মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


ছবি: সংগৃহীত।

“নীড় ছোট ক্ষতি নেই, আকাশ তো বড়”—এখন বেড়ানোর জন্য পৃথিবীটা ছোট হয়ে গিয়েছে। কোনও জায়গাই অগম্য নয়। দেশের বাইরেও ভ্রমণ পিপাসুরা হামেশা পাড়ি দিচ্ছেন। গত দু’ তিন দশক ধরে দেশের বাইরে বেড়ানো সহজ হয়ে গিয়েছে। অনেক সংস্থা আছে যারা ভিসা ইত্যাদি করানোর দায়িত্ব নিয়ে ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ ঘুরিয়ে দেয়। আমরাও এমনই এক সংস্থায় নাম লিখলাম। সালটা ২০১৪। সরকারি কর্মচারীদের ভিসার আগে একটা ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ (এনওসি) লাগে। সেজন্য খানিকটা সময়ও উদ্বেগ খরচ হল। তারপরের সব কাজ সংস্থাটি করে দিল। দুটি ভিসা লাগে। ব্রিটেনের জন্য একটা, আর অন্যান্য সমস্ত দেশের জন্য একটা। আবার ব্রিটেনের ভিসাতে আয়ারল্যান্ডও যাওয়া যায়। এ তথ্যটি জানা ছিল না বলে আমাদের প্রথম দিকে খুব উৎকণ্ঠা ছিল।
সেটা ছিল মে মাস। ইউরোপের আবহাওয়া চমৎকার। প্রচণ্ড ঠান্ডা নেই। সকাল সন্ধে মোটামুটি একটা ফুলহাতা গরমজামা পরলেই চলে। দমদম থেকে দোহাতে বিমান বদলে প্রথমে হিথরো বিমানবন্দরে নামলাম। হিথরো বিমানবন্দরের অভিবাসন বিভাগে ইউরোপিয়ান এবং যারা ইউরোপিয়ান নন, এমনদের জন্য দুটি আলাদা লাইন। কেন জানি না আলাদা লাইন দেখে একটু খারাপ লাগলো। বেশ অনেকটা সময় লাগলো বিমানবন্দর থেকে বেরোতে। প্রায় জনা পঁচিশ ছিলাম দলে। বেরিয়ে বাসে উঠলাম। মোটাসোটা হাসিখুশি ড্রাইভার। গাড়ি চালাতে চালাতে পথঘাট ও চেনাতে লাগলো। খুব রসিক। নিজের মোটা চেহারা নিয়ে রসিকতা করতে ছাড়ল না। পরেও অনেক জায়গায় দেখেছি। ও দেশে ড্রাইভাররা অত্যন্ত দক্ষ। কোনও হেল্পার বা কনডাক্টর ছাড়া পুরো বাসের সব কাজ দেখাশোনা করে। ড্রাইভারই পয়সা নেয়। যাত্রীরা নামার সময় তাকে পয়সা দিয়ে টিকিট নেয়।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন: পরিযায়ীর বিপর্যয়

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৯: কুরদার ইকো রিসর্ট—অনাবিস্কৃত এক মুক্তা

আমরা পৌঁছলাম হোটেল হলিডে ইন এক্সপ্রেসে। কাছেই উইম্বলডন স্টেডিয়াম। তখন রাত হয়ে এসেছে। হোটেলে ব্যাগপত্র রেখে রাস্তার ওপারে একটা রেস্তরাঁয় নৈশভোজ সারলাম। চারদিক ঝাঁ চকচকে। ওখানকার সমস্ত হোটেলই ‘বিএনবি’ অর্থাৎ বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট। সকালে উঠে ব্রেকফাস্টের আয়োজন দেখে তো চোখ ছানাবড়া। এলাহি আয়োজন। নানারকমের খাবার এবং একই জিনিসের নানারকম খাবারদাবার। পুরোটাই বুফে। প্রথমদিনের সকালে এমন রাজকীয় ব্রেকফাস্ট দেখে সবাই বেজায় খুশি।

