রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


ইতিহাস—’এমনই ছিল’। কেমন ছিল তা দেখার অদম্য ইচ্ছে নিয়েই পাড়ি দিয়েছিলাম শ্রবণবেলাগোলা। কর্নাটকের হাসান জেলার এই ছোট্ট শহরটি জৈন ধর্মাবলম্বীদের এক গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান। শ্রবণবেলাগোলা শব্দটির আক্ষরিক অর্থ—শ্রাবণের সাদা পুকুর।

ব্রেকফাস্ট সেরে মাইসোর থেকে সকাল আটটার মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম শ্রবণবেলাগোলার উদ্দেশ্যে। ভারী সুন্দর আবহাওয়া— ঝকঝকে রোদ, হালকা ঠান্ডা। পিচে মোড়া মসৃণ রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছে আমাদের গাড়ি। পথের দু’ ধারে ইউক্যালিপটাসের জঙ্গল, ছোট বড় নানা ধরনের পাথরের সমাবেশ দেখতে দেখতে চোখ জুড়িয়ে যায়। মনে হচ্ছিল, এই পথ যদি না শেষ হয়… সকাল ১০.১৫-এর মধ্যে পৌঁছে গেলাম শ্রবনবেলাগোলা। সুবিশাল বিন্ধ্যগিরির পাদদেশে আমাদের গাড়িটা থামল। জিনিসপত্র নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। পাহাড়ের একদম উঁচুতে দেখা যাচ্ছে ধ্যানরত অবস্থায় বসে আছেন বাহুবলী।
শ্রবণবেলাগোলাতে দুটি পাহাড়—চন্দ্রগিরি ও বিন্ধ্যগিরি। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য তাঁর শেষ জীবন চন্দ্রগিরিতেই অতিবাহিত করেছিলেন। বিদ্যানন্দ ধর্মশালায় আমাদের সমস্ত জিনিসপত্র রেখে প্রায় বেলা ১১টা নাগাদ চন্দ্রগিরি পাহাড়ে উঠতে শুরু করলাম। ২০০টি সিঁড়ি। পাহাড়ে ওঠার আগেই জুতো রাখার নির্দিষ্ট জায়গায় জুতো রেখে টোকেন সংগ্রহ করতে হয়। এবার পাহাড় অতিক্রম করার পালা। পাথর কেটে তৈরি সিঁড়ি ধাপে ধাপে উপরে উঠে গিয়েছে। দু’ ধারের রেলিং ধরে আস্তে আস্তে উঠতে লাগলাম, কখন যে ২০০টি সিঁড়ি অতিক্রম করে ফেলেছি বুঝতেই পারিনি।

পাহাড়ের উপর থেকে যতদূর চোখ যায় ছবির মতো সুন্দর শ্রবণবেলাগোলা। শুধু মুগ্ধ হওয়া আর এই অপূর্ব দৃশ্যকে ক্যামেরাবন্দি করে নেওয়া। এক অদ্ভুত আনন্দের অনুভূতি সমস্ত মন ও শরীর জুড়ে। নিজের অন্তরের উপলব্ধি থেকে বুঝতে পারছিলাম চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য কেন শেষজীবন এখানে অতিবাহিত করেছিলেন। ইতিহাসে হয়তো এর অনেক তথ্য লেখা থাকবে, কিন্তু আমার উপলব্ধি এটুকুই যে, এমন শান্তির জায়গা, এমন স্নিগ্ধ বাতাবরণ যা সবসময় দেহমনকে এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরিয়ে রাখে, হয়তো সেটাও একটা কারণ ছিল। পাহাড়ের উপর জৈন তীর্থঙ্করদের মূর্তিকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে মন্দির, যাকে স্থানীয় ভাষায় বাসদী বলা হয়। মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করতেই অনুভব করলাম এক অদ্ভুত শীতলতা, যা আধুনিক যাপনের এসিকেও হার মানাবে। মোটা মোটা পাথরের থাম। প্রায় ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দেও এমনই ছিল, আজও তেমনই আছে।
এ বারে আমার ভ্রমণসঙ্গী আমার সহকর্মী মনিকাদি। ইতিহাসের শিক্ষিকা। কোনও ঐতিহাসিক জায়গায় বেড়াতে গেলে যদি ইতিহাসের ছাত্র-ছাত্রীকে সঙ্গী হিসেবে পাওয়া যায়, তাহলে গাইডের দরকার হয় না। চোখের সামনে ইতিহাসকে দেখে স্বাভাবিকভাবেই সমস্ত ঐতিহাসিক তথ্য আপনাআপনি মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে লাগলো। মনিকাদি বলছিলেন, যখন স্কুলে মেয়েদের পড়াই তখন এই মন্দিরের ফলকে লেখা তথ্যগুলোই তো ওদের বলি। আর আজ চোখের সামনে দেখছি। যাকে বইয়ের পাতায় দেখেছি তাকে চোখের সামনে দেখার অনুভূতি ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব।

