শনিবার ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫


পূর্ব বর্ধমানে এমন চমৎকার একটি জলমহল ও পর্যটকদের থাকার আয়োজন আছে এমনটি অনেকেই জানেন না। প্রায় তিনশ বছর আগের ইতিহাসের সাক্ষী এই জলটুঙ্গি। মহারাজা কীর্তিচন্দ্র তার রানির জন্য রাজস্থানের জলমহল এর আদলে বানিয়েছিলেনেই জলটুঙ্গি। ঝিলের মাঝে ঘর। অসামান্য সুন্দরী রানি দুই হাতের মাঝে জল নিয়ে চাঁদের ছবি ধরতেন। তাই চাঁদনি জলটুঙ্গি। এমনটিই প্রচলিত গল্প।
নিকটবর্তী রেল স্টেশন গুসকরা। আট কিলোমিটার দূরে। সেখান থেকে অটো ইত্যাদিতে আসা যায়। এটি পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামে। আমরা গাড়িতেই গিয়েছিলাম। পর্যটকদের জন্য সদ্য তৈরি হয়েছে থাকার জায়গা। তাই পর্যাপ্ত কটেজ নেই। তিনটি মাত্র দুই শয্যা বিশিষ্ট কটেজ। আরেকটি চারজন থাকার মতো বারান্দা সমেত ঘর। কটেজগুলো ভারী সুন্দর দেখতে। গোল গোল লাল রঙের। খড়ের ছাদ। কিন্তু ভিতরগুলো পুরোপুরি আধুনিক সব সুযোগসুবিধা বিশিষ্ট। গ্রামের রাস্তা পেরিয়ে মস্ত লোহার গেটে পৌঁছলাম। অনেকটা জায়গা। খানিকটা লন। পেছনে জলটুঙ্গি। লনের মাঝে এক মস্ত পাথরের হাতি। হাতির পিঠে চড়া এক মূর্তি। বড় গার্ডেন আমব্রেলার নীচে চা খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। এখানকার কর্মচারীদের আতিথেয়তা মনে রাখার মতো। তখনও পরিপূর্ণ ভাবে গড়ে ওঠেনি আবাসটি। অনেক কিছুই চাহিদা মতো হয়তো হয়ে ওঠেনি। এতদিনে নিশ্চয়ই সেগুলো পূরণ হয়েছে। কিন্তু এদের আন্তরিকতা ও আপ্যায়নে এমন এক উষ্ণতা ছিল যে মন ভরে উঠল।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-১০: চটকপুরের নিরালায়

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৮: সুন্দরবনে বিচিত্র অবয়বের দেবতা জ্বরাসুর

এখানকার আসল সৌন্দর্য্য রাতের বেলা। ঝিলের ওপর দিয়ে জলটুঙ্গি যাবার পথটিতে আলোর মালা ঝলমলিয়ে উঠলো। ঝিলের চারদিকে ছোট ছোট টুনি লাইটের আলো জ্বলে উঠলো। রাতের নিকষ আঁধারে সে এক অপার্থিব শোভা। যেন এক হিরের খণ্ড থেকে আলো ঠিকরে পরছে আঁধার রাতে, ঝিলের জলে। ঝিল টির চারদিক বাঁধানো। অনেকটা রাজস্থানের স্টেপ ওয়েল এর মতো। পায়ে পায়ে ঘুরে আসা যায় চারদিক। আমরা মাঝের পথ দিয়ে জলটুঙ্গিতে গেলাম। সুন্দর রাধাকৃষ্ণের মূর্তি আছে সেখানে। আর রাজার নামের ফলক। অন্ধকারে ঝিকমিক করে জোনাকির আলো।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২০: অক্টোবর মাসের ষোলো, কী হল! কী হল?

