পর্যটকদের কাছে নেতারহাট ও বেতলা অতিপরিচিত নাম। জঙ্গল, নদীর অপূর্ব শোভার টানেই সবাই যায়। নেতারহাটকে বলা হয় ছোট নাগপুর মালভুমির রানি। কিন্তু ওখানকার নাশপাতি বাগানের কথা আগে শুনিনি। এ বার সে বাগান ও ফলের প্রাচুর্য দেখে এত অভিভূত হলাম যে নেতারহাটের সঙ্গে তাকে একাত্ম না করে উপায় নেই।
রাঁচি স্টেশন থেকে নেতারহাট বেশ অনেকটা রাস্তা। কিন্তু চমৎকার। কোথাও দু’ ধারে জঙ্গল কোথাও দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। দূরে পাহাড়ের সারি। এ সব দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম নেতারহাট সরকারি পর্যটক আবাসে। পুরোনো নতুন বিল্ডিং মিলে মস্ত জায়গা জুড়ে আবাসন। চারদিকে ফুলের বাগান, লন ইত্যাদি দিয়ে সাজানো গোছানো। বর্ষার শুরু। জুলাই মাসে তেমন গরম নেই। আরামদায়ক আবহাওয়া। পাহাড়ের ওপর শহর বলে। ঘরের বারান্দা থেকে সামনেই দেখা যায় জঙ্গল ও পাহাড়। আকাশ পরিষ্কার থাকলে চমৎকার সানরাইজও দেখা যায়। পর্যটক আবাসের একটি উঁচু চত্বরে লেখা সানরাইজ পয়েন্ট। আকাশ ঘোলাটে থাকায় আমাদের সে সৌভাগ্য হয়নি।
আরও পড়ুন:
পরিযায়ী মন, পর্ব-১১: ঘরের কাছে জলমহল—চাঁদনি জলটুঙ্গি
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?
কাছেই আছে একটি লেক। আর সবচেয়ে সুন্দর লাগলো কোয়েলের দেখা পেয়ে। কোয়েল নদী। পাহাড়ের ওপরে একটা ভিউপয়েন্ট থেকে দেখা যায় এঁকে বেঁকে চলেছে কোয়েল। তাকে দেখার জন্য পাহাড়ের ধারে বনের মাঝে কিছু বাঁধানো বেঞ্চ আছে। মনে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকি। বনের নিস্তব্ধতা ভেঙে দেয় পাখির ডাক। চারদিকে পাইনের বন। জনবসতি নেই।
বিকেলে গেলাম সানসেট পয়েন্টে। মাঠ ঘাটের মধ্য দিয়ে অনেকখানি পথ গিয়ে পাহাড়ের ধারে চমৎকার এক খোলা বাঁধানো চত্বর। বসার জায়গা। কিছু চায়ের দোকান পাট। সূর্যের দিনের শেষের রং ছড়িয়ে পরল পাহাড়ের ওপর, গাছের ফাঁক দিয়ে। সে এক রংয়ের মায়াজাল। সমবেত দর্শকদের আনন্দ কলতানে, চারদিকের ফিকে হয়ে আসা লাল রঙে সূর্যাস্ত হল পাহাড়ের পিছনে। কিছু ছবি বন্দি হল দর্শকের ক্যামেরায়। এখান থেকে যাওয়া যায় লোধ ফলস। কিন্তু বর্ষা ভালো করে তখনও শুরু হয়নি। তাই সেখানে জলধারা শুকিয়ে আছে। এমনটি শুনে আমরা গেলাম না।
আরও পড়ুন:
ইতিহাস কথা কও, পর্ব-১৫: দেবদেউল কথা ও গোসানিমারি কামতেশ্বরী মন্দির
অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-১২: ওই স্মৃতি ভুলতে কি আর পারি…
