শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


আজ দোলযাত্রা, রঙের উৎসব৷ সনাতন হিন্দুদেরও অন্যতম আনন্দের দিন। এই উৎসবে জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষ আনন্দে মেতে ওঠেন। ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে অনুষ্ঠিত এই দিনে সাধারণ মানুষ খুশিতে আত্মহারা হয়ে রং আবিরে একে অপরকে ভরিয়ে তোলেন। এ যেন এক রাঙিয়ে দেওয়ার দিন। তাই তো কবির ভাষায়—’রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো এবার…।’

দোলযাত্রার সময় শুধু মানুষের মনেই নয়, প্রকৃতিও যেন অপরূপ সাজে নিজেকে সুসজ্জিত করে তোলে। তার ডালে ডালে, শাখে শাখে যেন হিল্লোল জেগে ওঠে। শীতের নিদারুণ শুষ্ক দিনের পর তার শাখাগুলিও যেন নানা রঙে সাজিয়ে তোলে নিজেদেরকে— অলক্ষ্য রঙ লাগল আমার…।

অনেকেরই হয়তো জানা নেই, এই দোল বা হোলি উৎসবের মধ্যে অন্তর্নিহিত আছে অনেক পৌরাণিক উপাখ্যান। সেই উপাখ্যানের একটি আজ আপনাদের
বলছি—

একদিন ব্রহ্মার মানসপুত্র সনকাদি ঋষিগণ তিন লোকে ঘুরতে ঘুরতে বৈকুণ্ঠধামে এসে পৌঁছলেন। এঁরা বয়োজ্যেষ্ঠ হলেও দেখতে ছিলেন অল্পবয়সিদের মতো। তাই দ্বাররক্ষীরা তাঁদের কিছুতেই ভেতরে ঢুকতে দিল না। তখন তাঁরা ক্রুদ্ধ হয়ে সেই দ্বাররক্ষীদের এই অভিশাপ দিলেন যে, তারা অসুর হয়ে জন্মাবে। ফলে সেই দ্বাররক্ষীরা দিতির পুত্ররূপে জন্মাল। তাঁদের মধ্যে বড় ছিলেন হিরণ্যকশিপু এবং ছোট ছিলেন হিরণ্যাক্ষ। দৈত্যদের মধ্যে তাঁরা দু’জনই সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন।

যখন ভগবান বিষ্ণু বরাহ অবতার রূপ ধারণ করে হিরণ্যাক্ষকে বধ করলেন, তখন হিরণ্যকশিপু ভাইয়ের মৃত্যুতে শোকে দুঃখে প্রায় পাগল হয়ে উঠল। দৈত্য দানব পূর্ণ সভাগৃহে ত্রিশূল উদ্যত করে দৈত্যদের বলল যে, ‘যেদিন আমি আমার এই ত্রিশূল দিয়ে বিষ্ণুর শিরশ্ছেদ করতে পারব সেদিন সেই রক্তে আমার প্রিয় ভাইয়ের তর্পণ করলেই আমার হৃদয়জ্বালা শান্ত হবে। তাই তোমরা খুব তাড়াতাড়ি পৃথিবীতে গিয়ে মানুষদের ওপর অত্যাচার শুরু করো।’ তারা অর্থাৎ দৈত্যরা তখন হিরণ্যকশিপুর আদেশে ধরণীতে মানুষদের বিনাশ করতে শুরু করল। তখন মানুষেরা দৈত্যদের ভয়ংকর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল এবং দেবতারাও স্বর্গ ছেড়ে ছদ্মবেশে পৃথিবীতে বিচরণ করতে লাগলেন। ভাইয়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হলে তার ভাইয়ের ছেলেদের, তাদের মা রুষাভানুকে এবং নিজের গর্ভধারিণী মা দিতিকে সান্ত্বনা দিতে লাগল হিরণ্যকশিপু। তার জ্ঞানগর্ভ কথা শুনে নিজের পুত্রবধূর সঙ্গে দিতিও তৎক্ষণাৎ পুত্রশোক ত্যাগ করলেন।

