শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


গ্রামের নাম চটকপুর হলেও জমকালো কোনও চটক নেই। পাহাড় ঘেরা ছোট্ট এক জনপদ। জনসংখ্যা একশো হবে। অল্প কয়েটি পরিবার থাকে। কাঞ্চনজঙ্ঘার কোলে ছোট্ট একটি গ্রাম। ঢোকার পথে একটা বাঁধানো তোরণ। লেখা ইকো ভিলেজ চটকপুর।
দার্জিলিং থেকে বেশি দূর নয়। দু’ তিন দিক দিয়ে যাওয়া যায়। তবে বেশ খানিকটা রাস্তা খুব খারাপ। ফরেস্ট এর মধ্য দিয়ে উঁচু নিচু পথ। অনেকটা সময় লাগে পৌঁছতে। আমরা বিকেল হয়ে গেল বলে সে রাস্তায় না গিয়ে দার্জিলিং থেকে গেলাম রাতটা। দার্জিলিং থেকে সোনাদা হয়ে গেলাম। সেঞ্চল ফরেস্টের মধ্য দিয়ে পথ। ঢোকার মুখে পারমিশন করতে হয়। ফরেস্টের মধ্য দিয়ে যাবার পথে ভাগ্য প্রসন্ন হলে রেড পান্ডা বা হরিণ দেখা যায়। যদিও আমাদের ভাগ্য প্রসন্ন ছিল না। পথ খারাপ বলে দূরত্ব কম হলে ও পৌঁছতে সময় লাগে।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-৯: সাসারামের ঝর্ণাধারা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৭: সুন্দরবনের শিশুরক্ষক পাঁচুঠাকুর

ইকো ভিলেজ লেখা তোরণ পেরিয়ে প্রথম হোমস্টেটিতেই বুকিং ছিল আমাদের। ধনমায়া হোমস্টে। দৃষ্টিকে একপাক দিলেই পুরো গ্রামটি দেখা যায়। সব বাড়িরই প্রায় লাল ছাত। পাহাড়ের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত। সবুজের কোলে লাল। কাঁচা রাস্তা এঁকেবেঁকে গিয়েছে। আর রয়েছে অজস্র পাইন গাছ। আমাদের হোমস্টের ঠিক সামনে বনদপ্তরের গেস্ট হাউস। একই রকম দেখতে বাইরে থেকে। হোমস্টের মালিকই গাড়ি চালিয়ে নিয়ে এসেছে আমাদের। তার বউ ছেলে সবাই মিলেই এটা চালায়। জানলাম চটকপুরের বেশিরভাগ পরিবারেরই এই ব্যবসা। সঙ্গে পশুপালন ও ছোটখাট চাষবাসই এদের জীবিকা।
হোমস্টের সামনে ছোট্ট বাগান। ঘাসের মাঝে রং বেরঙের ফুল ভরে আছে। রঙিন কার্পেট যেন। আবার ঘাসের ডগায় তুলোর বলের মতো সাদা সাদা ফুল। ছিঁড়ে নিয়ে ফুঁ দিতে বুড়ির চুলের মতো হাওয়ায় ভেসে গেল ছোট ছোট সাদা তুলো। যেন এক মজার খেলা ছোটবেলাকে ফিরে পাওয়ার। আমাদের একটা কটেজ। পিছন দিকে। তার জানলা খুললেই মস্ত পাইনের বন। বনের অন্ধকার ফুঁড়ে সূর্যের আলো মাঝে মাঝে তির্যক দৃষ্টি ফেলছে। তবে আকাশ খুব পরিষ্কার নয় বলে কাঞ্চনজঙ্ঘা মেঘের আড়ালে। শুনেছিলাম এখান থেকে মস্ত রেঞ্জ দেখা যায়। কিন্তু আমরা একটু অসময়তেই গিয়েছি। তাই কপাল মন্দ।
আরও পড়ুন:

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-৯: আহা, মরি—কেটেলবেরি

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫০: স্বপ্নের ‘যাত্রা হলো শুরু’

কিন্তু এ ছোট্ট গ্রামটি বড় আপন মনে হল। নিজেদের বাড়িঘরের মতো। দোকান পাট, জাঁকজমক, পার্ক, লেক বোটিং কিছুই নেই। শান্ত নিরিবিলি কয়েকটি পরিবার ও তাদের আতিথেয়তা। সব বাড়িরই সামনে ফুলের কার্পেট, একটু সব্জি বাগান। পাহাড়ের ধাপ ও চাষের জায়গার ধার দিয়ে ওপরে উঠে গেলাম। ওপর থেকে দেখা যায় পাহাড়ের পাঁচিল ও পাইনের জঙ্গল।
আমাদের হোমস্টে থেকে একটু এগিয়ে একটি পাইনের বন। মাঝখানে বড় বড় পাথর। প্রকৃতির নিজের বানানো পার্ক। পাথরে বসে বসে আড্ডা মারা যায়। আবার বনের মধ্য দিয়ে অনেকটা নীচে চলে যাওয়া যায়। সব ট্যুরিস্টরাই ওখানে ঘুরতে যাচ্ছে। ওখান থেকে বেড়িয়ে খানিকটা হেঁটে এগিয়ে গেলাম। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে রাস্তা। কালিপোখড়ি পৌঁছে গেলাম। ছোট্ট একটি ডোবা। কালো জল। মাঝখানে এক মস্ত পাথর। রং বেরঙের ছোট ছোট পতাকা দিয়ে সাজানো। ওই অঞ্চলের কোনও দেবতার থান। চারদিকের গভীর জঙ্গলের মধ্যে লুকোনো কালি পোখড়ি। সুন্দর লাগলো। ছবি তুললাম অনেক।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৯: সত্য কাজে কেউ নয় রাজি সবই দেখি তা না না না?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬১: চাষাবাদ নিয়েও রবীন্দ্রনাথ ভেবেছেন

ঘন জঙ্গলের স্তব্ধতা ভেঙে দেয় পাখির ডাক। কাঞ্চনজঙ্ঘার সামনে এক মেঘের আস্তরণ। মনে আশা একসময় নিশ্চয়ই ঘোমটা খুলবে। কিন্তু খুলল না। তাই সোনার বরণ কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা হল না। দুঃখ নেই তায়। কাঞ্চনজঙ্ঘা তো কতবার হিমালয়ের কত জায়গা থেকে দেখেছি। এমন সুন্দর গ্রাম খানি কোথাও দেখিনি। প্রাচুর্য ও কোলাহলের বাইরে। পাহাড়ের গা এর রাস্তা দিয়ে হাঁটলাম অনেক।
ছুটে ছুটে দেখার মতো কোন বিশেষ জায়গা নেই এখানে। একটু দূরে আছে সিঞ্চল ফরেস্টে স্যানকচুয়ারি। নতুন ধরনের জীব জন্তু আছে শুনলাম সেখানে। আর আছে হাট। যেখানে শুধু আদানপ্রদানের জন্য গ্রামের লোকেরা জড়ো হয়। নইলে ক্রেতা কোথায়? নিজেদের মধ্যেই কেনাবেচা চলে।

সভ্যতার কৃত্রিমতার বাইরে শুধু প্রকৃতির দেওয়া সৌন্দর্যতে যারা বুঁদ হয়ে থাকতে চান তেমন ট্যুরিস্টদের জন্য চটকপুর। যারা বিশুদ্ধ বাতাস, নিস্তব্ধতা আর প্রকৃতির আন্তরিক আলিঙ্গনে ধরা দিতে চান তাদের জন্য চটকপুর। শহরে আবদ্ধ মানুষের জন্য—To one who has been long in city pent-দের জন্য।

ছবি: লেখিকা।
* পরিযায়ী মন (Travelholic): ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content