চন্দ্রগিরি পাহাড়ের আদি নাম কালবাপ্পু। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কারণেই এই পাহাড়ের নাম চন্দ্রগিরি। মন্দিরের সেবাইতের কাছে জানতে পারলাম, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য তাঁর শিক্ষক ভদ্রবাহুর সঙ্গে এখানে এসেছিলেন এবং এই পাহাড়েই বসবাস ও তপস্যা করেন। পাহাড় চূড়ার পথে ছোট বড় নানা ধরনের শিলা। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের নাতি সম্রাট অশোক গ্রানাইট পাথরের এই পাহাড়কে তীর্থস্থানে পরিণত করেছিলেন। আজকে এই চন্দ্রগিরির বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে যেসব মন্দির, শিলালেখ দেখতে পাই তার পশ্চাতে সম্রাট অশোকেরই অবদান।
আরও পড়ুন:

বাইরে দূরে: চুপি চুপি ঘুরে আসি

আবিষ্কার যখন আবিষ্কারকহন্তা, পর্ব-১: সামনে মৃত্যু বুঝেও গবেষণাকে অবহেলা করেননি মাদাম কুরি

ছোটদের যত্নে: শিশুকে টনসিলের সমস্যা থেকে দূরে রাখতে চান? মেনে চলুন শিশু বিশেষজ্ঞের এই সব টিপস

চন্দ্রগিরি পাহাড়সহ পাহাড়ের উপর নির্মিত ছোট ছোট মন্দিরগুলি এবং তৎসংলগ্ন সমস্ত অঞ্চল বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। মন্দিরের বেশ কিছু অংশের ভিডিও রেকর্ডিং করার পর আমরা প্রবেশ করলাম শ্রীআদিনাথ তীর্থঙ্করের মন্দিরে। অতীতের সাক্ষ্য বহনকারী পাথরের থামগুলো আপনার দৃষ্টিকে আকর্ষণ করবেই। আমাদের জিজ্ঞাসা ও কৌতুহল দেখে মন্দিরের সেবাইত মন্দিরের ভেতরে একটি দরজা খুলে দিলেন। একসঙ্গে একজনের বেশি সেই দরজা দিয়ে ঢোকা যায় না। নীচু হয়ে ভেতরে প্রবেশ করে দেখলাম— একটি মন্দিরের ভেতরে নির্মিত আরও একটি মন্দির এবং সেখানে রয়েছে যক্ষী শ্রীপদ্মাবতী দেবী, শ্রীভগবান পার্শ্বনাথ তীর্থঙ্কর, যক্ষী শ্রীকুষ্মান্ডিনী দেবীর মূর্তি। এছাড়াও পাথরে খোদাই করে নির্মিত চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও ভদ্রবাহুর আগমনের কাহিনী সমন্বিত শিলালেখটিও অনবদ্য! মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে বেরিয়ে আমরা গেলাম ভদ্রবাহুর বাসদীতে। ছোট্ট এই গুহাটিতেই এক সময় পড়েছিল ভদ্রবাহুর পবিত্র পদচিহ্ন। আজও মানুষ ভক্তিতে বিশ্বাসে জীবন্ত করে রেখেছে তাঁকে, তাঁর তপস্যাকে। পবিত্র চরণ চিহ্নে অর্পণ করা হয়েছে— ফুল ও চালের অর্ঘ্য। দেবতাকে অর্পিত অর্ঘ্য যে, জীব সেবাতেও লাগে, মূষক মহারাজের খুঁটে খুঁটে চাল খাওয়া দেখে তা বেশ বুঝতে পারছিলাম। বেলা দেড়টা নাগাদ চন্দ্রগিরি থেকে অবতরণ করলাম।
এবার দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর্ব। এখানে সবাই নিরামিষাশী। তাই মাছ-মাংস-ডিমের কোনও পদ এখানকার কোনও হোটেলেই পাওয়া যায় না। তবে পেঁয়াজ রসুন ব্যবহার হয় সব রান্নাতেই। দেখতে দেখতে অনেকটাই বেলা গড়িয়ে গিয়েছে। ঘড়িতে এখন দুপুর ২:২০। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য বিন্ধ্যগিরি। সূর্যাস্তের আগেই বিন্ধ্যগিরি দর্শন করে ফিরে আসতে হবে। কারণ বিকেল সাড়ে পাঁচটার পর ওখানে আর উঠতে দেওয়া হয় না। ভরপেট খেয়ে ৬০০টি সিঁড়ি ওঠা শুরু করলাম।

