তারিণী মাতা মন্দির।
বৈতরণী তো মৃত্যুর পরে দেখা যায়। এমনটাই শুনে এসেছি। কিন্তু দেখে এলাম ঘরের কাছে বৈতরণী। সত্যি কিনা জানতে গুগলেও খুঁজে নিশ্চিত হলাম। এই সে বৈতরণী। হাওড়া থেকে বন্দে ভারত এক্সপ্রেসে মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টা সময়। পৌঁছে গেলাম জাজপুর কেওনঝড় স্টেশন। কেওনঝড়ের খুব কাছে কোনও স্টেশন নেই। আরেকটি একটু কম দূরত্বে স্টেশন আছে। বারবিল। সেখানে আবার ট্রেন খুব কম।
জাজপুর থেকে কেওনঝড় একশো কিলোমিটারের বেশি। রাস্তা চমৎকার। দু’ পাশে হয় জঙ্গল নয়, সবুজ চাষের খেত। কেওনঝড় মূলত ঝর্ণার দেশ। বেশ খানিকটা দূরে দূরে একটা করে রূপসী ঝর্ণা। ভরা বর্ষায় তারা অপরূপা। আমরা পথে কিছু দর্শনীয় জায়গা দেখে পান্থনিবাস যাব। এমনটিই পরিকল্পনা। তারিণী মায়ের মন্দির পড়ল সবার আগে। বিরাট মন্দির। জাগ্রত দেবী। খুব ভিড়। স্বভাবতই বেশ অপরিষ্কার চারদিক। দেবীমূর্তি ভিড় ঠেলেঠুলে দেখার চেষ্টা করলাম। ফুল পাতায় ঢাকা। ভক্তজনের পুজো দেবার ভিড়।
আরও পড়ুন:
পরিযায়ী মন, পর্ব-৫: নীলনদের দেশে পিরামিড মানে অপার বিস্ময়
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৩: সুন্দরবনের গ্রামরক্ষক দেবতা আটেশ্বর
আবার খানিকটা ফাঁকা মাঠ জঙ্গল পেরিয়ে এলাম এক ঝর্ণা দেখতে। অদ্ভুত নাম। মনে রাখার জন্য রীতিমতো বারবার আওড়াতে হয়েছে। গুণ্ডিচাঘাই। এ ঝর্ণা থেকে যে নদীটির জন্ম সে হল সীতা নদী। ঝর্ণার উৎসটি বেশি উঁচুতে নয় বলে সেখানে ও পর্যটকরা যেতে পারেন। আর নীচে যেখানে জল লাফিয়ে পরছে সেখানে তো তাঁদের ভিড় লেগেই আছে।
পথেই দুপুরের খাবার খেয়ে পাহাড় ঘেরা কানঝারী বাঁধ দেখতে গেলাম। সেখানে সূর্যাস্ত খুব সুন্দর শুনেছি। কিন্তু সূর্য তো মেঘে ঢাকা। তাই সে দৃশ্য ও দেখা হল না। কিন্তু বাঁধের সবুজ ঢালে সাদা কাশফুলের অপূর্ব বাহার মন ছুঁয়ে রইল। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাচ্ছি।
পথেই দুপুরের খাবার খেয়ে পাহাড় ঘেরা কানঝারী বাঁধ দেখতে গেলাম। সেখানে সূর্যাস্ত খুব সুন্দর শুনেছি। কিন্তু সূর্য তো মেঘে ঢাকা। তাই সে দৃশ্য ও দেখা হল না। কিন্তু বাঁধের সবুজ ঢালে সাদা কাশফুলের অপূর্ব বাহার মন ছুঁয়ে রইল। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাচ্ছি।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৬: যুগে যুগে যা ‘সবার উপরে’
অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৭: তোমায় পড়েছে মনে আবারও…
পরদিন গেলাম খণ্ডাধার। অনেক উঁচু পাহাড় থেকে লাফিয়ে পরছে জলধারা। প্রতিটা ঝর্ণার কাছে পৌঁছনোর জন্য আছে চমৎকার সিড়ি। মাঝে মাঝে বিশ্রামের জন্য বসার জায়গা। দু’পাশে ঘন সবুজ জঙ্গল। এ বারে সিতাবিনজি। প্রকৃতির কারিগরি দেখে তাজ্জব বনতে হয়। মস্ত দুই পাথরকে যেন এক পা তুলে দাঁড় করিয়ে ছাদ বানিয়ে রেখেছে। কথিত আছে মাটির কন্যা সীতা এই প্রকৃতি নির্মিত ঘরে জন্ম দেন লবকুশের। কি চমৎকার নিশ্চিত নিরাপদ আশ্রয় পাথরের। ওই অঞ্চলের বিভিন্ন সমতলে হঠাৎ করে দেখা মিলবে মস্ত মস্ত পাথরের। যেন পাহাড়ের একটি করে খণ্ড বসানো। তার গায়ে জলধারা বয়ে তৈরি হয়েছে ফ্রেসকোর অপরূপ কারিকুরি।
