ম অ্যা্ক্টিং করে গড়াগড়ি খাচ্ছেন। আর কয়েক বছরের মধ্যেতই ছবি হিট করানোর মশলা হিসাবে যখন উত্তম-সুচিত্রার মাখো মাখো প্রেমকথা, খবরের কাগজের প্রথম পাতায় বিকিয়ে বেড়াচ্ছে তখন নিজের সংসারে আগুন লাগবে জেনেও উত্তম নিজেকে প্রমাণ করার মরিয়া চেষ্টা করে গিয়েছেন।
যে ম্যােনেজমেন্টের পাখায় ভর দিয়ে দর্শকদের সিটের সঙ্গে বাঁধা যায় এমপি কর্তৃপক্ষ তা কখনও ভেবে দেখবেন কেন নেহাত একজন নবাগতের জন্যর। প্রতিবেদকের বলার উদ্দেশ্য হল, পরপর ফ্লপ খাওয়া অভিনেতা তথা নায়ককে হিট করানোর কোনও বিশেষ ব্য্বস্থা নির্মাতাদের তরফ থেকে ছিল না। আরও একটা ব্যবতিক্রমী দিক সর্বত্র অনালোচিত থাকে তা হল ১৯৫৫ সাল থেকে উত্তমের সমস্ত ছবিতে উপরি পাওনা হিসাবে নায়কের মুখের স্বর্গীয় হাসি।

এ হাসি উত্তম প্রথম দিকের ছবিগুলোতে মেশাতে পারেননি। একটা ছবিতে দর্শক নতুন কি পাবেন যে হল ভর্তি করে রাখবেন সে বিশ্লেষণী মনোভাব শিল্পসৃষ্টির আদিতে না থাকলে সাফল্য অধরাই থেকে যায়। হিট হবার পর উত্তমের প্রত্যেবক ছবির যদি ফ্রেম টু ফ্রেম আলোচনা করা যায় সেখানে একটা বিষয় সন্তর্পনে লক্ষ্য করা যাবে, উত্তম যখনই স্ক্রিনে আসছেন তখনই দর্শকদের নতুন কিছু উপহার দিচ্ছেন যা তাঁরা ভেবে আসেননি।
রিপিটেশনের কোনও জায়গা রাখতেন না। আমৃত্যু এই একটা চেষ্টা উত্তমকে কালজয়ী করে রাখল। ‘সহযাত্রী’-তে কাজের সময় পরিচালক বিভূতি লাহা সবার আগে উত্তমের এ বিষয়টা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই উনি ‘অগ্নিপরীক্ষা’-র সময় ফ্লপ হওয়া নায়ককে নিয়ে বাজি ধরেছিলেন।

আর নিজের জরিপকে সফল করার জন্যক চিত্রনাট্য, গীতরচনা, সম্পাদনা, আবহ সংগীত ক্যারমেরার অ্যাতঙ্গেল সমস্ত দিকের ট্রিটমেন্টে চরম সজাগ ছিলেন। ‘অগ্নিপরীক্ষা’ যত না উত্তম-সুচিত্রার জন্যগ তার চেয়েও বেশি পূর্ণাঙ্গ স্বয়ংসম্পূর্ন ছবি। যে অনুকূল পরিস্থিতিতে নতুন নায়ক-নায়িকার কাজ করতে সুবিধা হয়েছিল।
এ ব্যাবস্থাটাই ‘নষ্ট নীড়’ ছবির কর্তৃপক্ষ বুঝে উঠতে পারেননি বলে মনে হয়।
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content