এ বার বাসে করে সাইট সিইং-এর পালা। টেমস নদীর ধারে লন্ডন আই, যেন একটা মস্ত নাগরদোলা। তাতে বড় বড় কেবল কার। রোপওয়েতে যেমন থাকে। এক একটায় একসঙ্গে অনেক লোক উঠতে পারে। খুব ধীরে ধীরে ঘুরে ওপরে উঠছে চাকা। ওপর থেকে নদী ও শহরের অপূর্ব এক ছবি দেখা যায়। তবে টেমস নদী দেখে আমাদের দেশের নদী নিয়ে গর্ব হল। টেমস এত ছোট যে খাল বললেও অত্যুক্তি হয় না। মনে মনে ওদেশের লোককে বললাম, তোমরা আমাদের গঙ্গা দেখে এস। জানবে নদী কাকে বলে। টেমসের ধারে পর্যটকদের ভিড়। ছোট দোকান পাটও বসেছে। মেলার মতো। একজন লোক গাছ সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা তার সঙ্গে ছবি তুললাম। কেউ বা স্ট্যাচু সেজে দাঁড়িয়ে আছে। নিথর হয়ে। এমন নিথর ও নিষ্পলক দৃষ্টি যে মাঝে মাঝে ভ্রম হয় সত্যি মানুষ না স্ট্যাচু?

ছবি: সংগৃহীত।

লন্ডনের রাস্তায় বাস চলতে চলতে সেই বিখ্যাত ঠিকানার বাড়ির পাশ দিয়ে গেল। ঠিকানাটা দেখার জন্য সবাই জানালা দিয়ে মুখ বাড়ালাম। ২২১বি, বেকার স্ট্রিট, শার্লক হোমসে কাল্পনিক ঠিকানা। এরপর গেলাম মাদাম তুসোর মিউজিয়াম। লন্ডনের পর্যটন শিল্পে মাদাম তুসোর মিউজিয়াম একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। শুধুমাত্র মোম দিয়ে তৈরি সব মূর্তি। পৃথিবীর নানা বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, তারকা, খেলোয়াড় সবার মূর্তি সযত্নে রাখা। অবিশ্বাস্য ধরনের জীবন্ত দেখতে মূর্তিগুলো। যেন এখুনি এগিয়ে এসে কথা বলবে। মুর্তিগুলোর সঙ্গে ছবি তোলার ধুম পড়ে গেল। আমি সচিন তেন্ডুলকরের কাঁধে হাত রেখে ছবি তুললাম। মূর্তি বলে এমন কথা লেখা। আসলে এমন কথা লেখা যায়? একটা মূর্তি কাঁচের বাক্সে শোয়ানো। তার আবার নিঃশ্বাস এবং প্রশ্বাস পড়ছে। বুক ওঠানামা করছে। নিজের চোখকেই বিশ্বাস হয় না।
আরও পড়ুন:

কলকাতার পথ-হেঁশেল: যাদবপুর— যদুকুল ও চপস্টিকস

যত মত, তত পথ, পর্ব-১: শ্রীরামকৃষ্ণের আনন্দ-পাঠশালা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭১: ইংরেজের চোখে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ‘দাগী আসামী’

লন্ডন শহরে পর্যটকদের শহর ঘুরে দেখার জন্য আছে লাল রঙের দোতলা বাস। তার ছাদ নেই। পর্যটকদেরা বাসের দোতলায় বসে শহর পরিক্রমা করতে পারে। ইউরোপের অন্যান্য শহরেও এমনটি দেখেছি। এরপর গেলাম ট্রাফালগার স্কোয়ারে। মস্ত বাঁধানো চত্বরের মাঝে একটা ফোয়ারা। মূর্তি। অনেক লোকের ভিড়। হইচই, খাওয়া দাওয়া। ছবি তোলা। প্রাণশক্তির ফোয়ারা। আমরা আইসক্রিম খেলাম।

