রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


বলবন্তরায় কল্যাণজি পারেখ।

থ্রি ইডিয়ট ছবির র‍্যাঞ্চোকে নিশ্চয়ই মনে আছে সবার। ছবিতে তাঁর আত্মবিশ্বাস ছিল প্রশ্নাতীত। অনেক সময় আমরা তাঁকে ছোটদের কাছে আদর্শ মানুষ হিসেবে প্রতিপন্ন করে থাকি। তাকে দেখে ছোটরা যাতে উদ্বুদ্ধ হয় তার প্রেরণা দিই। কিন্তু এই একই সিনেমায় ফারহানকে আমাদের মনে আছে কি! যখন মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি ছেলে তার বাবা-মায়ের আশা-ভরসা সবকিছুকে পিছনে ফেলে তার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করবার জন্য বাবার কাছে আকুল আবেদন করে। সে বাবা-মায়ের প্রত্যাশা মতো ইঞ্জিনিয়ার হতে চায় না। হতে চায় একজন আর্টিস্ট। তাতে তার জীবন যে ছন্দেই চলুক না কেন, এতে তার বিশেষ কোনো আক্ষেপ থাকবে না।

থ্রি ইডিয়টস-এর এই চরিত্রটি কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে দেখতে তেমন কিছু না হলেও এক কথায় অসাধারণ। কারণ, অনেক ছেলেমেয়ের ছোট থেকে মনের কোণে লালন করা স্বপ্নের বীজ এক পলকে তুলে নিয়ে এসেছে আমাদের সামনে। আর এরই বাস্তবায়িত রূপ আমরা দেখি আমাদের কাছে যিনি পরিচিত ‘ফেভিকল ম্যান’ হিসাবে। তার জীবনের কাহিনির সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায় থ্রি ইডিয়টস-এর ফারহান চরিত্রটির সঙ্গে।

আমরা প্রায়শই বলে থাকি—এ যে সে জোড় নয় হে, এ হল ‘ফেভিকলেরই জোড়’। টিভিতে অনেক বিজ্ঞাপনে মানুষের মনের মণিকোঠায় চিরকালের মতো জায়গা করে নেয় তাদের মধ্যে অন্যতম একটি। একজন মধ্যবয়স্ক লোক দীর্ঘক্ষণ ধরে নদীতে ছিপ ফেলে রাখা সত্ত্বেও তিনি একটিও মাছ ধরতে পারছেন না। তাই তিনি কার্যত ব্যাজার মুখ করে বসে আছেন। অন্য একটি দৃশ্যে দেখানো হচ্ছে যে, আর একজন ব্যক্তি এলেন, তাঁর ছিপে তিন ফোঁটা ফেভিকল লাগিয়ে জলে ডোবালেন, আর পটাপট তিনটে মাছ উঠে এল! যা দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন মাঝবয়সী ওই লোকটি। নেপথ্যে শোনা যাচ্ছে— ‘ইস জোড় কা কোহি তোড় নেহি’।
কিন্তু আমাদের হয়ত অনেকেরই জানা নেই, এক সময়ের মানুষের মুখে অতি প্রচলিত ‘ইস জোড় কা কোহি তোড় নেহি’ এই ফেভিকল-এর প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন? হ্যাঁ, এই অতি পরিচিত ফেভিকলের প্রতিষ্ঠাতা বলবন্তরায় কল্যাণজি পারেখ। ১৯২৫ সালে গুজরাতের ভাবনগর জেলার মাহুভা শহরে এক জৈন পরিবারে তাঁর জন্ম। যদিও ‘ভারতের ফেভিকল ম্যান’ বলেই তিনি বেশি জনপ্রিয়। জীবনে যতই দুঃসময় আসুক না কেন, নিজের কাজে যারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকে, অবশেষে তারাই সফল হন। বলবন্ত পারেকের জীবন এই নীতিবাক্যেরই চূড়ান্ত উদাহরণ।

এ প্রসঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি কবিতা মনে পড়ে—‘কেউ কথা রাখেনি…’। কিন্তু না, কথা দিয়ে কথা রাখার মানুষ ছিলেন এই বলবন্ত। আর তা তিনি নিজের জীবন দিয়ে দেখিয়ে গিয়েছেন।

