বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


কেদারঘাটে কোন এক শিবরাত্রির দিনে।

আজ বারাণসীকুলপতির কথা, বিশ্বনাথের কথা। বারাণসী বা বেনারসের আকর্ষণ সেই কোন ছোটবেলা থেকে। দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাড়ি থাকার সুবাদে বছরে দু’বছরে হলেও বেনারসে যাওয়া হতোই। আর তাছাড়াও আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ। বদলির চাকরির সুবাদে বাইরে বাইরে কাটিয়েছেন। ফলে বেরিয়ে পড়াতেও কোনও ক্লান্তি ছিল না। তবে বেড়াতে যাওয়ার অনেকরকমের অভিমুখ থাকে। কেউ পাহাড় পছন্দ করেন তো কেউ সমুদ্র। কেউ ঐতিহাসিক জায়গাগুলোতে প্রাণের আরাম খোঁজেন। এমন আরও কত কী আছে!
আমার বাবার পছন্দের জায়গা ছিল ধর্মস্থানগুলি। এটাও হয়তো বেনারসে বার বার যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। যেটা পরবর্তীকালে ভালোলাগায় পরিণত হয়েছে। আমার নিজের ভালোলাগাগুলো অবশ্য শুধু মন্দির বা বিগ্রহকেন্দ্রিক হয়ে থেমে থাকেনি। কাশীর হরেক আকর্ষণ। সেই আকর্ষণ তৈরি হওয়ার পিছনে অবশ্যই ছেলেবেলায় সোনারপুরায় কাকার বাড়িতে কাটানো দিনগুলোর হাত রয়েছে। নয়তো দু’দিনের জন্য কাশী গিয়ে, হোটেলে থেকে, পরিচিত ভ্রমণপ্রিয় মানুষের কাছ থেকে জানা ‘বিখ্যাত’ খাবারের আস্বাদ নিয়ে, গলিতে উঁকি মেরে গোটাকতক ফটো এলবামবন্দি করে আর যাই হোক ভালোবাসা তৈরি হওয়া সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন:

জ্যোতির্লিঙ্গ যাত্রাপথে, পর্ব-১: চলার পথে খানিক ভণিতা

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৪৯: চ্যবনমুনির প্রভাবে দেবরাজ হার মানলেন, সোমের ভাগ পেলেন অশ্বিনীকুমারদ্বয়

বড়দাদা, যে নিজেকে বনারসবালা বলে পরিচয় দিতে ভালোবাসত, আজন্ম পশ্চিমবাংলায় থেকেও মনে মনে নিজেকে কাশীবাসী ভেবে আনন্দ পেত সেই দাদার মুখে কাশীর কথা, বাবা বিশ্বনাথের কথা, অলিগলির হরেক কাহিনী, মণিকর্ণিকা মহাশ্মশানের কথা শুনতে শুনতে কবে থেকে যেন নিজেও কাশীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলাম। তখন বেনারসে গেলেও কবারই বা যাওয়া হত বিশ্বনাথ দর্শন করতে! কিন্তু রাতের অন্ধকারে ভাইবোনেরা মিলে কেদারঘাটে পা ঝুলিয়ে চুপ করে বসে থাকতে থাকতে চরৈবেতি মন্ত্র যেন অবচেতনে দৃঢ়প্রোথিত হয়েছিল।

কাছেই ছিল হরিশ্চন্দ্র ঘাট। সে ঘাটের শ্মশানে জ্বলা ধিকিধিকি আগুন জগতের অনিত্যতাকে প্রকট করতে করতে কি তখনই রোহিতের মতো আমার ক্ষেত্রে ইন্দ্রের ভূমিকা পালন করছিল? হয়তো বা। বেনারসের গলির ছোট মন্দিরে শোনা ভজনগান যা বনারসবালা বড়দাদার উদাত্ত কণ্ঠে শুনে শুনে শেখা, সেই গান আজও কেনই বা কাশীবাসী এই মনের নিত্যসাঁঝের সঙ্গী হবে! ‘হর হর মহাদেবশম্ভো, কাশীবিশ্বনাথ গঙ্গে!’ এর উত্তরও জানা নেই। বেনারসের আকর্ষণ এমনিই অমোঘ।