হিরণ্যকশিপু মনে মনে স্থির করেছিল যে, সে এই সংসারের একচ্ছত্র সম্রাট হবে এবং অজেয় অমর হবে যাতে কেউ তার সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। এই ভেবে সে মন্দর পর্বতের এক গভীর গুহায় হাত দুটিকে আকাশের দিকে তুলে পায়ের আঙুলের উপর দাঁড়িয়ে কঠিন তপস্যা শুরু করল। দীর্ঘদিন ধরে এমন কঠোর তপস্যা করল যে নদী সমুদ্রের জল ফুঁসে উঠতে লাগল। পর্বতমালা সমেত পৃথিবী কেঁপে উঠল। দশদিক যেন জ্বলতে শুরু করল। তার এই তপস্যায় ভয় পেয়ে দেবতারা স্বর্গলোক থেকে ব্রহ্মার কাছে গিয়ে সব কথা জানালেন। তখন ব্রহ্মা ভৃগু, দক্ষ প্রমুখ ঋষিদের সঙ্গে হিরণ্যকশিপুর কাছে গেলেন৷ ঘাস লতাপাতার দ্বারা তার শরীর এমনভাবেই ঢাকা পড়ে গিয়েছিল যে তাকে প্রথমে দেখতেই পাওয়া যাচ্ছিল না। পিঁপড়েরা তার মাংস, রক্ত শুষে নিয়েছিল। তাকে দেখে ব্রহ্মা পর্যন্ত স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি তার দৃঢ়তায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন যে, ‘আমি প্রসন্ন হয়েছি তোমার তপস্যায়। তুমি এবার তোমার মনমতো বর চাও। আমার বর কখনওই নিষ্ফল হবে না।’

একথা শুনে হিরণ্যকশিপু অত্যন্ত আনন্দিত হল এবং ভূমিষ্ঠ হয়ে ব্রহ্মাকে প্রণাম করল। তার চোখ দিয়ে আনন্দাশ্রু নির্গত হতে লাগল এবং শরীরে রোমাঞ্চ দেখা দিল। তখন হিরণ্যকশিপু ব্রহ্মার কাছে এই বর চাইল যে, তাঁর সৃষ্ট কোনও প্রাণী-মানুষ অথবা পশু অথবা দেবতা বা দৈত্য এদের কেউই যেন তার মৃত্যুর কারণ না হয়। দিনে, রাতে, ভিতরে বা বাইরে ব্রহ্মা সৃষ্টি করেননি এমন কোনও জীবের হাতে, অস্ত্র বা শস্ত্রের দ্বারা পৃথিবী কিংবা আকাশে কোথাও যেন তার মৃত্যু না হয়। যুদ্ধে কেউ যেন তার সামনে দাঁড়াতেও না পারে। সে যেন সব প্রাণীকুলের একচ্ছত্র সম্রাট হয়।

এইরূপ দুর্লভ বর শুনেও ব্রহ্মা তাকে বর দিলেন। এদিকে তার অত্যাচারে সমস্ত লোক ভীত এবং অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। কারও কাছে আশ্রয় না পেয়ে তারা শ্রীহরির শরণাপন্ন হল।

হিরণ্যকশিপুর চার ছেলে ছিল। তাদের মধ্যে প্রহ্লাদ ছিল সবচেয়ে ছোট কিন্তু গুণের দিক থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ। সে ছিল সত্যপ্রতিজ্ঞ, জিতেন্দ্রিয়, সকলের প্রিয়, ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলা না করে ভগবান শ্রীবিষ্ণুর ধ্যান করে নিশ্চলভাবে বসে থাকত। শ্রীবিষ্ণু তার হৃদয়ে ও মনে এমন ভাবেই আসন গ্রহণ করেছিলেন যে জাগতিক সুখ-দুঃখের কোনও বোধই ছিল না তার। হিরণ্যকশিপু তার এই ধার্মিক পুত্রকে অপরাধী ঘোষণা করে তার অনিষ্ট করার চেষ্টা করতে লাগল।

একদিন হিরণ্যকশিপু তার ছোটছেলে প্রহ্লাদের শিক্ষা কেমন হয়েছে সে সম্পর্কে জানবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে। ছলে বলে কৌশলে সে জানতে পারল যে প্রহ্লাদ অত্যন্ত বিষ্ণুভক্ত। হিরণ্যকশিপু ক্রোধে অন্ধ হয়ে তাকে কোল থেকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দেয় এবং আদেশ দেয় যে কোনও উপায়ে তাকে মেরে ফেলবার জন্য। হিরণ্যকশিপুর এইরকম আদেশ শুনে হাতে বল্লম নিয়ে ভয়ংকর জোরে চিৎকার করতে করতে দৈত্যরা প্রহ্লাদের শরীরের নানা জায়গায় শূল দিয়ে খোঁচাতে শুরু করে। কিন্তু প্রহ্লাদ চুপ করে এক জায়গায় বসে একমনে ভগবান বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন। ফলে দৈত্যদের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয় এবং প্রহ্লাদের শরীরে এতটুকুও আঁচ পর্যন্ত লাগে না। তীক্ষ্ণ বল্লভের খোঁচায় প্রহ্লাদের কিছুই হল না দেখে হিরণ্যকশিপু আতঙ্কিত হল।

