জয়রামবাটির জগদ্ধাত্রী পুজোর এক ইতিহাস আছে। এটি শ্রীশ্রী মায়ের মা শ্যামাসুন্দরী দেবী শুরু করেন। গ্রামের এক বাড়িতে কালিপুজোয় চাল দিতেন তিনি। একবার তারা সে চাল নিতে অস্বীকার করেন। পুজোর উদ্দেশ্যে করা চাল তো অন্য কাজে ব্যবহার করা যাবে না। শ্যামাসুন্দরী দেবী কাঁদতে থাকেন। তখন ঘুমের মধ্যে স্বপ্নাদিষ্ট হন। দেবী জগদ্ধাত্রী বলেন, “কালীর চাল আমি খাব, তোমার ভাবনা কি? মা বললেন, কে তুমি? জগদ্ধাত্রী বললেন, এই যে গো, এর পরেই যার পুজো।” সেই শুরু। কিন্তু এত দারিদ্রের মধ্যে পুজোর আয়োজন করা! তাই শ্রীশ্রী মা ভেবেছিলেন একবছর করে আর পুজো করবেন না। কিন্তু তিনিও স্বপ্নাদিষ্ট হন এবং ঠিক করেন কোনওদিন এ পুজো বন্ধ হবে না।
শ্রীশ্রী মা যে বিশ্বাসের ভিতে পুজো শুরু করেছিলেন সে ভিত হয়েছে আরও শক্ত। জয়রামবাটির জগদ্ধাত্রী পুজোর সমারোহ দেখার মতো। সমারোহ কথাটা বোধ হয় ঠিক হল না। চন্দননগরের মতো সমারোহ নয়। প্যান্ডেল, আলোর রোশনাই নয়। আছে প্রাণের আবেগ, বিশ্বাসের দৃঢ়তা, মায়ের কাছে যাওয়ার টান। মিশনের বাগানেই সিমেন্টের বাঁধানো বেদি তৈরি হয়। সেখানে ছোট্ট সাবেকি ঢঙে প্রতিমা।
আরও পড়ুন:
পরিযায়ী মন, পর্ব-১৬: ঐতিহ্যবাহী বাড়ির শহর মধুপুর
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৩: ‘সুরের পরশে’ তুমি-ই যে শুকতারা
সকাল থেকে কাতারে কাতারে লোক আসছে। বড় রাস্তা থেকেই গাড়ি ঢোকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, পুণ্যার্থী দের হাঁটার পথে যাতে অসুবিধে না হয়। গেট দিয়ে ঢুকে মন্দির সংলগ্ন বাগানে বিরাট প্যান্ডেল। অনেক চেয়ার দেওয়া হয়েছে সেখানে। ভক্তজন বসে পুজো দেখছেন। সবাই প্রতিমা দর্শন করতে পারছেন। দূরে দাঁড়িয়েও। এছাড়া পাশে মস্ত স্ক্রিনে পুজো দেখা যাচ্ছে। স্তোত্র পাঠ হচ্ছে মন্ডপে। কোথাও কোনও বিশৃঙ্খলা নেই। চেঁচামেচি নেই। আমার বড় ভয় করে ভিড়ে। কিন্তু না। ভিড় আছে। অথচ সবাই স্বাচ্ছন্দ্যে আছে।
কিছু মানুষ মূল মন্দিরে। কেউ মায়ের পুরোনো বাড়িতে। সেখানেও ঘরের সামনে বাঁধানো উঠোনে নীরবে বসে আছেন কিছু ভক্ত। কেউ বা গেটের কাছে দোকানে। কিন্তু কোথাও অযথা চেঁচামেচি, গল্প-গুজব, সেলফি তোলা, এ সব নেই। আগত সব মানুষ যেন একসূত্রে বাঁধা। মায়ের বাড়ি এসেছেন সবাই। কলকাতা, চন্দননগরের পুজো মন্ডপ থেকে আলাদা এ মন্ডপ। কারও মধ্যে কোনও দেখনদারি ভাব নেই। সবাই সন্তুষ্ট, নিশ্চিন্ত; মায়ের কাছে এসেছেন বলে।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৪: সুন্দরবনের রাজমাতা দেবী নারায়ণী
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৮: সকালবেলাই হাঁটতে হবে?
ভেবেছিলাম লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে প্রসাদ খেতে যাব না। মাইকে ঘোষণা হচ্ছে প্রসাদ নেবার। একবার গিয়ে দেখি। বেশি ভিড় হলে দাঁড়াবো না। পুজোর দিনে খাওয়ার জন্য কোনও কুপন লাগবে না শুনলাম। না জানি তবে কত লোক হবে। পুজোর দিনে খাওয়ার জায়গা আলাদা। মাতৃ মন্দিরের পিছনে যে মস্ত ক্ষেত সেখানে। বিরাট প্যান্ডেল। খাওয়ার জায়গা সংলগ্ন অস্থায়ী রান্নার জায়গা। মস্ত কাঠের উনুন। সেই মাপের কড়াই। বড় বড় পাত্রে রান্নার সরঞ্জাম। সে সবের বিশালত্ব দেখে চোখ ছানাবড়া। অনুমতি নিয়ে সে সবের ছবি তোলা হল। অনেক লোক যাচ্ছেন। কিন্তু লাইন এ দাঁড়ানো নেই।বসে পরলেই হল।
আরও পড়ুন:
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২৩: চল্ রে চল্ সবে…
কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-১৬: মোমো চিত্তে!
চারদিকে অনেক স্বেচ্ছাসেবী। বিভিন্নভাবে দর্শনার্থীদের সাহায্য করার জন্য। যারা নীচে বসতে পারেন না তাদের জন্য পাশে কিছু বেঞ্চ আছে। আমরা বসে পরলাম। গরম সুস্বাদু খিচুড়ি তরকারি চাটনি ও লাড্ডু। যেন অমৃত। এত অনায়াসে এত মানুষকে ঠিক ঠিক পরিষেবা দেওয়া, এমনটি বোধ হয় মিশনই পারে। আর পারেন শ্রীশ্রী মায়ের নাম। মায়ের বাড়ি ভেবেই বোধ হয় অন্যত্র অবাধ্য সন্তানেরাও এখানে শৃঙ্খলা বদ্ধ হয়ে পুজো দেখেন, প্রসাদ নেন।
মন্দিরের বাইরে মেলা বসেছে। রান্নাঘরের, বাগানের সব লোহার সরঞ্জাম বিক্রি হচ্ছে। যানবাহন ঢুকছে না বলে নিশ্চিন্তে পথের ধারে কেনাকাটা চলছে। এখানে একদিনেই পুজো সারা হয়। পরদিন বিসর্জন ও রাতে ওই মন্ডপে গ্রামেরই কোনও দলের যাত্রা পালা হয়। গ্রামের লোকেরাও সেদিন সবাই মায়ের বাড়ির প্রসাদ পেয়েছেন। একটু আঁচ পাওয়ার চেষ্টা করছিলাম কত লোক খেয়েছেন। এ অঙ্ক কঠিন। কিন্তু কারও হিসেবের দরকার নেই। মায়ের বাড়িই তো। কেউ অভুক্ত থাকেনি।
ছবি: লেখিকা।
ঋণ স্বীকার
● শ্রীশ্রী সারদা দেবী: ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্য
ছবি: লেখিকা।
ঋণ স্বীকার
* পরিযায়ী মন (Travelholic): ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।