আদ্যোপান্ত বাঙালি আমরা, একটু পরিশ্রমের পর পেটে ভাত পড়লেই চোখ ভাতঘুমে জড়িয়ে আসে। খুব আস্তে আস্তে ধীর পায়ে একটা একটা করে সিঁড়ি অতিক্রম করছি। আমার সহযাত্রী মনিকাদি গোটা দশেক সিঁড়ি ওঠার পরে একটু বসে বিশ্রাম নিয়ে নিচ্ছেন।

আমি একবারও বসিনি। একবার বসলে আর উঠতে পারবো না জানি। একটু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নিতে নিতে উঠতে লাগলাম ওপরের দিকে। বেশ বুঝতে পারছিলাম এখানকার সিঁড়িগুলো চন্দ্রগিরির থেকে অনেক বেশি খাড়াই। তাই একটু কষ্ট হচ্ছিল। তার ওপর ভরপেট খাওয়া। তবুও বিকেল তিনটে নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম বিন্ধ্যগিরির শীর্ষে। অতিক্রম করার সময় যে কষ্টটা হচ্ছিল, সেটা কিন্তু আর একটুও নেই! না আছে কোনও যন্ত্রণা! এক অনাবিল অজানা আনন্দে হৃদয় মন ভরে উঠেছে। এখানেও ইতিহাসের নিদর্শনগুলিকে ক্যামেরাবন্দি করলাম।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৪: কবির দরজা সাধারণজনের জন্য সারাক্ষণই খোলা থাকত

ত্বকের পরিচর্যায়: শীতে কি আপনার ত্বক শুকিয়ে যায়? মেনে চলুন ত্বক বিশেষজ্ঞের এই পরামর্শগুলি

৭৮ বছর বয়সে নিভৃতে চলে গিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের ভীষ্ম পিতামহ/৩

