বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


দশাশ্বমেধ ঘাট, বেনারস। ছবি লেখিকা।

২০০৯ সালে অমরনাথের পথে যাত্রা করেছিলাম। সেখানে রয়েছেন তুষারলিঙ্গ। সেই পথ ছিল ভয়ঙ্কর সুন্দর। যাত্রাপথের ভীষণ রুক্ষতা, কঠোরতায় মন বার বার বলেছে, আর এ পথে নয়। কিন্তু পথ যাকে ডাক দিয়েছে, তার মুক্তি নেই। তাকে ঘরের কোণের সুখ ছেড়ে পথে বেরোতেই হবে। এ অনিবার্য। অমরনাথ থেকে ফেরার পরেই পরিকল্পনা হল। এবারের গন্তব্য কেদারনাথ আর বদ্রীনাথ। একপথে যেতে যেতে নতুন পথের সন্ধান মেলে। উদ্দেশ্যও পরিবর্তিত হয়।

পরিকল্পনা হয় সেই মতো। কেদারনাথ থেকে ফেরার পথে বেনারসে ছিলাম দিনকয়েক। সেদিন ছিল দুর্গাপুজোর দশমী। বেনারসে গঙ্গার ঘাটে বসে মায়ের বিসর্জন দেখতে দেখতেই ইচ্ছা জাগল, এবার না হয় কিছুদিন অন্যভাবে দেশ ভ্রমণ করা যাক। শুরু হল পরিকল্পনা। দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ দর্শন মানসে লেখাপড়া শুরু করলাম। এ তো আর কোনও এক জায়গায় নয়! সারা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে এই মন্দিরগুলি। সদ্য উত্তরাখণ্ডে কেদারনাথ দর্শন করে এসেছি। আবার রামেশ্বরমের দর্শনে যেতে ভারতের দক্ষিণতম প্রান্তে। প্রথমেই একটা তালিকা করে নিলাম, কোথায় কোথায় রয়েছে এই জ্যোতির্লিঙ্গের মন্দিরগুলি।
তীর্থভ্রমণের বাসনা নিয়েই আরম্ভ হয়েছিল যাত্রা। বেনারসে বিশ্বনাথের দরবারে যে যাত্রার পরিকল্পনা, কেদারনাথ থেকে যে যাত্রার সূত্রপাত, সেই যাত্রাপথ কয়েকটা দিনে ফুরিয়ে যায়নি। সময়সুযোগ বুঝে, পরিকল্পনামাফিক সেই যাত্রা শেষ করতে বেশ কয়েকটা বছর পার হয়েছিল।
পুরাণপ্রসিদ্ধ তিন দেবতা ব্রহ্মা, বিষ্ণু আর মহেশ্বর বা শিব। শিব বা রুদ্রের কথা বেদে পাওয়া যায় বটে। তবে মূলতঃ পৌরাণিক যুগেই এই দেবতা অন্যতম প্রধানদেবতা হিসেবে মানুষের আরাধ্য হয়ে ওঠেন। লিঙ্গশব্দের অর্থ প্রতীক বা চিহ্ন। মহাজ্যোতির্ময় স্তম্ভস্বরূপ মহাদেব, এই কল্পনা করে শিবলিঙ্গ নির্মাণ করে শিবপূজা করা হত প্রাচীনকালে। লিঙ্গরূপে তাঁর পূজা অধিক প্রচলিত।

শিবলিঙ্গ কোনটি স্বয়ম্ভূ, কোনটি বাণলিঙ্গ, কোনটি আবার পার্থিব লিঙ্গ। আচার্য শঙ্কর তাঁর পরিব্রাজক জীবনে যেখানে বিশেষ উপলব্ধি লাভ করেছেন, সেইসব স্থানের মাটি বা পাথরের তৈরি শিবলিঙ্গকে জ্যোতিস্বরূপ শিবরূপে আরাধনা করতে বলে গিয়েছেন। দ্বাদশ ভারতে এমন ১২টি প্রাচীন শৈবতীর্থে রয়েছেন দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ। পরম ব্রহ্মের অনুকল্পরূপে পূজিত হয়ে চলেছেন দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ। আমরা যে ক্ষুদ্র লিঙ্গ বা প্রতীক দেখি তা আসলে বিরাট এর প্রতীক।
আরও পড়ুন:

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৪৮: অবশেষে বৃদ্ধ চ্যবনমুনি শর্যাতিরাজার কন্যার পাণিপ্রার্থী হলেন