ছোট বেলার পড়াশোনার পাঠ তিনি মাহুভা থেকে নিলেও বড় হয়ে আইনের পাঠ শেষ করেন মুম্বইয়ের সরকারী ল’ কলেজ থেকে। ছোট থেকেই ব্যবসার প্রতি তাঁর খুব আগ্রহ ছিল। কিন্তু বলবন্তের ঠাকুরদা ছিলেন সেই সময়কার প্রখ্যাত আইনজ্ঞ। বড় হয়ে তিনি যেন ঠাকুরদার মতো নাম করতে পারেন, এই আশায় স্কুলের গণ্ডি পেরোতেই বলবন্তের বাবা-মা তাঁকে মুম্বইয়ের একটি সরকারি কলেজে আইন নিয়ে পড়াশোনা করতে পাঠিয়ে দেন। পড়াশোনা চলাকালীন কান্তাবেন নামে এক মহিলাকে বিয়েও করেন তিনি। কিন্তু মুম্বই শহরে কিছুতেই তাঁর মন টিকচ্ছিল না। সেটা ছিল ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময়। এই সময় অন্যান্য যুবকদের মতই গান্ধীজির অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে পড়াশোনা ছেড়ে আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। অবশ্য একবছর পরে ফের ফিরে এসে পড়াশোনা শেষ করেন।
আরও পড়ুন:

অজানার সন্ধানে: মুছে যাক গ্লানি মুছে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা…

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-৫: বলবয় থেকে বিশ্বসেরা

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১৮: গৃহ-সহায়িকার পাঁচালি এবং আমাদের ভদ্র সমাজ

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৩: হৃদয়পুরের লক্ষ্যপূরণ ‘কঙ্কাবতীর ঘাট’

অবশেষে আইন নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে ডিগ্রি লাভ করেন বলবন্ত। কিন্তু দিনের পর দিন কালো কোট গায়ে চাপিয়ে এই একঘেয়ে ওকালতি করতে ভালো লাগত না তাঁর। তাই তিনি বাড়ির অমতে গিয়ে চাকরি ছেড়ে কান্তাবেনকে নিয়ে ঘর ছাড়েন। বেকার অবস্থায় কী খাবেন, কোথায় থাকবেন কিছুই নিশ্চিত ছিল না বলবন্তের। একপ্রকার অনিশ্চিত জীবনকে সামনে রেখে মুম্বইয়ে এক বন্ধুর মাধ্যমে একটি গুদামঘরে স্ত্রী-সহ আশ্রয় নেন তিনি। তার পর অনেক চাকরি খোঁজার পর এক কাঠের ব্যবসায়ীর অধীনে সামান্য টাকার মাইনেতে পিওনের চাকরিতে ঢোকেন। কখনও প্রিন্টিং প্রেস, কখন বা কাঠের কারখানাতেও চাপরাশি হিসেবেও কাজ করেছেন বলবন্ত। যদিও খুব বেশিদিন এসব কাজ তাঁর মন টেঁকেনি। এইসময় কারখানার গুদামে কার্যত চরম দারিদ্র্যের মধ্যে জীবন কাটছিল আগামী দিনের ফেভিকল ম্যানের।
ততদিনে মনে মনে একাই ব্যবসা শুরু করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন বলবন্ত। পিওনের কাজে থাকাকালীন নানা জায়গায় নিজে থেকেই যোগাযোগ বাড়াতে শুরু করলেন। আমদানি-রপ্তানি কী ভাবে করতে হয়, তাও একাই নিজের আগ্রহে শিখতে লাগলেন। এই কাজের জন্য তিনি জার্মানিতেও গিয়েছিলেন। ব্যবসা করতে গেলে নিজেকে কী ভাবে তৈরি করতে হয়, তা খুব সহজেই আয়ত্ত করে ফেলেন। একে একে দেশ-বিদেশের নামকরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে থাকেন ফেভিকল ম্যান।

এরপর বিদেশ থেকে পেপার-ডাই আমদানি করে ব্যবসায়ীদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেবার কাজ শুরু করলেন। ক্রমে এই ব্যবসা লাভের মুখ দেখার কয়েক মাসের মধ্যেই মুম্বইয়ে একটি ফ্ল্যাট কিনে স্ত্রী, পুত্র এবং ভাইয়ের সঙ্গে সেখানেই থাকতে শুরু করলেন। তাঁর দুই পুত্র, মধুকর পারেখ ও অজয় পারেখ এবং এক কন্যা কল্পনা পারেখ। এই সময় কর্মসূত্রে একটি জার্মান সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলেন বলবন্ত।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১৩: আচমকা রাতের পার্টিতে হাজির পুলিশ

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫৪: মাছের বাজারের দুনিয়ায় আলিপুরের ‘নেট বাজার’ তালিকায় শীর্ষে

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৮: শুঁটকি মাছে কি আদৌ কোনও পুষ্টিগুণ আছে?