গোমতেশ্বর বাহুবলীর যে মূর্তিটিকে চন্দ্রগিরি থেকে বা বিন্ধ্যগিরির পাদদেশ থেকে দেখলে মনে হয় ধ্যানরত অবস্থায় বসে আছেন, আসলে কিন্তু তা নয়। মূর্তির সামনে যখন আমরা পৌঁছলাম তখন দেখলাম ৫৭ ফুট লম্বা একশিলা এই মূর্তিটি কায়োৎসর্গ ভঙ্গিতে দণ্ডায়মান। মনে করা হয়, এটিই পৃথিবীর বৃহত্তম একশিলা মূর্তি। প্রথম জৈন তীর্থঙ্কর ঋষভদেবের পুত্র গোমতেশ্বর বাহুবলী। কথিত আছে, তিনি এক বছর সময়কাল ধরে এই কায়োৎসর্গ ভঙ্গিতেই দাঁড়িয়ে তপস্যা করেছিলেন। এই সময় তাঁর পা দুটোকে জড়িয়ে রেখেছিল বিভিন্ন লতা গুল্ম জাতীয় গাছ ও সাপ। কিন্তু তিনি কোনওদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে তাঁর সাধনকার্যে রত ছিলেন। এক বছর ধ্যানের পর তিনি অর্জন করেছিলেন সর্বজ্ঞতা।
প্রতি ১২ বছর অন্তর গোমতেশ্বর ভগবানের মহামস্তক অভিষেক অনুষ্ঠান হয় মহাসমারোহে। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে দূর দূরান্ত থেকে ভক্তদের সমাগম হয়। ২০১৮ সালে হয়েছিল সেই অনুষ্ঠান। জাফরান, হলুদ, দুধ, গঙ্গাজল এবং আরও নানা ধরনের পবিত্র বারিধারায় সিঞ্চন করা হয় ভগবান গোমতেশ্বরের মূর্তি।

বিভিন্ন জৈন তীর্থঙ্করদের মূর্তি ও বিন্ধ্যগিরির আনাচ-কানাচ ঘুরতে ঘুরতে ও ক্যামেরাবন্দি করতে করতে আমরা চলে এলাম মূর্তির একদম পেছনের অংশে। এখন প্রায় চারটে বাজে। দেখি, একটু উঁচু একটা জায়গায় কাঠকুটো জ্বেলে মাটির হাঁড়িতে ভাত রাঁধছেন মন্দিরের এক সেবাইত। তাঁকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম গঙ্গা রাজবংশের মন্ত্রী ও সেনাপতি চাভুন্ডারায় এই মূর্তিটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। আমাদের জিজ্ঞাসায় তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। প্রবল উৎসাহে রান্না করতে করতেই উঠে এসে একটা তালা বন্ধ কাঠের দরজা খুলে আমাদেরকে নিয়ে এলেন মন্দির অঞ্চলের বাইরে পাহাড়ের প্রায় শেষ অংশে।
আরও পড়ুন:

ইংলিশ টিংলিশ: জানেন কি ‘night owl’ বা ‘early bird’ কাকে বলে? কিংবা তিনতলাকে কেন ‘second floor’ বলে?

স্বাদ-বাহারে: রাঁধুনি আর বিলাতি ধনেপাতা দিয়ে ট্যাংরা

মনের আয়না: ঘুমোতে গেলেই মগজে ভিড় করছে রাজ্যের দুশ্চিন্তা? জন্মাচ্ছে অকারণ ভয়? রইল সমাধান

এখান থেকে শ্রবণবেলাগোলা ও চন্দ্রগিরিকে দেখার অনুভূতিই আলাদা। সূর্যাস্তের শেষ কিরণ রাঙিয়ে দিচ্ছে বিন্ধ্যগিরিকে। আর সেই আলোতে শ্রবণবেলাগোলার আকাশ ও তৎসংলগ্ন সমস্ত অঞ্চল যে কি অপূর্ব সাজে সজ্জিত হয়েছে তা এই জায়গাটিতে না এলে কখনোই বুঝতে পারতামনা। বিন্ধ্যগিরি ও ভগবান বাহুবলী সম্পর্কে অনেক কথা বলছিলেন সেই সেবাইত। ইতিহাসের এসব নানা তথ্য মন্দিরের প্রত্যেকটি অংশেই কমবেশি লেখা রয়েছে। কিন্তু সেগুলো পড়ার মতো সময় আমাদের হাতে ছিলনা। তাই মৌখিকভাবে জানতে চেয়েছিলাম ওঁর কাছে। আমাদের সামান্য একটু জিজ্ঞাসা যে, এত তথ্য প্রকাশ করতে পারে তা সত্যিই ধারণার অতীত ছিল! বুঝলাম এখানে যাঁরা আসেন তাঁরা শুধুই তীর্থ করতে বা পুণ্য অর্জন করতেই আসেন। বেশিরভাগ মানুষেরই কোনও জিজ্ঞাসা থাকে না ! তা না থাক। আসলে এই স্থানটি এমনই, যেখানে এলে সমস্ত পার্থিব অনুভূতির অনেকাংশেই অবসান ঘটে যায়, থাকে শুধু এক অপার্থিব আনন্দ যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়!