মেয়ে তখন সবে পাঁচমাসের।

তারও অনেককটা বছর পর বেনারসে যাওয়া আসা শুরু হল আবারও। এবার কারণে, অকারণে, বছরের বিভিন্ন সময়ে। ওই যে কথায় আছে না, যে তীব্র ইচ্ছে কখনও মরে না! এবারের যাতায়াতে দীর্ঘদিনে মনে মনে যেমন ভাবে কাশীকে দেখব বলে ইচ্ছেগুলোকে লালন করেছিলাম, সেভাবে দেখা শুরু করলাম। ভোরের প্রাতঃপ্রণাম মন্ত্ররাজির একটি হল— ‘বিশ্বেশং মাধবং ঢুণ্ঢিং দণ্ডপাণিঞ্চ ভৈরবম্/ বন্দে কাশীং গুহাং গঙ্গাং ভবানীং মণিকর্ণিকাম্।।’ বারাণসীদর্শনে এলে যাঁদের সাথে দেখা না করলেই নয় তাঁরা হলেন, বিশ্বেশ বা বিশ্বনাথ মহাদেব, বিন্দুমাধব নারায়ণ, ঢু্ণ্ঢিরাজ গণেশ, দণ্ডপাণি ভৈরব, কালভৈরব, জৈগীষব্য গুহা যেখানে রয়েছে যাগেশ্বরের মন্দির, গঙ্গা, মা ভবানী বা অন্নপূর্ণা আর মণিকর্ণিকার মহাশ্মশান। সবার আগে রয়েছেন বিশ্বনাথ।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-১: পৃথিবী খ্যাত ডালটন হাইওয়ে এই শহরকে ছুঁয়েছে আর্কটিক বৃত্ত তথা উত্তরমেরুর সঙ্গে

ডায়েট ফটাফট: সানস্ক্রিন মাখবেন তো বটেই, এবার খেয়েও দেখুন—সিঙ্গল ইনভেস্টমেন্টে ডবল প্রফিট!

বিশ্বনাথমন্দিরের বিশদ ইতিহাস নিয়ে আলোচনা তো হবেই। তবে তারও আগে এটা বলা খুব জরুরি যে এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে যে বিখ্যাত অলিগলি তাদের গল্পও বড় কম নয়। মন্দিরে ঢোকার বেশ কয়েকটি গেট রয়েছে। মূল যে প্রবেশদ্বার সেটি দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছে। বছরের বিভিন্ন সময়ে অথবা বিভিন্ন উত্সবের সময়ে বেনারসে গিয়ে বুঝেছি, এসব সময়গুলোতে বাইরে থেকে আসা মানুষজনের ধরন যেমন বদলে বদলে যায়, তেমনি উত্সব অনুযায়ী উদযাপনের বৈচিত্র্যও লক্ষণীয়।
আরও পড়ুন:

ইংলিশ টিংলিশ: মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা সহজে শিখে নাও Transformation of Sentences by changing the DEGREES of Adjectives

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৩৭: মাছ বাজারের বর্জ্যই এখন মূল্যবান সামগ্রী প্রস্তুতের অন্যতম সেরা উপাদান হতে চলেছে

তখন শুধু জনজোয়ারে মিশে গিয়ে বেনারসের অন্তঃস্থিত সুরটাকে উপলব্ধি করতে হয়। সে উপলব্ধির জন্য যদি ঘাটের পথে হাঁটতে শুরু করা যায়, তবে হাঁটতে হাঁটতে দশাশ্বমেধ কিংবা রাজেন্দ্রপ্রসাদ ঘাটকে পিছনে ফেলে পঞ্চগঙ্গা ঘাটের মতো কোনও এক ঘাটে উপস্থিত হলে দেখা যায় নিরিবিলি রোজকার কাশীকে। এই সেই ঘাট যেখানে এক নিভৃত মন্দিরে আজও পূজিত হয়ে চলেছেন বেনারসের সচল বিশ্বনাথ বলে পরিচিত তৈলঙ্গস্বামীজির গঙ্গা থেকে তুলে নিয়ে আসা সুবিপুল শিবলিঙ্গ। এমনি আরও কত গল্প মিলেমিশে রয়েছে এই ধর্মনগরীতে। তবে সবার মাঝে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন কাশীপতি বিশ্বনাথ।—চলবে

ছবি সৌজন্যে: লেখিকা
 

বাইরে দূরে

লেখা পাঠানোর নিয়ম: এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। লেখার সঙ্গে বেশ কিছু ছবি পাঠাতে হবে। চাইলে ভিডিও ক্লিপও পাঠাতে পারেন। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.co

* জ্যোতির্লিঙ্গ যাত্রাপথে (Jyotirlinga – Travel) : ড. অদিতি ভট্টাচার্য (Aditi Bhattacharya) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content