
“তারা ছাঁকনি চড়ে সাগর পাড়ি দেবে, দেবেই দেবে…” এরা সত্যজিৎ রায়ের পাপাঙ্গুল। ছাঁকনি দিয়ে জল উঠলে বৈয়াম চড়বে। ঝুড়ি চেপে নদীতে পাড়ি দিতে পাপাঙ্গুলে কথাই মনে হচ্ছিল। তারা তো কাল্পনিক। ননসেন্স কবিতার চরিত্র। আর এ হল আসল ঝুড়ি চেপে জলে ঘোরা। অবশ্য ঝুড়ির ফোঁকর বন্ধ করা, সম্ভবত আলকাতরার সিট দিয়ে। মস্ত মস্ত ঝুড়ি। চারজন ও মাঝি বসতে পারে।
আমি তামিলনাড়ুর হোগেনাক্কাল এ কাবেরী নদীতে ঘোরার কথা বলছি। একে বলে করাক্কেল রাইড। তামিলনাড়ু ও কর্ণাটকের বর্ডার এটি। নদীর একপার তামিলনাড়ু। অন্যটি কর্ণাটক। বিভিন্ন ঝর্ণাধারা লাফিয়ে অনবরত জলধারায় মিশছে। হোগেনাক্কাল কথাটি কন্নড় থেকে এসেছে। এর মানে স্মোকি রকস, ধোঁয়ার পাথর। ওপর থেকে জলধারা লাফিয়ে পরে। পাথরের গায়ে জলকণা ধোঁয়ার মতো ছড়িয়ে যায়।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-১৬: ঐতিহ্যবাহী বাড়ির শহর মধুপুর

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬১: ‘বন্ধু’ তোমার পথের সাথী
আমরা দলে সাত জন। তাই দুটো ঝুড়ি। মাঝি কাঁধে করে ঝুড়ি এনে ঝপাং করে জলে ফেলছে। ঝুড়ি কাঁধে মাঝিকে প্রায় দেখাই যায় না। পিছন থেকে দেখলে দুটি পায়ের ওপর ঝুড়ি চলেছে মনে হয়। দু’ দিকে উঁচু পাথরের মাঝ দিয়ে বয়ে চলে কাবেরী। ঝর্ণার জলে পুষ্ট। পাথরের এবড়ো খেবড়ো সিঁড়ি দিয়ে নেমে ঝুড়িতে চড়তে বেশ সাহস লাগে। কোনও কোনও পর্যটককে দেখলাম ওখান থেকে ফিরে আসছে। ভয় পেয়ে। ওপর থেকে যাত্রী ভরা ঝুড়ির সারি দেখতে খুব সুন্দর। সওয়ারিদের রঙিন জামাকাপড়ে দূর থেকে ঝুড়িগুলো রঙিন লাগছে।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৯: মহাকাব্যের রাক্ষস ও মানুষের কাহিনিতে আধুনিক জীবনচিত্রের প্রতিফলন রয়েছে কি?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩২: সরকারবাড়ির ছেলেদের সঙ্গে শ্রীমার বুড়ি-বুড়ি খেলা
চার জন করে ঝুড়িতে বসা হল। সঙ্গে মাঝি। কাবেরী বয়ে চলেছে দু’ দিকের উঁচু পাথরের পারের মাঝ দিয়ে। কোথাও বা পাথর থেকে লাফিয়ে পরছে ঝর্ণা। আমরা পা ছড়িয়ে ঝুড়িতে বসে খুব মজা পাচ্ছিলাম। মাঝি আমাদের আনন্দ দেখে একদম ঝর্ণার নীচে প্রায় নিয়ে গেল। ভিজে যাবার উপক্রম। তারপর একই জায়গায় গোল গোল করে ঝুড়ি ঘুরিয়ে কসরৎ দেখালো। আমরা প্রতিজ্ঞা করেছি ভয় পাবো না। তাই শক্ত করে ঝুড়ি চেপে বসে রইলাম। মাঝি তার ভাষায়, যা আমাদের কাছে দুর্বোধ্য, বকবক করতে লাগলো। কথার মাঝে রাবনা রাবনা শুনলাম। পরে বোধগম্য হল, রাবণ মুভির শুটিংয়ের জায়গা ওখানেই এক পাথরের পাড়ে। তাই দেখানোর চেষ্টা করছিল।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৮: ষাট-বাষট্টি, বড়োজোর সত্তর বছর বাঁচবেন রবীন্দ্রনাথ, বলেছিল এক গণৎকার

গৃহিণীদের মধ্যে বইয়ের নেশা বাড়াতে কাঁধে ঝোলা নিয়ে ঘুরে বেড়ান রাধা, ‘চলমান পাঠাগার’ তাঁর পরিচয়!

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১০: লীলা মজুমদার— নতুন রূপকথার হলদে পাখি
এছাড়া ওই অঞ্চলের জঙ্গলটি বিরাপ্পানের নামেই খ্যাত। কোনও কোনও সওয়ারি ঝুড়ি থামিয়ে পারে নেমে ঘুরে ফিরে আসছিল। আমরা নামাওঠার ঝক্কিতে রাজি হলাম না। নামা ওঠায় যেভাবে কাত হয়ে পরে ঝুড়ি, মনে হয় এই বুঝি ডুবলাম। দুর্দম প্রকৃতির সঙ্গে হালকা পলকা জিনিসের খেলা। যতক্ষনণ ব্যালান্স ততক্ষণ মজা। অন্যথায় কি হতে পারে… ভাবলে তো এমন ম্যাডভেঞ্চার করাই যায় না।

ঝুড়ি থেকে নেমে অনেকটা জায়গা জুড়ে মাছের বাজার। মাছওয়ালা ও পাশে কেটেকুটে ভেজে দেবার লোক। পর্যটকরা ঘুরে এসে গরম গরম মাছ ভাজা খাবে তাই। এছাড়াও ওই অঞ্চল থেকে বেরিয়ে ছোটখাট কেনাকাটার দোকান। কাবেরীর জলে ঘোরা ছাড়া হোগেনাক্কাল এ আর বিশেষ কিছু ট্যুরিস্ট আকর্ষণের নেই। সরকারি ট্যুরিস্ট লজের পাশেই এটি। একটি ঝুলন্ত ব্রিজ আছে। ওখানে দাঁড়িয়ে পুরো জায়গার সৌন্দর্যে বুঁদ হয়ে কিছুক্ষণ থাকতে পারেন প্রকৃতি প্রেমিকরা। তবে ক্ষুদ্র মানুষের অসীম ক্ষমতাকে কুর্নিশ। পাপাঙ্গুলের কল্পনার ছাকনিই রূপান্তরিত ঝুড়িতে। আর তায় চেপেই সাগর পাড়ি না হোক উত্তাল জলে প্রমোদ ভ্রমণ।
* পরিযায়ী মন (Travelholic): ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।