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৩৪: বাংলার শুঁটকি মাছের চাহিদা সর্বত্র, এখনকার বিশেষভাবে প্রস্তুত শুঁটকি অনেক বেশি নিরাপদ ও পুষ্টিগুণে ভরা

জাঁকিয়ে শীত পড়ার আগেই গালভর্তি ব্রণ? চিন্তা নেই, হাতের কাছেই রয়েছে সহজ সমাধান

ডায়াবিটিস ধরা পড়েছে? হার্ট ভালো রাখতে রোজের রান্নায় কোন তেল কতটা ব্যবহার করবেন? দেখুন ভিডিয়ো

পাঁচটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। এবার প্রত্যাবর্তনের পালা। সূর্য তার শেষ কিরণ ছড়িয়ে দিতে দিতে স্বাগত জানাচ্ছে সন্ধ্যাকে। বিন্ধ্যগিরির বিভিন্ন জায়গায় নানা ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে অনেক ছবি তুললাম। সিঁড়ি দিয়ে যত নীচে নামছি দেখছি সন্ধ্যার চাদর জড়িয়ে নিচ্ছে শ্রবণবেলাগোলোকে ধীরে ধীরে। উপরে উঠতে যতটা সময় এবং কষ্ট হয়েছিল নিচে নামার সময় কিন্তু তার এতোটুকুও ছিল না। আসলে এই ওপরে ওঠা তো এক অতিক্রম! মোহ, মায়া, কামনা, বাসনা, লালসা, হিংসা, ঘৃণা এসব কিছুর আকর্ষণকে সবকিছুর ভারবত্তাকে তুচ্ছ করে অতিক্রমই তো আরোহণ। এ আরোহণ শুধু পর্বতের শীর্ষে নয়, তীর্থক্ষেত্রে নয়, এ আরোহণ নিজের কাছে, নিজের সত্তার কাছে পৌঁছনো।

পাঁচটা চল্লিশের মধ্যেই আমরা নীচে নেমে এলাম। একবার তাকালাম উপরের দিকে। সমাগত সন্ধ্যার মৃদু আঁধারে দণ্ডায়মান গোমতেশ্বর বিশ্বক্লান্ত ত্রিতাপ জ্বালায় দগ্ধদের জন্য এক আলোকবর্তিকা। মন্দিরের নানা জায়গায় জ্বলে উঠেছে আলো। সে দৃশ্যও বড়ই সুন্দর। সৌন্দর্য ও নির্মলতার সংমিশ্রণে শ্রবণবেলাগোলা সত্যিই এক তপোভূমি— যা শত শত সন্ন্যাসীকে আকৃষ্ট করেছে যুগে যুগে।
আরও পড়ুন:

অ্যালঝাইমার্সের যত্ন বেশ চ্যালেঞ্জের, সঠিক পরিচর্যায় ধৈর্যশীল, সহনশীল, সংবেদনশীল এবং কৌশলী হতে হবে

ডায়েট ফটাফট: না খেয়ে নয়, বরং খেয়েই কমান ওজন! কী কী খেলে মেদ ঝরবে? দেখুন ভিডিয়ো