বৈতরণী। ভিমকুণ্ড।
বরাঘাগরী ও সানাঘাগরী দুটি চমৎকার ঝর্ণা দেখলাম। বরাঘাগরীর জল একটু ঘোলাটে। কাদামাখা। অনেক উঁচু থেকে লাফিয়ে পরছে। শুনেছিলাম এখানে সূর্যের আলোয় রামধনু তৈরি হয় ঝর্ণার জলে। সঠিক সময়টিতে না গেলে তার দেখা মেলে না। আর মেঘলা দিনে তো সুয্যিমামার মুখ দেখাই ভাগ্য। আমাদের সে ভাগ্য নেই এ বার। তাই ঝর্ণার বুকে সূর্যের রামধনু আঁকা দেখা হল না।
সানাঘাগরী একটি বড় পার্ক পেরিয়ে। এখানে বোটিংয়েরও ব্যবস্থা আছে। অনেক সিড়ি পেরিয়ে সানাঘাগরীর একদম কাছে গেলাম। জল ছুঁয়ে দেখার মতো কাছে। প্রচণ্ড গর্জন করে বিরাট জলধারা নেমে আসছে পাথরের গা বেয়ে। ছোট রেলিং দেওয়া আছে ঝর্ণার জল যেখানে জমা হচ্ছে তার ধারে।
সানাঘাগরী একটি বড় পার্ক পেরিয়ে। এখানে বোটিংয়েরও ব্যবস্থা আছে। অনেক সিড়ি পেরিয়ে সানাঘাগরীর একদম কাছে গেলাম। জল ছুঁয়ে দেখার মতো কাছে। প্রচণ্ড গর্জন করে বিরাট জলধারা নেমে আসছে পাথরের গা বেয়ে। ছোট রেলিং দেওয়া আছে ঝর্ণার জল যেখানে জমা হচ্ছে তার ধারে।
আরও পড়ুন:
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৭: নাক বন্ধ হলেই নাকের ড্রপ? এতে শরীরে কোনও ক্ষতি হচ্ছে না তো?
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৬: ‘কোনওদিন কিছুই ছিল না, কিছুই কিছুই নেই আমাদের আজ’
কেওনঝড়ে জগন্নাথ মন্দিরটিও দেখার মতো। ভারী পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। বেশ বড় চত্বর। বেশি ভিড়ভাট্টা নেই। এ বার গেলাম গোনাসিকা। পাহাড়ের ওপরে গরুর নাকের মতো দুটি ফাটল দিয়ে অনবরত জল পরছে। এটি বৈতরণী নদীর উৎস। জলধারা ঘিরে মন্দির। পুণ্যার্থীদের সেখানকার জল বোতলে ভরে দিচ্ছেন পুরোহিত। আমরা ও পুণ্য অর্জনের লোভ সামলাতে পারলাম না। সেই জলধারা কে কিন্তু নীচে দেখতে পেলাম না। আশ্চর্য ব্যাপার। শুনলাম সে জল আবার মাটির নিচে ঢুকে গিয়েছে। তাই এর নাম গুপ্ত গঙ্গা। পরে বৈতরণী নদী হয়ে দূরে প্রকাশ পেয়েছে।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৯: প্লেগে কন্যার মৃত্যু, সেই শোক অবনীন্দ্রনাথের ছবিতে পায় ভিন্নতর মাত্রা
বৈতরণী নদী নিয়ে আমরা কত রকম গল্প শুনেছি। মৃত্যুর পরপারে পৌঁছনোর নদী। পুন্যাত্মারা স্বর্গলাভ করেন। তাদের বৈতরণী পার করার জন্য নৌকো আসে। আর পাপাত্মাদের এখানেই বিনাশ। জিম করবেটের গল্পে পড়েছিলাম মৃত্যুপথযাত্রীকে গরুর লেজে হাত ধরিয়ে রাখা হয়েছে। যাতে সে নির্বিঘ্নে বৈতরণী পেরোতে পারে। কিন্তু এখানে ভিমকুণ্ডে বৈতরণীর এক মনমোহিনী রূপ দেখলাম।
বৈতরণী।
চারদিকে পাথরের ফাটল দিয়ে ধেয়ে আসছে জলরাশি। তারপর দুটি ধারায় পাথরের মধ্য দিয়ে প্রবল বেগে বয়ে চলেছে। দু’ ধরে সবুজ ঘন জঙ্গল। কি অপরূপ শোভা। মনে হয়, স্বর্গ পরপারে নয়। এই তো স্বর্গ। ভিমকুণ্ডে বৈতরণীকে দেখে পরপারে যাওয়ার বৈরাগ্য জাগে না। জাগে জীবনকে ভালোবাসা, আঁকড়ে ধরা। মনে হয় প্রকৃতির এ আনন্দ আয়োজন “সবই বৃথা আমায় ছাড়া”।
ছবি: লেখিকা
ছবি: লেখিকা
* পরিযায়ী মন (Travelholic): ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।