রবিবার ৬ অক্টোবর, ২০২৪


বিপুলা এ হিমালয়ের কত টুকু চিনি, জানি। এর খাঁজে খাঁজে আছে প্রকৃতির কত বিস্ময়। এক নেশা ধরানো সৌন্দর্যে হিমালয় সব সময় হাতছানি দেয়। ক্রমাগত নতুন, নতুন জায়গা, নতুন নতুন হোমস্টের সন্ধান পাই। বেশ কয়েকবছর আগে। তিনচুলের গুরুং হোমস্টের সন্ধান পেলাম। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে গাড়িতে প্রায় সত্তর কিলোমিটার। তিন ঘণ্টার মতো লাগলো। রাস্তার পাশেই হোমস্টে। ওপর থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। একটু নেমে দেখলাম বেশ বড়সড় এক বাড়ি। পাহাড়ের ঢালে। বারান্দায় বসলেই সামনে মৌন মহান পাহাড় চূড়া।
আমাদের পৌঁছতে একটু বেলা হয়ে গিয়েছিল। অতিথি বৎসল গুরুং পরিবার ব্যস্ত হয়ে উঠলো। ঝকঝকে কাঁসার থালায় গরম ভাত, ঘি মাছভাজা, আরও সব আনুষঙ্গিক। পাহাড়ে বসে, কাঁসার থালায় ঘি মাছ ভাজা! বাঙালির রসনার পছন্দ এখানকার লোক ও ভালো করেই জেনে গিয়েছে। তৃপ্তি তো হলো ই মন ও ভরে উঠলো বেড়ানোর শুরুতেই।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-১৪: কুর্গের সবুজ দুর্গ

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৬: বুকে ব্যথা মানেই কি গ্যাসের ব্যথা? হার্ট অ্যাটাকের উপসর্গ না কি গ্যাসের ব্যথা, বুঝবেন কী ভাবে?

তিনচুলে পাহাড়ের কোলে ছোট একখানি গ্রাম। নিজের সৌন্দর্যেই সুন্দর। আঁকা-বাঁকা পথ, পাইনের বন, কমলা লেবুর খেত, চা বাগান। পায়ে পায়ে এগুলো ঘুরে বেড়ালেই মন ভরে ওঠে। আর বারান্দায় বসে সামনের পাহাড়, জঙ্গল আর নানা রকম পাখির ডাক শুনে ও সারাদিন পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। সামনেই আছে একটা মনাস্ট্রি। জঙ্গলের মধ্যে। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে হয়। একটু এগোলে আছে সানরাইজ ভিউ পয়েন্ট। একটু উঁচুতে উঠে বাঁধানো গোল চত্বর। সামনের পাহাড়ের পিছন থেকে সূর্যোদয় পরিষ্কার দেখা যায়।
পাহাড়ের মাঝেই আবার খেলার মাঠ। একদিন দেখলাম দুটো গ্রামের ফুটবল ম্যাচ হচ্ছে। এপাশ ওপাশে উঁচু নিচু জায়গায় দুই গ্রামের লোকজন বসে গিয়েছে। মহিলারা বড় ফ্লাস্কে করে চা ও নিয়ে এসেছেন। ছোট মাঠ। বিরাট উত্তেজনা। আমরাও পাহাড়ের কোলে প্রকৃতির গ্যালারিতে বসে তার ভাগ নিলাম।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৩: অকালে খেয়েছ কচু, মনে রেখো কিছু কিছু

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৮০: পয়লা মাঘে সরস্বতী নদীর পাড়ে ৫০০ বছরের জমজমাট মাছ মেলা কখনও দেখেছেন?