এর পরে লন্ডনের হাইড পার্কের পাস দিয়ে এলাম। সবচেয়ে প্রাচীন পার্ক। সপ্তদশ শতকের কবির লেখাতেও এর কথা আছে। অভিজাত ঘরের মহিলাদের সান্ধ্য ভ্রমণের জায়গা। এখনও অনেক লোক ইতস্তত ঘুরছে ওখানে। ফেরার সময় বিখ্যাত ওয়েস্টমিনিস্টার ব্রিজ দেখলাম। সকালবেলায় এর ওপর দাঁড়িয়ে কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ দুশো বছরেরও আগে শহরের শান্ত রূপে মুগধ হয়ে লিখেছেন—”Earth has not anything to show more fair”. এখন সেই শান্ত ছবি না থাকলেও ব্রিজে দাঁড়ালে শহরের একটি সুন্দর ছবি দেখতে পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৩: অভিনয় নয়, কিশোর মনে-প্রাণে একজন গায়ক হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করতে চেয়েছিলেন

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৩: কানে ব্যথা? তেল দেবেন কি?

একদিন সকালে বেরোলাম স্ট্র্যাটফোর্ড আপঅন অ্যাভন-এর উদ্দেশ্যে। শেক্সপিয়ারের বাসস্থান বলে বিখ্যাত। একটা সরু খালের মতো অ্যাভন নদী। তার ধারে শহর। প্রথমে গেলাম অ্যান হ্যাথওয়ের কটেজে। বিরাট এক বাগানবাড়ি। ছাদটি খড়ের। স্বাভাবিক ভাবেই খুব যত্নের সঙ্গে ঠিক রাখা হয়েছে। বাগানে ফুল ও পাতার বিন্যাস দেখার মতো। এ বাড়িতে অ্যান হ্যাথওয়ে বড় হয়েছেন। এখান থেকে গেলাম শেক্সপিয়ারের বাড়ি। ছোট দোতলা বাড়ি। ছোট ছোট শোবার ঘর। খাটগুলো অনেক উঁচু। ওঠার জন্য সিঁড়ি আছে।

শেক্সপিয়ারে বাবার ছিলেন গ্লাভস বানানোর ব্যবসা। কিছু গ্লাভস প্রতীকী হিসেবে রাখা আছে। দোতলায় ওঠার কাঠের সরু সিঁড়ি। বাড়িটি দেখে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের বাড়িবলে চেনা যায়। একজন বিশ্ববরেণ্য লেখকের বাড়ি বলে বুঝলাম নিচে এসে। বাড়ির সংলগ্ন একটি বাঁধানো চত্বর। সেখানে সারাক্ষণ শেক্সপিয়ার রচিত কিছু না কিছু অভিনীত বা পঠিত হচ্ছে। যে কেউ অংশগ্রহণ করতে পারে।

আমরা যখন গেলাম তখন রোমিও-জুলিয়েটের ব্যালকনির দৃশ্য হচ্ছে। এক বৃদ্ধ কারও একটা দোপাট্টা মাথায় জড়িয়ে সরু সিঁড়ি দিয়ে তরবরিয়ে উঠছেন। আমার সঙ্গে প্রায় ধাক্কা লাগে আর কী। জিগ্যেস করলাম ছুটছেন কেন? দোপাট্টাকে ঘোমটা করে টেনে মিষ্টি হেসে বললেন, I am Juliet now. Romeo is waiting. I will be there on balcony. আমিও তাড়াতাড়ি নেমে এলাম সে দৃশ্য দেখার জন্য। ও বাড়িতে তো ব্যালকনি নেই। সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ের কাঁচের জানালা খুলে তাকেই ব্যালকনি মনে করে জুলিয়েট দাঁড়ালেন। বাগানের বাঁধানো চত্বরে এক যুবক। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্য সে হুইলচেয়ারে। বাগানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দর্শক। কী সুন্দর সে অভিনয়। প্রাণের গভীর থেকে উৎসারিত। সেখানে অভিনয়ে আনুষঙ্গিক কিছুই লাগে না বুঝলাম। কোনও প্রতিবন্ধকতাই বাঁধা হয় না। যে কোনও ইচ্ছুক পর্যটক শেক্সপিয়ারকে এ ভাবে শ্রদ্ধার্ঘ্য দিতে পারে।

