মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


রাতে আলোতে ঝলমলে আইফেল টাওয়ার।

নেদারল্যান্ডসের এই শহরে যে ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউভিয়াইটিস স্যোসাইটি’-র মিটিং হবে এমন কথা ছিল না। ঠিক ছিল সিঙ্গাপুরে ২০২০ সালে কনফারেন্স হবে। তখন কে জানতো কোভিড এসে সারা দুনিয়ার সব পরিকল্পনা উলটে পালটে দেবে। সর্বত্র শুরু হয়ে গেল ভার্চুয়াল মিটিং। কিন্তু দুধের স্বাদ কি আর ঘোলে মেটে? তাই ২০২১ সালে কোভিড কমতেই ঠিক হল ২০২২ সালের আগস্টে হাইব্রিড মিটিং হবে নেদারল্যান্ডসের ছোট্ট শহর ইউট্রেকটে। কী করে যাবেন ইউট্রেকটে? ইউট্রেকটে কোনও এয়ারপোর্ট নেই। আপনি নেদারল্যান্ডসের
রাজধানী আমস্টারডামে নেমে ট্রেনে করে সাতাশ মিনিটে পৌঁছে যাবেন ইউট্রেকটের সেন্ট্রাল স্টেশনে। আমস্টারডামে আসা কঠিন নয়। চেন্নাই থেকে দুবাই, দুবাই থেকে আমস্টারডাম। খুব সহজ উপায়। আমার হাসপাতালের সহকর্মী পার্থ ঠিক তাই করেছিল। আমরা ঠিক করলাম আমরা যদি যাই, তবে যাবো সপরিবারেই। না, পতির পূণ্যে সবসময় সতীর পুণ্য হয় না।

নেদারল্যান্ডসের কথা ভাবতেই উইন্ডমিলসের ছবি ভেসে আসে। ঠিক হল আমরা তিনজনই যাবো। মানে আমি, নিঃসন্দেহে আমার বেটার হাফ শুভ্রা ও কন্যা সুমেধা। প্রথমে ঠিক ছিল আগে যাবো নেদারল্যান্ডসে। ওখান থেকে প্যারিস হয়ে ফিরবো। আমার শ্যালক প্যারিসেই থাকেন। তাই কোনও অসুবিধাই নেই। ওঁর জন্মদিন ছিল ১৮ আগস্ট। তাই ঠিক হল আমরা প্রথম প্যারিসেই যাবো। ১৩ আগস্ট রাতে মানে ১৪ তারিখ ভোরবেলা চেন্নাই থেকে এয়ার ফ্রান্সে সোজা প্যারিস। সরাসরি বিমান। সময় লাগবে প্রায় দশ ঘণ্টা। ভাগ্যিস এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম। যাঁরা নেদারল্যান্ডসের জন্য ভিসার আবেদন করেছিলেন তাঁদের ভিসা পেতে একমাস লেগে গিয়েছিল। দু’জন তো ভিসা পেলেন কনফারেন্স শুরু হয়ে যাওয়ার পর। সাতদিনের মাথায় ফ্রান্সের ভিসা এসে গেল। এই ভিসায় ইউরোপের প্রায় সব দেশেই যাওয়া যাবে। কিন্তু যখন সব গোছগাছ করে ‘ওয়েব চেক-ইন’ করতে যাবো, তখন দেখলাম আমার নামের বানান টিকিটে ভুল আছে। জ্যোতির্ময়ের জায়গায় জ্যোতিময়, ‘র’ বাদ পড়ে গিয়েছে। ভয়ংকর বিপদ! এয়ারপোর্টে সিকিউরিটি চেকের সময়ই তো আটকে দেবে, তারপর তো চেক-ইন, ইমিগ্রেশনের কথা তো ছেড়েই দিলাম। ভীষণ চিন্তার বিষয়! তিনটে বড় ব্যাগ, দুটো ছোট ব্যাগ আর সঙ্গে একমাথা টেনশন নিয়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম। মায়ের আশীর্বাদে অসুবিধা হল না। ভয়ে কাঁটা হয়ে ছিলাম।