এরপর সে একটা পাগলা হাতির পায়ের তলায় তাকে পিষে মারার চেষ্টা করল। বিষধর সাপেদের মধ্যে তাকে বসিয়ে তাদের ছোবলের সাহায্যে মারার চেষ্টা করল। খুব উঁচু পাহাড়ের শিখর থেকে তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল। অন্ধকার কুঠুরিতে রেখে বিষ খাইয়ে বহুভাবে তাকে মারার চেষ্টা করে। হিরণ্যকশিপুর বোন হোলিকার একটি বিশেষ ধরনের পোশাক ছিল, যা তাকে আগুনে পুড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে পারত। হিরণ্যকশিপুর আদেশে হোলিকা তাকে কোলে বসায়। তারপর তাদের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এতে প্রহ্লাদের আগুনে পুড়ে মারা যাওয়ার কথা। কিন্তু ঘটনাচক্রে সেই আগুন জ্বলতেই হোলিকার দেহ থেকে সেই পোশাক খুলে গিয়ে প্রহ্লাদের শরীরকে ঢেকে দেয়। ফলে হোলিকা আগুনে পুড়ে মারা যায় এবং প্রহ্লাদ সুরক্ষিত থাকে।

এরপর অত্যন্ত রেগে গিয়ে হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদকে জিজ্ঞাসা করে, ‘কার বলে বলীয়ান হয়ে তুই নির্ভয় হয়ে আমাকে অবমাননা করছিস?’ তখন প্রহ্লাদ হাতজোড় করে বলে— ‘ব্রহ্মা থেকে আরম্ভ করে ছোট বড় সব জীবকুলকে ভগবান নিজের অধীনে রেখেছেন। তিনি সব প্রাণীর ইন্দ্রিয়। বল মন সবই তিনিই এবং স্বর্গ, মর্ত, পাতাল সকল স্থানে তিনি বিদ্যমান৷’ এই কথা শুনে রাজপ্রাসাদের একটি স্তম্ভ দেখিয়ে হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদকে বলে, ‘এই স্তম্ভের মধ্যে কি তোর ভগবান আছেন?’ প্রহ্লাদ উত্তরে বলে, ‘হ্যাঁ, সর্বত্রই তিনি বিরাজমান৷’ তখন রাগে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে সিংহাসন থেকে লাফিয়ে নেমে এসে সমস্ত শক্তি দিয়ে সেই স্তম্ভে আঘাত করে হিরণ্যকশিপু। ঠিক সেসময় এক গম্ভীর শব্দ শোনা গেলেও সভার মধ্যে কাউকেই দেখতে পাওয়া গেল না।

সবাই যখন এদিক-ওদিক শব্দের সন্ধান করছে ঠিক সেই সময়ই মানুষ বা পশু নয় নৃসিংহ রূপে এক অলৌকিক জীবের আবির্ভাব ঘটল। হিরণ্যকশিপু তাকে দেখে অবাক হয়ে যায়। ভগবান অবতাররূপে তার সামনে এসে দাঁড়ালেন। তার সেই রূপটি অতি ভয়ানক। পীত বর্ণের তার চোখ দুটি জ্বলজ্বল করছিল। তার দাঁতগুলি তরোয়ালের মতো চঞ্চল। মুখ ছিল ভয়ংকর। তাকে দেখে চিৎকার করতে করতে দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু গদা হাতে নৃসিংহ ভগবানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। যেমন জ্বলন্ত আগুনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পোকা ভস্মীভূত হয়ে যায় ঠিক তেমনিভাবেই সেও ভগবানের দীপ্ত তেজের কাছে অদৃশ্য হয়ে গেল। এরপর ভগবান তাকে তার রাজসভার দরজা পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে নিজের কোলের ওপর শুইয়ে নখ দিয়ে তাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেললেন। তাঁর তেজে দশদিক দেখা যাচ্ছিল না। এভাবেই হিরণ্যকশিপুর ব্রহ্মার কাছ থেকে লাভ করা বর তাকে বাঁচাতে পারেনি৷ প্রহ্লাদ এবং ত্রিলোক তার সন্ত্রাস থেকে মুক্তি পায়৷ বিষ্ণুর এই নৃসিংহ অবতাররূপে হিরণ্যকশিপু বধের মাধ্যমে প্রমাণ করে যে সর্বদাই শুভর দ্বারা অশুভর বিনাশ হয়ে থাকে৷ হোলিকা দহনের এই ঘটনাটি দোলের পূর্বদিন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

তাই ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে দোল বা হোলি শুধু বসন্ত উৎসব নয়, এটি অশুভ শক্তির বিনাশের পাশাপাশি শুভশক্তির অভ্যুত্থানের একটি বিশেষ দিন, যার উল্লেখ আমরা ভাগবতপুরাণে পাই। সেদিক থেকে দেখতে গেলে দিনটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ৷

ছবি প্রতীকী, সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।
* অজানার সন্ধানে (Unknown story): সঞ্চিতা কুণ্ডু (Sanchita Kundu) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, হুগলি মহসিন কলেজ।

Skip to content