পরবর্তীতে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক বললেন, তিনিও ওখানে দাঁড়িয়ে শেক্সপিয়ারের সনেট থেকে আবৃত্তি করেছেন। শেক্সপিয়ারকে তার সৃষ্টির মাঝে নিরন্তর বাঁচিয়ে রাখার এই প্রয়াস দেখে অভিভূত হলাম। আমরা বিখ্যাত ব্যক্তিকে অনুষ্ঠান করে স্মরণ করি। তার জিনিসপত্রের মিউজিয়াম করি। কিন্তু তাঁর সৃষ্টির অনবরত চর্চা করে তাঁকে অমরত্ব দেওয়ার এই প্রয়াস অভিনব। অনেকগুলো অভিনয় এবং পাঠ শুনলাম। মন ভরিয়ে। ফেরার পথে বাইরে থেকে দেখলাম রয়্যাল শেক্সপিয়ার থিয়েটার ও হলি ট্রিনিটি চার্চ। আর পথে বাস থামিয়েছিল লর্ডসের স্টেডিয়ামে। বন্ধ গেটের ফাঁক দিয়ে চোখ রেখে একটু দেখে নিলাম।

ছবি: সংগৃহীত।

দু’ দিন, দু রাত ছিলাম লন্ডনে। আরেকটি দ্রষ্টব্য ছিল বাকিংহাম প্রাসাদের রক্ষী বদল। এটি ইংল্যান্ডে বেড়াতে এলে পর্যটকদের একটি আকর্ষণ। একটি জমকালো বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান। প্রায় চল্লিশ মিনিট ধরে চলে। প্রাসাদের সামনে মস্ত বাঁধানো রেলিং ঘেরা চত্বর। নির্দিষ্ট সময় একদল রক্ষী মার্চ করে প্রাসাদের সামনে আসে। রক্ষীর দল ছাড়াও থাকে যন্ত্রীর দল। এক এক দলের এক এক রকম জমকালো পোশাক। লাল কোট, কালো প্যান্ট, মাথায় উঁচু কালো ফারের টুপি।

জানা যায়, এ রক্ষীরা ইংল্যান্ডের বিভিন্ন অঞ্চলের। তাদের কোটের কাঁধের স্টার বা পকেটে আটকানো ব্যাজ দেখে বোঝা যাবে কে কোন জায়গার, ওয়েলস, না আয়ারল্যান্ড, না কি স্কটল্যান্ডের। দূর থেকে তা বোঝার উপায় নেই। ফ্লুট, ব্যাগপাইপ এ সবের এক সুন্দর সুর বাজতে লাগলো। তার তালে তালে দৃঢ় পদক্ষেপে তরোয়াল উঁচিয়ে ধরে এগোয় রক্ষীরা। প্রাসাদ থেকে বেরোয় আরেক দল। দু’জন দু’ দল থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখে সামনে এগিয়ে যায়। তারা চাবি হস্তান্তর করে। ডান হাতে তরোয়াল। বাঁ হাতে চাবি। শুনেছি চাবিটি প্রতীকী। দু’ জনের বাঁ হাত ছোঁয়া হল চাবি হস্তান্তরের প্রতীক। খুবই দৃষ্টিনন্দন এ অনুষ্ঠান। রেলিংয়ের বাইরে দাঁড়িয়ে উপভোগ করলাম পুরো অনুষ্ঠানটি।

লন্ডনে দেখার অনেক কিছুই আছে। যেটি না দেখার আফসোস রয়ে গেল সেটি ব্রিটিশ মিউজিয়াম। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে মানুষের সভ্যতার ইতিহাস ও সংস্কৃতি ধরে রেখেছে এই মিউজিয়াম। তবে সেটি এত কম সময়ে দেখা সম্ভব হত না। হলেও অসম্পূর্ণ হত। আর দেখা হল না উইন্ডসর কাসল, প্রায় হাজার বছর ধরে ব্রিটিশ রাজবংশের বাসস্থান। দেখা হল না টাওয়ার অফ লন্ডন। নিজেকে সান্ত্বনা দিই দেশেরই তো কত কি দেখা হয়নি। হবেও না। জীবন যে বড় ছোট!
* পরিযায়ী মন (Travelholic): ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।

আপনার রায়

ইসরোর চন্দ্রযান-৩ কি তৃতীয় বারের এই অভিযানে সাফল্যের স্বাদ পাবে?

Skip to content