নরমান্ডির ফুলে ঘেরা রাস্তা।

এয়ার ফ্রান্স তেমন আহামরি কিছু না। এয়ার হোস্টেসরা ঠিক কাকিমার বয়সী। খাবারও তেমন হতচ্ছাড়া। শুধু ভেজিটারিয়ান খাবার। প্লেনে একটু ঘুমিয়ে নিলাম। প্যারিসের চার্লস ডি গল এয়ারপোর্টে যখন পৌঁছলাম তখন সকাল সাড়ে আটটা। দাদা দাঁড়িয়েছিল এয়ারপোর্টের বাইরে। পাঁচটা ব্যাগ কোনওক্রমে ঢুকে গেলো দাদার গাড়ির ডিকিতে। দাদার ইলেকট্রিক গাড়িতে এক ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম ওয়াহালানে। ওয়াহালন প্যারিস শহর থেকে একটু দূরে। তবে জায়গাটা খুবই সুন্দর। আলাদা আলাদা বাড়ি বাগান-সহ। দাদার বাড়িতে আবার সুইমিং পুলও আছে। দুটো গেস্ট রুমে আমাদের সুন্দর জায়গা হয়ে গেল। দুপুরে ভাত, সালমন মাছের ঝোল খেয়ে দারুণ ঘুম দিলাম। এয়ার ফ্রান্সের শুকনো খাবার খাওয়ার পরে এসব যেন অমৃত মনে হল। পরের দিন নিখাদ বিশ্রাম। তারপর ঠিক হল সন্ধ্যাবেলা আইফেল টাওয়ার দেখতে যাওয়া হবে।
কিন্তু বিকেল হতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। বৃষ্টি মানে ভালোমতো বৃষ্টি। যখন আইফেল টাওয়ার দেখার আশা ছেড়েই দিয়েছি, তখন বৃষ্টি থেমে রোদ্দুর উঠল। আমরা ওয়াহালন থেকে রওনা হলাম প্যারিস শহরের দিকে। রাস্তায় মাঝে মাঝেই জল জমে গিয়েছে। গ্রেনেলে দাদার একটা ফ্ল্যাট আছে, ২৯ তলায়। সেখান থেকে আইফেল টাওয়ার স্পষ্ট দেখা যায়। রাত্তির নটার পর থেকে প্রতি এক ঘণ্টা অন্তর লেজার লাইট শো হয়। সত্যি দেখার মতো। এই টাওয়ার কেন তৈরি হয়েছিল সেটা আমার জানা নেই।
রাত দশটা। সব রেস্টুরেন্ট বন্ধ হতে চলেছে। শেষ অবধি আমরা একটা পিৎজার রেস্টুরেন্ট পেয়ে যাওয়া মাত্রই তাতে ঢুকে পড়লাম। পিৎজা তো ভালোই ছিল, কিন্তু তার থেকে ভালো ছিল যাঁরা খাবার পরিবেশন করছিলেন তাঁরা। নাচতে নাচতে পরিবেশন করছিলেন। একটা খুশি খুশি ভাব এনে দিলেন খাবারের সঙ্গে। প্যারিসে আমরা আইফেল টাওয়ার ছাড়া আর কিছু দেখছি না এবার। মিউজিয়াম দেখেছি আগের বার। আমরা যাবো নরম্যান্ডি। প্যারিস থেকে ৩৮৭ কিলোমিটার দূরত্ব। এই নরম্যান্ডিতেই ১৯৪৪-এ জার্মানির সঙ্গে কোস্টলাইনে ঐতিহাসিক যুদ্ধ হয়। ৬ জুন আমেরিকা এবং ব্রিটিশ সেনা প্যারাসুটে করে নামে। ওমাহা, গোল্ড, জুনো আর সোরড বিচ দখল করে নেয়।

গোল্ড বিচের কাছেই আমার দাদার বেশ বড় বাড়ি। সেখান থেকে সন্ধ্যাবেলা গোল্ড বিচে হেঁটেই গেলাম। এখন ট্যাঙ্ক পড়ে আছে। সেখানে ক্লিফের পিছনে সূর্য ডোবার দৃশ্য অসাধারণ। আইপ্যাডে ধরে রাখলাম সেই ছবি। নরম্যান্ডি সত্যি খুব সুন্দর। রাস্তার পাশে শুধু ফুল আর ফুল। পরদিন ওয়ার মেমোরিয়াল দেখতে গেলাম। এখানে বাইশ ফুট উঁচু আকাশের দিকে ওঠা কালো পাথরের ‘স্ট্যাচু দ্য স্পিরিট অফ অ্যামেরিকান ইউথ রাইজিং ফ্রম দ্য ওয়েভস’ এক কথায় অপূর্ব। এই বিশাল মূর্তির সামনে কিছুক্ষণ না দাঁড়য়ে থাকা যায় না। দু’পাশে ম্যাপে দেখানো আছে যুদ্ধ কীভাবে হয়েছিল। ইতিহাস যেন কথা বলছে। একটু দূরে সারি সারি অসংখ্য সাদা ফলক। তাতে খোদাই করে লেখা আছে মৃত সৈনিকদের নাম, যাঁরা সেদিন জীবন দিয়েছিলেন। ওমাহা বিচ খুব সুন্দর। নীল সমুদ্র, তাকে ছুঁয়ে আছে মেঘ ভরা আকাশ। আমরা দুপুরবেলা বিচের পাশে একটা রেস্টুরেন্টে খেলাম। এখানে বিচ ফ্রন্ট রেস্টুরেন্টে জায়গা পাওয়া খুব মুশকিল। ভাগ্যক্রমে পেয়ে গেলাম একটা। সামনে নীল সমুদ্র, মিষ্টি রোদ্দুর। আমরা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই দিয়ে শুরু করলাম। আমি একটা বিশাল কাঁকড়া নিলাম।