‘নো মেকআপ লুক’ চাই? তাহলে ৫টি লিপস্টিক নিজের সংগ্রহে রাখতে পারেন

গরম গরম চপ ভাজা খেতে খেতে ফিরে এলাম ধর্মশালায়। বিদ্যানন্দ ধর্মশালাকে দেখলে ধর্মশালা বলে মনে হয় না। মনে হয় এ যেন একটা কলোনি বা ব্লক। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বিশাল জায়গা, যেখানে ছোট ছোট দোতলা বাড়ি রয়েছে অনেকগুলো। এই ছোট ছোট বাড়িগুলোই টুরিস্টদের থাকার জায়গা। এখানে না এলে জানতেই পারতাম না যে, এত স্বল্প মূল্যে বর্তমান বাজারে এত সুন্দর থাকার ব্যবস্থা আছে কোনও পর্যটন কেন্দ্রে! এখানেও এক অদ্ভুত শান্তি! নৈঃশব্দের শব্দ শুনতে শুনতে রাত্রিযাপন। নিঝুম নিস্তব্ধতা চারিদিকে, কিন্তু অসুরক্ষার ভয়ের লেশমাত্র নেই কোথাও।

মার্চ মাস থেকেই এখানে প্রতিদিন রাতে বৃষ্টি হয়। দিনেরবেলা ঝকঝকে রোদ, হালকা ঠান্ডা। চিরবসন্ত বিরাজমান বছরের প্রায় বেশিরভাগ সময়ই। তাই যেকোনও সময়ই এখানে বেড়াতে আসা যায়। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যেই হোটেলে গেলাম রাতের খাওয়া সারতে। হোটেলের মালিকের কাছেই জানতে পারলাম—এখানকার জলবায়ুর কথা। খাওয়া শেষে ফিরে এলাম ধর্মশালায়।
এবার বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমের দেশে পাড়ি দেওয়া। পরদিন ভোর ভোর উঠে পড়তে হবে। সকাল সাড়ে সাতটাতেই এখান থেকে বাস সোজা ব্যাঙ্গালোর যায়। বাসস্ট্যান্ডের একদম পাশে আমাদের ধর্মশালাটি। সারাদিন রাস্তা দিয়ে কত গাড়ি চলছে, বাসস্ট্যান্ডে আসছে কতদূর দূরান্তের বাস, কত লোকজন, কত যাত্রী, তবু কান ঝালাপালা করা কোলাহল কলরব কিছুই নেই। এখানে মুখরতা আছে, বিরক্তিভরা কর্মব্যস্ততা নেই —এটাই হয়তো সেই পজেটিভ ভাইব্রেশন যাকে আমরা পেতে চাই অনুভব করতে চাই আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে। যেখানে এলে সমস্ত ভার লাঘব হয়ে যায়। হালকা হয়ে যায় মন-দেহ সবকিছু। যেখানে এলে আনন্দ পরিণত হয় পরমানন্দে সেইতো প্রকৃত তীর্থ!

এখন ঘড়িতে সকাল সাতটা। সমস্ত ফরমালিটিজ পূরণ করে ধর্মশালা থেকে বেরিয়ে আমরা বাসস্ট্যান্ডে এসে বসে আছি। বৃষ্টিধোয়া প্রকৃতি। কুয়াশার চাদরে মোড়া বিন্ধ্যগিরি থেকে বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়ছে। ধ্যানরত ভগবান বাহুবলী কুয়াশার আস্তরনের মধ্যে থেকেও শান্তির বার্তা দিয়ে যাচ্ছেন। সেই অনুরণন ছড়িয়ে পড়ছে শ্রবণবেলাগোলার আকাশে বাতাসে জনমানসে। সকাল সাড়ে ছটাতেই মন্দির খুলে যায় ভক্তদের জন্য, দর্শনার্থীদের জন্য। ইতিমধ্যেই অনেক মানুষ সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে ওঠা শুরু করেছেন। নির্ধারিত সময়ে বাস এলো। এবার ফিরতে হবে সেই সংসার সমরাঙ্গনে।

ছবি সৌজন্যে: লেখক

* বাইরে-দূরে: শ্রবণবেলাগোলা (Travel – Shravanabelagola) : সোমা চক্রবর্তী (Soma Chakrabarti), শিক্ষিকা, নিমতা জীবনতোষ ঘোষ মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল (উচ্চ মাধ্যমিক)।

Skip to content