রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


সাইবাবা।

পীঠস্থানগুলোতে বছরের সারা সময়ই ভিড় লেগে আছে দর্শনার্থীদের। যাওয়ার কোনও নির্দিষ্ট সময় নেই। আর পুজোপার্বনের দিনে তো উপচে পরে ভিড়। আশেপাশে ও দোকানপাটের ব্যবসার রমরমা। ভারতের ঈশ্বরকে কেন্দ্র করে ব্যবসা ফেঁদে কত মানুষ যে বিনা আয়েশে পয়সা নিচ্ছে ভাবলে অবাক লাগে। দর্শনার্থীরা আবেগের বশে কত জায়গায় যে ফাঁদে পরছেন, তার একটির কথা আজ বলব। সতর্কিকরণের জন্য।
ঔরঙ্গাবাদ থেকে ঘণ্টা দেড়েকের রাস্তা শিরডি। সাইবাবার মস্ত আশ্রম। অন্যান্য মন্দিরের মতো পান্ডার উৎপাত নেই। মস্ত মন্দির। দর্শনার্থীদের ঢোকার অনেক গেট। প্রবীণ নাগরিকদের প্রবেশেরও আলাদা গেট। এক প্রবীণ নাগরিকের অভিজ্ঞতা। এক যুবক গাড়ি থেকে নামা মাত্র এক দর্শনার্থীকে সেই গেটে পৌঁছে দেবে বলে সঙ্গ নেয়। তারপর পাশেই এক দোকানে চটি ও মোবাইল রাখার ব্যবস্থা করে দেয়। কোনও পয়সাও চায় না সে জন্য। এ বার পুজো দেবার সামগ্রী ওখান থেকে নিতে অনুরোধ করে। স্বভাবতই দর্শনার্থী ওখান থেকে সেগুলো কেনেন। কী কী লাগে পুজো দিতে ওরাই বলে দেয়। নকুলদানার প্যাকেট এবং একফালি গেরুয়া কাপড়, যেটা বাবার বেদীতে দান করতে হয়, আর এক ফালি কাপড় বেদীতে ছুঁইয়ে নিয়ে আসতে হয়। বেশ চড়া দামে সেগুলো কেনার পর নির্ধারিত গেট দেখিয়ে দেয়। এ গেটে ভিড় কম।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-১৭: পাপাঙ্গুলের যাত্রা

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৩: সারদা মায়ের দার্শনিক দৃষ্টি

এ বারে নির্ধারিত গেটে লাইন দিয়ে প্রবেশের সময় এক চমক। সিকিউরিটির লোক সেই দর্শনার্থীর হাত থেকে বাবাকে নিবেদন করার প্রসাদের প্যাকেট এবং কাপড়ের টুকরো নিয়ে নীচে বাস্কেটে ফেলে দেয়। মন্দিরে কোনও পুজোর সামগ্রী নিয়ে ঢোকার অনুমতি নেই। শুধু দর্শন। অথচ এ কথাটা পরিষ্কার করে কোথাও লেখা নেই। এর ফলে দোকানদাররা বানিয়ে খানিক মিথ্যে গল্প করে জিনিসগুলো গছিয়ে দিচ্ছে। মন্দিরের ভিতরে চমৎকার ব্যবস্থা। সবাই সুন্দর ভাবে দর্শন করতে পারছেন। প্রসাদও বিনে পয়সায় পাচ্ছে। পুণ্যস্থানের পাশেই কত মিথ্যাচার। সেই পুরোনো প্রশ্ন মনে জাগছিলো, এদের কি পাপ-পুণ্যের ভয় নেই?
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬১: ‘বন্ধু’ তোমার পথের সাথী

এই দেশ এই মাটি, পর্ব-৩৫: সুন্দরবনের নদীবাঁধের অতীত

আবার আরেক পুণ্যধামে গিয়ে অন্যরকম অভিজ্ঞতা হল। শিরডি থেকে পথে পরল শনি-শিঙ্গাপুর গ্রাম। এক অদ্ভুত বিশ্বাসে ভরপুর। জেনেছিলাম, এ গ্রামে কেউ দরজায় তালা লাগায় না। অনেক দোকানে দরজা নেই। এখানে কোনও চোর ঢুকতে পারে না। বিশ্বাস, শনি দেবতা এদের পাহারা দেন। আমরা দোকানে পুজো দেবার জিনিসপত্র কিনলাম। ভয় হচ্ছিল, সত্যি পুজো দেওয়া যায় তো? দোকানদার পয়সা নিল না। বলল, ফেরার সময় দেবেন। দেখলাম দোকানের দরজা নেই। আশ্চর্য। মস্ত মন্দির। শনি দেবতার কোনও মূর্তি নেই। একটি শিলাখন্ড। দেবতার মাথায় ছাদ নেই। বেদির চারদিক গ্রিল দিয়ে ঘেরা। পুজো সামগ্রী নিবেদনের নির্দিষ্ট জায়গা আছে। একবার দর্শনের পর ফেরার সময় নাকি পিছন ফিরতে নেই। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মন্দির চত্বর। আমরা পুজো দিয়ে মন্দিরের সামনে বাঁধানো পরিখা ও বাগান দেখে ফিরলাম।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪২: অ্যান্টিবায়োটিক খেলেই গন্ডগোল?

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫০: লক্ষ্মণ—ভ্রাতৃত্বের এক অনন্য দৃষ্টান্ত

দোকানদারকে পয়সা দিলাম। স্থানমাহাত্য শুনলাম ও দেখলাম। সত্যিই কেউ দরজা বন্ধ করে না। প্রচলিত গল্প আছে যে, চোর কিছু নিয়ে পালাতে গিয়ে গ্রামের সীমানা পেরোনোর আগেই পরে যায় এবং জিনিসও বাইরে যেতে পারে না। এমন বিশ্বাসেই চলছে পুরো গ্রামের মানুষ। বর্তমান যুগের নানারকম নতুন নতুন সিকিউরিটির ব্যবস্থা, সিসিটিভি, এসবের সময় এমন একটি গ্রাম দেখে অবাক লাগলো। একদিন দু’ দিন নয়। দীর্ঘদিন ধরে এমনটিই চলে আসছে শনি-শিঙ্গাপুর গ্রামে।

ভারতের একমাত্র ‘অপরাধমুক্ত’ গ্রাম শনি-শিঙ্গাপুর।

একই পথে খানিক আগেই শুনে এলাম ধর্মের নামে ভয়ঙ্কর লোক ঠকানোর ব্যবসা, মানুষের প্রতি বিশ্বাস উবে যায়। আবার একটু পরেই চুড়ান্ত বিশ্বাসের নির্যাস দেখে এলাম। “সত্য সেলুকাস কি বিচিত্র এ দেশ”।
* পরিযায়ী মন (Travelholic): ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content