নরমান্ডির বিকেলে অসাধারণ সূর্যাস্ত।

এত বড় কাঁকড়া জীবনে খাইনি। কাঁকড়াটা ভাঙার জন্য একটা সাঁড়াশিও দেওয়া হল। দাদা নিল এক বালতি শামুক, এরা শামুককে মাসল বলে। এটা নাকি এখানকার ডেলিক্যাসি। তিনদিন নরম্যান্ডিতে থেকে প্যারিসে ফিরলাম দাদার ইলেকট্রিক গাড়িতে। রাস্তাও খুব সুন্দর। তিন ঘণ্টার মতো সময়ে পৌঁছে গেলাম প্যারিসে।

একদিন পর প্যারিস থেকে ইউট্রেকট যাবো। যাবো দূরপাল্লার ইনটারস্টেট ট্রেনে। যাবার আগের দিন আমার দাদার ছেলে ননির বাড়িতে ছিল গেট টুগেদার। ননির বউয়ের নাম এলোডি। সে হাফ ইজিপ্সিয়ান। সে হাফ প্যান্ট পরে বেশি। ইলেকট্রনিক সিগারেট খায়। ওদের দুটো বিচ্ছু মেয়ে আছে। বড়র নাম ইলাইয়া, ছোটটার নাম নিলা। ওরা ফ্রেঞ্চ ছাড়া কিছু বোঝে না। কিন্তু তা হলে কি হবে, ওরা টিভিতে ইউটিউবে হিন্দি গানের সঙ্গে নাচতে ভালোবাসে। গান চলছিল সেই “দোলা রে দোলা”, “কাজরা রে, কাজরা রে” আর তার সঙ্গে নাচছিল ননির ছোট্ট দুটো মেয়ে।

নরমান্ডির গোল্ড বিচে পডে থাকা পুরোনো ট্যাঙ্ক।

আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৭: রান্নাবান্নার ঠাকুরবাড়ি

তুষারপাতের সেই দিনগুলি, পর্ব-৮: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মোড়া উইসকনসিনে মন খারাপের কোনও অবকাশই নেই

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪: কবে আসবে তুমি মননের সে ‘সহযাত্রী’? [০৯/০৩/১৯৫১]

ছোটদের যত্নে: বাচ্চা খেতেই চায় না? কী করে খিদে বাড়াবেন? কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন? জানুন শিশু বিশেষজ্ঞের মতামত

দ্য স্পিরিট অফ অ্যামেরিকান ইয়োথ রাইসিং ফ্রম দা ওয়েভস।

ননির নাইকের জুতো জমানোর শখ। কিন্তু তা বলে সংখ্যাটা যে দুশোর বেশি হবে সেটা ওদের বাড়ির বেসমেন্টের ঘরে গিয়ে দেখে বিশ্বাস হল। ননির বাড়িতে সেদিন বারবিকিউ ছিল। কিন্তু তা হতে এত দেরি হচ্ছিল যে আমি তার মধ্যে প্রায় এক বোতল কোক জিরো শেষ করে ফেললাম। ওদের পোষা একটা বিড়াল আছে। নাম টুইনি। তার জন্য ছোট্ট একটা ঘর অবধি আছে। এখানে অনেকেই পোষ্য রাখেন। এরা তাঁদের সঙ্গে খুব অ্যাটাচড। দাদারও একটা কুকুর আছে। এদের কুকুর বলা জায় না সেই অর্থে। এরা থাকে বাড়ির একজনের মতো। তাদের জন্য ছোট বিছানা আছে, আছে কারনেল, আছে বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা। সকালে বিকেলে তাদের নিয়ে বাইরে হাঁটতে যাওয়া একটা বিশাল কাজ। আমার মনে আছে, ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে একটা কুকুর ছিল। তার নাম ছিল ভোলা। তাকে মা খাবার পরে যা এঁটোকাঁটা পড়ে থাকতো তাই দিতো। তারা বাইরেই থাকতো বেশির ভাগ সময়। সন্ধেবেলায় শাঁখ বাজার সময় সেও ডেকে উঠতো।
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব- ১: রামায়ণী কথামুখ — শোক থেকে শ্লোক…