কিন্তু তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন যে তিনি কখনই আর কারও অধীনে থেকে ব্যবসা করবেন না। তাই তিনি ১৯৫৪ সালে ভাই সুশীলের সঙ্গে মুম্বইয়ের জেকব সার্কেলে ‘পারেখ ডাইকেম ইন্ডাস্ট্রিজ’ নামে নিজের সংস্থা খুলে ফেলেন। ‘পারেখ ডাইকেম ইন্ডাস্ট্রিজ’ মূলত কাপড় রং করার জিনিসপত্র তৈরি করত।

একদিন হঠাৎই তিনি যখন কাঠের গুদামে কাজ করছিলেন তখন খেয়াল করেন কাঠের সঙ্গে কাঠ জোড়া লাগাতে ব্যবহার করা হচ্ছে পশুর চর্বি। তার দুর্গন্ধ ভয়ানক। শুধু তাই নয় পশুর এই চর্বি ব্যবহার করতেও বেশ বেগ পেতে হতো কর্মীদের। তখন চিন্তা করলেন, তিনি কি কোনও সুগন্ধি আঠা তৈরি করতে পারেন না, যা আগামী দিনে সবাই ব্যবহার করতে পারবে? সেই সূত্র ধরেই ভাই সুনীল পারেককে নিয়ে শুরু করলেন পড়াশোনা। তৈরি করে ফেললেন উদ্ভিদজাত সিন্থেটিক আঠা ফেভিকল৷ আজ এত বছর পরেও যা ভারতীয়দের কাছে অতিপরিচিত একটি নাম।

১৯৫৯ সালে পিডিলাইট সংস্থার জন্ম দিলেন। একটি ছোট দোকানে আঠা বিক্রি করা শুরু করেন বলবন্ত। সেই আঠার মান এত ভালো ছিল যে তখনকার কাঠমিস্ত্রিরা শুধু ‘ফেভিকল’ ব্যবহার করে কাজ করতেন। ভারতের বাজারে একচেটিয়া ব্যবসা শুরু করল ফেভিকল। তার পর ধীরে ধীরে পিডিলাইট সংস্থা ‘ফেভি কুইক’, ‘এম সিল’ নামের আরও দু’টি পণ্য তৈরি করা শুরু করে।
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৮: কোষার ভান্ডার ছররি থেকে কুঠাঘাট হয়ে কুরদার

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬১: চাষাবাদ নিয়েও রবীন্দ্রনাথ ভেবেছেন

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৩: যার কাছে টাকা-পয়সা থাকে এ জগতে সেই হল পণ্ডিত

বলবন্তের ছোট ভাই নরেন্দ্র পারেখও যুক্তরাষ্ট্র থেকে পড়াশোনা শেষ করে ব্যবসায় যোগ দেন। পরে ১৯৫৯ সালে কোম্পানিটির নাম পরিবর্তন করে পিডিলাইট ইন্ডাস্ট্রিজ রাখা হয়। ২০০৬ সালের মধ্যে পিডিলাইট সংস্থা ভারত ছাড়াও তাইল্যান্ড, আমেরিকা, দুবাই, মিশর এবং বাংলাদেশে নিজেদের কারখানা গড়ে তোলে। সিঙ্গাপুরে একটি গবেষণা কেন্দ্র গড়ে ওঠে। আজও একচেটিয়া ব্যবসা করে চলেছে পিডিলাইট। এখন ২০০-র বেশি পণ্য উৎপাদন করছে এরা। পিডিলাইট-এর ফেভিকলের জোড় এতটাই মজবুত যে তাই মানুষ এখনও ভুলতে পারেনি। ফেভিকল ছাড়াও ডক্টর ফিক্স-ইট, ফেভিকুইক-সহ একাধিক প্রোডাক্ট তৈরি করেছে পিডিলাইট। এই কারণে ফোর্বসের এশিয়ার সেরা ধনীদের তালিকায় স্থান করে নেয় পারেকের কোম্পানি।

শুধু ব্যবসায় সফলতা অর্জনই নয়, বলবন্ত সমাজসেবার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। গুজরাতের সাহিত্য পরিষদ-সহ ভাবনগরের ‘সায়েন্স সিটি’ প্রকল্পেও প্রচুর অর্থ দান করেছেন তিনি। একাধিক হাসপাতাল, স্কুল তো বটেই, ছাত্র-ছাত্রীরা যাতে গুজরাতের ঐতিহ্য সম্পর্কে শিক্ষা নিতে পারে তার জন্য দর্শন ফাউন্ডেশন নামে একটি বেসরকারি এনজিও গড়ে তুলেছেন তিনি। অবশেষে এই হার না মানা যোদ্ধা ৮৮ বছর বয়সে ২০১৩ সালে প্রয়াত হন।
* অজানার সন্ধানে (Unknown story): ড. সঞ্চিতা কুণ্ডু (Sanchita Kundu) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, হুগলি মহসিন কলেজ।

Skip to content