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১: চায়ের দোকান থেকে বিশ্বজয়

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-১: অমৃতের সন্ধানে…

বেনারসে বিশ্বনাথ, উত্তরাখণ্ডে কেদারনাথ, গুজরাতে সোমনাথ, দ্বারকার কাছে নাগনাথ (মতান্তরে মহারাষ্ট্রের ঔন্ধাতে নাগনাথ), মহারাষ্ট্রের পারলিতে বৈজনাথ বা বৈদ্যনাথ (মতান্তরে দেওঘরে বৈদ্যনাথ, মতান্তরে হিমাচল প্রদেশে পালামপুরের কাছে বৈজনাথ), ইলোরার কাছে ঘৃষ্ণেশ্বর, পুণের কাছে ভীমাশঙ্কর, নাসিকের কাছে গোদাবরী নদীর তীরে ত্র্যম্বকেশ্বর, উজ্জয়িনীতে মহাকাল, নর্মদাতীরে মান্ধাতা পর্বতে ওঙ্কারেশ্বর, দক্ষিণ ভারতে রামেশ্বরম এবং শ্রীশৈলমে মল্লিকার্জুন। তালিকাটা তৈরি হওয়ার পর দেখলাম সংখ্যাটা ১২ থেকে ১৫তে গিয়ে পৌঁছেছে।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৬: ছোটদের, একান্তই ছোটদের ‘ভাই-বোন সমিতি’

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়: পর্ব-১: স্নানের আগে রোজ সর্ষের তেল মাখেন?

এই বিষয়ে সংস্কৃতে একটি প্রচলিত শ্লোকরাজি রয়েছে।
সৌরাষ্ট্রে সোমনাথঞ্চ শ্রীশৈলে মল্লিকার্জুনম।
উজ্জযিন্যাং মহাকালম ওঙ্কারমমলেশ্বরম।।


পরল্যাং বৈদ্যনাথঞ্চ ডাকিন্যাং ভীমাশঙ্করম্‍।
সেতুবন্ধে তু রামেশং নাগেশং দারুকাবনে।।
বারাণস্যাং তু বিশ্বেশং ত্র্যম্বকং গৌতমীতটে।
হিমালয়ে তু কেদারং ঘুশ্মেশং চ শিবালয়ে।।
এতানি জ্যোতির্লিঙ্গানি…


ঠিক করলাম একবার যখন তীর্থভ্রমণ করব বলে মনস্থির করেছি, তখন মত বা মতান্তর কোনওটিকেই বাদ দেব না। কোথায় যে কি অমূল্য রতন পাওয়া যায় কেই বা জানে!
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১: নারী কি আলাদা? তাঁরা পুরুষদের সঙ্গে বসতে ভয় পান? তাহলে কি এত আয়োজন শুধু তাঁদের ভয় দেখাতে…

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩০: শেষ পর্যন্ত ভগ্নদূত সুমন্ত্র কী বার্তা এনে দিলেন?

যদিও দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের স্তোত্রে সর্বপ্রথম সোমনাথের কথা রয়েছে, তথাপি আমাদের এই পরিক্রমা শুরু হবে বারাণসী বা বেনারসের ক্ষেত্রদেবতা বিশ্বনাথের কথা দিয়ে। কারণ আদি জ্যোতির্লিঙ্গ হলেন বিশ্বনাথ। তাই তাঁর মহিমা সমধিক। এছাড়াও বারাণসীপুরপতির দর্শনমানসে বছরে দু’বছরে বেনারসে যাওয়া হয়ই। তীর্থের রাজা বারাণসী। সেখানে রয়েছেন মাতা অন্নপূর্ণা। রয়েছেন কালভৈরব। আদি এই ধর্মনগরীর অনেক আকর্ষণ। সব আকর্ষণের মধ্যমণি হয়ে রয়েছেন বহু বছর ধরে বহু সাধকের তথা সাধারণ মানুষের আরাধ্য জ্যোতিস্বরূপ জ্যোতির্লিঙ্গ বিশ্বনাথ।—চলবে
 

বাইরে দূরে

লেখা পাঠানোর নিয়ম: এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। লেখার সঙ্গে বেশ কিছু ছবি পাঠাতে হবে। চাইলে ভিডিও ক্লিপও পাঠাতে পারেন। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.co

* জ্যোতির্লিঙ্গ যাত্রাপথে (Story of Jyotirlingas – Travel) : ড. অদিতি ভট্টাচার্য (Aditi Bhattacharya) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content