গৃহিণীদের মধ্যে বইয়ের নেশা বাড়াতে কাঁধে ঝোলা নিয়ে ঘুরে বেড়ান রাধা, ‘চলমান পাঠাগার’ তাঁর পরিচয়!

মুড়ি মুড়কির মতো অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া কতটা ক্ষতিকর? জানুন চিকিৎসকের মতামত

শারদীয়ার গল্প-৪: অস্মর্তব্য

আমাদের মূল ডেস্টিনেশন ইউট্রেকট। ওখানেই আমাদের ইনটারন্যাশন্যাল ইউভিআইটিস স্টাডি গ্রুপের (আইইউএসজি) সিম্পোজিয়াম। ইনটারন্যাশন্যাল ইউভিআইটিস স্টাডি গ্রুপের শুরু ১৯৭৮ সালে। তখন সদস্য ছিলেন হাতে গোনার মতো। এটা একটা এলিট গ্রুপ। এখানে যুক্ত হতে গেলে নির্বাচিত হতে হবে। আমিই প্রথম ভারতীয় এখানে নির্বাচিত হই। এরা প্রতি দু’বছর একটা সিম্পোজিয়াম করে। আমি ২০০১ সালে চেন্নাইয়ের সমুদ্র সৈকতে ফিশারম্যান কোভে ‘আইইউএসজি’-র মিটিংয়ের আয়োজন করেছিলাম। এখন ‘আইইউএসজি’ অনেক বড়। সদস্য দেড়শো মতো। মিটিং শুরুর তিনদিন আগে খবর এল ‘আইইউএসজি’-র প্রেসিডেন্ট ম্যানফ্রড আর নেই। দুরারোগ্য কোলোন ক্যানসারে ভুগছিলেন জার্মানির টিউবিঞ্জেন শহরের ইউভিআইটিস স্পেশালিস্ট ম্যানফ্রড। খুব খারাপ লাগছিল। ওঁরই প্রেরণায় আমি ‘ইন্ডিয়ান ইউভিআইটিস পেশেন্ট ইনটেরেস্ট গ্রুপ’ তৈরি করেছিলাম, যেখানে রোগীরা নিজেদের অসুস্থতা সম্পর্কে ভালো করে জানতে পারতেন কী করে তার মোকাবিলা করা যায়। —চলবে

ছবি: লেখক

ডাঃ জ্যোতির্ময় বিশ্বাস সাহিত্যের জগতে পদচারণা করেন ডাকনামে। ‘সবুজ বিশ্বাস’ নামে তিনি একাধিক সাহিত্যকেন্দ্রিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। বাচিক শিল্পেও তাঁর প্রবল আগ্রহ। এই মুহূর্তে বাচিকশিল্পে আমাদের রাজ্যে যাঁরা স্বনামধন্য, তাঁরা অধিকাংশই ডাঃ বিশ্বাসের বন্ধুস্থানীয়। ছাত্রজীবনে, এই শহরে এমবিবিএস পাঠকালে একসঙ্গে এ-মঞ্চে, সে-মঞ্চে কবিতা আবৃত্তি করেছেন। পরে পেশাগত কারণে বিদেশযাত্রা ও গবেষণাকর্মের শেষে শংকর নেত্রালয়ে যোগদানের ফলে সেই বাচিকশিল্পের সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে উঠেছে। চেন্নাই শহরের বাঙালিসমাজের যে কোনও অনুষ্ঠানে অবশ্য এখনও তিনি আবৃত্তি পরিবেশন করেন। ডাঃ বিশ্বাস চক্ষু বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বনামধন্য। ভারতের প্রথম শ্রেণির একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ। তিনি চেন্নাইয়ের শংকর নেত্রালয়ের অন্যতম ডিরেক্টর।

Skip to content