পরদিন বেতলা যাবার পথে নাশপাতি বাগান দেখাবে বললো ড্রাইভার। পথের ধারেই কিছু নাশপাতি গাছ দেখলাম। ফল ভারে ডাল ঝুঁকে পরেছে। নাগালের মধ্যেই। আমরা তো তাই দেখেই পটাপট ছবি তুলতে লাগলাম। এর চেয়েও বড় চমক যে অপেক্ষা করছে, জানতাম না। গাড়ি থামল নাশপাতি বাগানে। ঢোকার মুখে নাশপাতির পাহাড়। বড় বড় ঝুড়ি ভরে এনে সে পাহাড়ে নাশপাতি ঢালা হচ্ছে। প্রচুর গাছ। ডালে ডালে ভরে আছে ফল। হাত বাড়ালেই পারা যায়। মাটিতে পরে আছে কত নাশপাতি। আমাদের চোখ ছানাবড়া।
গাছের নিচে প্লাস্টিকের চাদর ধরে দাঁড়াচ্ছে দু’জন। আরেকজন গাছে উঠে ঝাকাচ্ছে। ব্যস, ঝরঝরিয়ে নাশপাতি বৃষ্টি চাদরে। একটাই কথা মনে এল, Here is God’s plenty. আমরা অনুমতি নিয়ে (মনে হল না দরকার ছিল বলে) নাশপাতি পেড়ে খেলাম। আসলে নেব কিনা জিগ্যেস করতেই ওরা অবাক হল, মানে জিগ্যেস করার কি আছে? কত তো পড়ে আছে। এরা কেউ খাচ্ছে না। ভাবলাম এ নাশপাতিই তো সুন্দর সাদা জালির জামা পরে ফলের দোকানে উচ্চ আসনে শোভা পায় আমাদের বাজারে। এক দারুণ অভিজ্ঞতা হল নাশপাতি বাগান দেখে।
আরও পড়ুন:
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২১: ওঠো ওঠো রে! বিফলে প্রভাত বহে যায় যে!
ঠাকুরবাড়ির বিজয়া, রবীন্দ্রনাথের বিজয়া
এখান থেকে পৌঁছলাম বেতলা। সরকারি পর্যটক আবাসে। বর্ষায় এ সময় ন্যাশনাল পার্ক বন্ধ থাকে। বাইরে থেকে কয়েকটা হরিণ চরে বেড়াতে দেখলাম। আর সকালে কিছু হাতির দলকে গেট দিয়ে ভেতরে ঢোকাতে দেখলাম। বেতলায় বেশ গরম। কোয়েল ও কেচকি নদী সঙ্গম দেখার মতো। ছোট ছোট নদী। যেখানে মিশেছে একটা পার্ক সেখানে। অনেকটা খোলা জায়গা। বড় বড় গাছ। আর বসার জন্য গোল গোল ছাউনি দেয়া ঘর। প্রচন্ড গরমে নদীর শীতল হাওয়ায় প্রাণ জুড়োলো। নদীর পা ভেজানো জলে নেমে মন ভরে উঠল সবার।পরে শুনেছি এখানে ‘আবার অরণ্যে’ ছবির শুটিং হয়েছিল।
এছাড়া বেতলায় আছে দুটি কেল্লা। জঙ্গলের মধ্যে একটি। ঢুকতে ভয় লাগে। অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে কেল্লার ওপর ওঠা যায়। আমরা সে সাহস করলাম না। তবে পাহাড় জঙ্গলের মধ্যে পরিত্যক্ত প্রাচীন কেল্লা মনে এক গা ছমছম করা সম্ভ্রম জাগায়। আরেকটি কেল্লা পাহাড়ের ওপর। দূর থেকে দেখলাম। সঠিক সময় না যাওয়ায় জঙ্গলে ঢোকা ও সাফারি ইত্যাদি করা গেল না। কিন্তু বর্ষায় জঙ্গলের যে অপূর্ব শোভা সেটি কিছু কম নয়। সবুজ বনানী, বিস্তীর্ণ প্রান্তর আর পাহাড়—সব মিলে এক পরিপূর্ণতার ছবি।
ছবি: লেখিকা
ছবি: লেখিকা
* পরিযায়ী মন (Travelholic): ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।