তিনচুলে থেকে কাছে ই লামাহাটা। এটি সর্বজনবিদিত একটি পার্ক। টিকিট কেটে ঢুকলাম। পাহাড়ের ঢালে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত অপূর্ব সব গাছ ও ফুলের সমারোহ। মাঝে মাঝে গোল গোল বসার শেড। অনেকটা জায়গা জুড়ে। আবার সিঁড়ি দিয়ে অনেকটা ওপরে উঠে এক ভিউ পয়েন্ট ও আছে। পাইনের ছায়াঘেরা রং-বেরঙের ফুলে ভরা এক চমৎকার দর্শনীয় পার্ক। আশপাশের সব ট্যুরিস্টরাই এখানে আসেন। লামাহাটার কাছে কিছু হোমস্টে ও আছে শুনেছি।
তিনচুলে থেকে এরপর গেলাম লেপচাজগত। ফরেস্ট এর গেস্ট হাউসে ঢোকার পথে মেঘেদের ছুটোছুটি দেখলাম। আমাদের জামাকাপড় স্যাতসেতে হয়ে উঠলো। ভারী মজা লাগলো মেঘেদের মধ্য দিয়ে যেতে। চমৎকার জায়গায় গেস্ট হাউসটি। বড় কাঁচের জানালার পর্দা সরালেই কাঞ্চনজঙ্ঘা।সকালে কাঁচ ধোঁয়াটে হয়ে উঠলো। মুছে দিয়ে খাটে বসেই সূর্যোদয় দেখলাম। সাদা বরফে নরম গোলাপি আভা আস্তে আস্তে লাল হয়ে উঠলো। পাহাড়ের পিছন থেকে ছোট্ট লাল সূর্য বেরিয়ে এলো। রঙের খেলা বরফের চূড়ায়। এমন আরামে ঘরে বসে সূর্যোদয় কোথাও দেখেছি বলে মনে পরে না।
চারদিকে পাইনের বন। পাইনের বনের ঢাল পেরিয়ে ওপরে একটি সুন্দর পার্ক। বিকেলে সেখানে গেলাম। ছোট ছোট ফুলগাছ, দোলনা, বসার জায়গা রয়েছে। সামনেই আছে আকাশে হেলান দেয়া পাহাড়ের সারি। অনেকটা সময় সে নির্জনতায় বুঁদ হয়ে রইলাম। সূর্যাস্তের রঙিন আলো ছড়ালো পাহাড় চূড়ায়। সূর্য ডুবলো পাহাড়ের আড়ালে।আমরাও তাড়াতাড়ি নেমে এলাম গেস্ট হাউসে। কেয়ারটেকার পরম যত্নে গরম গরম খিচুড়ি ও পাঁপর ভাজা খাওয়ালেন রাতে।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২২: সুন্দরবনে গোয়াল পুজো আর ‘ধা রে মশা ধা’

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২০: পাঁচ ভাইয়ের বড়দিদি

লেপচা জগৎ থেকে ঘুরে আসা যায় জোড়পোখরি। দু’ধারে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চা বাগান পেরিয়ে অনেকটা উঁচুতে।জোড়া হ্রদ। এখানে একটি অভয়ারণ্য রয়েছে। একটি হ্রদের মধ্যে আবার এক মস্ত কালীয়নাগ বানানো রয়েছে। জলাশয় দুটি চমৎকার। বাঁধানো। বসার জায়গাও আছে ধারে। বেশ কিছু পাখপাখালির দেখা মিললো। হাঁস তো রয়েছেই। মস্ত পাইন গাছ রয়েছে হ্রদ ঘিরে। ছোট ছোট কিছু ফুলগাছ ও রয়েছে। কিন্তু লোকজন বেশি দেখলাম না। এত উঁচুতে সাজানো গোছানো সুন্দর দুটি ছোট জলাশয়। একে ঘিরে হয়তো অনেক কিছুই করা যেত। জানি না, কেন এত নির্জন। আশে পাশে দোকান পাট বাড়ি ঘর বিশেষ কিছু নেই। হোমস্টে আছে একটু দূরে। নীল আকাশের সাদা মেঘের ছায়া পরছে জোড়পোখরির জলে।অনেকটা জায়গা জুড়ে বড় বড় গাছ। উপভোগ্য নির্জনতায় খানিকটা সময় কাটিয়ে নেমে এলাম। লেপচাজগৎ-এ।
হিমালয়ের কোলে,আলো ছায়ায় ঘেরা ছোট্ট দুটি গ্রাম লেপচাজগত ও তিনচুলে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়া এখানকার মানুষের আন্তরিক সাহচর্য ও আতিথেয়তা পর্যটকদের মন কেড়ে নেবেই। এ আমার দৃঢ় প্রত্যয়।

ছবি: লেখিকা
* পরিযায়ী মন (Travelholic): ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content