ইতিহাস কথা কও, পর্ব-১৪: মধুপুর ধাম, বাণেশ্বর মন্দির ও ধলুয়াবাড়ি সিদ্ধ নাথ শিবমন্দির

সকালে জলটুঙ্গির আবাসের চৌহদ্দির বাইরে বেরিয়ে গ্রাম ঘুরে, প্রান্তর ঘুরে এলাম। পিছন দিকে মস্ত প্রান্তর। বড় বড় গাছের সারি। খানিকটা এগিয়ে এক মন্দির। বেশ বড় মাটির নিকোনো আঙিনা। ছায়া ঘেরা। যেন একখানি ছবি। সকালের খাবার খেয়ে গাড়িতে গেলাম কাছেই ডোকরা গ্রামে। গ্রাম বলতে একটা গেট দিয়ে ঢুকে একটা বাঁধানো চত্বর। সেখানে ডোকরা শিল্পীরা পসরা নিয়ে চলে আসেন ক্রেতারা এলেই। পরে দেখলাম পিছন দিকে কয়েকঘর ডোকরা শিল্পীর বাস। গেট দিয়ে ঢুকেই ডান হাতে ছোটখাট ইটভাটার চুল্লির মতো চুল্লি। ধোঁয়া বেরোচ্ছে। ডোকরা খুব প্রাচীন শিল্প। প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগের। খুব পরিশ্রম সাপেক্ষ। ধাপে ধাপে নানারকম জিনিসের প্রলেপ দিয়ে কাঠামো বানিয়ে তারপর তাকে ফুটো করে ভিতরে পিতল গলা ঢেলে আগুনে দেয়া হয়।

এত পরিশ্রমের কি করে সঠিক দাম হয় ভেবে পেলাম না। শিল্পীদের পরিবারের সবাই হাত লাগায়। পারিশ্রমিক যে কিছুই প্রায় মেলে না, তা এদের অবস্থা দেখলে বোঝা যায়। আমরা যাওয়াতে সবাই যার যার পসরা নিয়ে চলে এলো। একজন সঠিক সময় জানতে পারেনি। পরে এসে খুব পীড়াপীড়ি করতে লাগলো একটা কিছু অন্তত কেনার জন্য। মহিলারাই বিক্রি করছেন। আমরা কিছু কেনাকাটা করলাম। ডোকরার নানা দেবতার মূর্তি, প্যাঁচা, গয়না। খুব সুন্দর।
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-১১: কার মন ভোলাতে এলে তুমি আজ…

যত মত, তত পথ: পর্ব-৮: আনন্দের ফেরিওয়ালা

আমরা দু’দিন ছিলাম জলটুঙ্গি তে।মস্ত বড় থালার চারদিকে বাটি সাজিয়ে যত্ন করে নানা উপাদেয় খাবার খাইয়েছেন ওরা। ফেরার সময় খাওয়া দাওয়ার পর ওখানকার কর্মীরা ওদের বাগানের অনেক সবজি দিয়ে দিলেন। যেন বাড়ির লোক চলে যাচ্ছে। ওদের আন্তরিকতা ভোলার নয়।

জলটুঙ্গির খুব কাছেই আছে আল্পনা গ্রাম।বাড়ি ফেরার পথে সেটি দেখে আসব,এমন ই পরিকল্পনা ছিল। এটি ও সকলের কাছে এক বিস্ময়। চমৎকার পিচঢালা রাস্তা, দু’ধারে শাল পিয়ালের জঙ্গল। আবার পদ্মপুকুর ও পথের ধারে। সেখান দিয়ে পৌঁছে গেলাম আল্পনা গ্রাম। সমস্ত বাড়ির দেয়াল ভরে অসাধারন সব আঁকা। পুরো গ্রামটাই একটা ক্যানভাস। দেবদেবীর মূর্তি,পুরান কাহিনি, মনীষীর মূর্তি। দক্ষ হাতের টানে,অপূর্ব রঙে প্রাণবন্ত। একটু ভেতরে আছে অন্নপূর্ণার মন্দির। দোতলা। সেখান থেকে আঁকার শুরু হয়েছিল জানলাম। পুরো মন্দিরটি তে দেয়াল ভরে সব ছবি। ছায়া সুনিবিড় গ্রামের এক আশ্চর্য ঐশ্বর্য। দূর দূর থেকে অনেক শিল্পীরা এখানে এসে এঁকে গিয়েছেন। অনেক আঁকার নীচে তাদের নাম ও লেখা। এমন সম্পদে ধনী গ্রাম দেখে মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি আসে। মন গেয়ে ওঠে “চাই না মা গো রাজা হতে”।

ছবি: সংগৃহীত।
* পরিযায়ী মন (Travelholic): ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content