শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


অযোধ্যার দশরথ মহল।

অযোধ্যা প্রাচীন সংস্কৃত মহাকাব্য রামায়ণের শহর রূপে খ্যাত। রামায়ণ অনুসারে বৈবস্বত মনুর পুত্র ইক্ষ্বাকু (৭০০০-৮০০০ খ্রিস্টপূর্ব) সর্বপ্রথম অযোধ্যায় রাজধানী স্থাপন করেন। রামায়ণের কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডে ইক্ষ্বাকুকে সম্পূর্ণ পৃথিবীর একচ্ছত্র অধিপতি বলা হয়েছে।

অযোধ্যা শব্দের বুৎপত্তি সংস্কৃত ‘যুধ’ অর্থাৎ যুদ্ধ করা থেকে এসেছে। অথর্ব বেদে (১০.২.৩১) প্রথম অযোধ্যার উল্লেখ পাওয়া যায়, “অষ্টাচক্রা নবদ্বারা দেবানাং পুর অযোধ্যা”। অন্য একটি নাম বিষ্ণুপুরাণে পাওয়া যায় ‘সাকেতু’। বৌদ্ধ পালি-ভাষার গ্রন্থে এবং জৈন প্রাকৃত-ভাষা গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে সেই সময় গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন শহর ছিল সাকেত। এই সাকেত শহরই অযোধ্যা রূপে প্রসিদ্ধ। তাইল্যান্ডের ‘আয়ুত্থায়া’ নামক স্থানটির নাম অযোধ্যা থেকে এসেছে।

কনক ভবন।

রামায়ণে অযোধ্যা কোশল রাজ্যের রাজধানী, রামের জন্মস্থান। ভারতের সাতটি প্রসিদ্ধ তীর্থস্থানের অন্যতম অযোধ্যা। পাণিনির ‘অষ্টাধ্যায়ী’তে এবং পতঞ্জলির মহাভাষ্যতে ‘সাকেত’-এর উল্লেখ আছে। পরবর্তীকালে বৌদ্ধ পুঁথি ‘মহাবস্তু’ সাকেতকে বর্ণনা করেছে ইক্ষ্বাকু রাজা সুজাতর রাজ্য রূপে, যাঁর উত্তরাধিকারী শাক্য রাজধানী কপিলাবস্তু স্থাপন করেছিলেন।

মধ্যযুগে মগধের মৌর্য থেকে শুরু করে গুপ্তবংশ ও কনৌজের শাসকদের অধীনে ছিল অযোধ্যা। ১৫২৮সালে বাবরের সেনাপতি অযোধ্যা আক্রমণ করেন এবং বাবরি মসজিদ নির্মাণ করেন। অযোধ্যায় গিয়ে সরযূ নদীর তীরে দাঁড়াবো এরকম ইচ্ছা অনেক দিনই ছিল। ২০২২ সালে পুজোর পর বেনারস হয়ে সপরিবার অযোধ্যা গেলাম। এই শহরে বহু হিন্দু তীর্থযাত্রী প্রতি বছর আসে। রাম জন্মভূমি অযোধ্যার অনেক মন্দির তীর্থযাত্রীদের আকর্ষণের বিষয়। উত্তরপ্রদেশে ফৈজাবাদ জেলার এই প্রাচীন শহর বর্তমানে বহুগুণে সম্প্রসারিত হয়েছে। বুকিং ডট কম থেকে বুকিং করে অযোধ্যায় আমরা জয়পুরিয়া নামক গেস্টহাউসে দুদিনের জন্য ছিলাম।
আরও পড়ুন:

উৎসব-মুখর মথুরা: জন্মাষ্টমী উপলক্ষে ব্রজভূমি দর্শন /১

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৮: মুখে হাসি ফোটানোর দায়িত্বে ‘বসু পরিবার’ [১১/০৪/১৯৫২]

ইংলিশ টিংলিশ: জানো কি ‘বাজি ফাটানো’ কিংবা ‘মোমবাতি জ্বালানো’র ইংরেজি কী?

রামায়ণ অনুযায়ী শ্রীরামের জন্মভূমির স্থানে নির্মিত হচ্ছে নতুন মন্দির। মন্দির নির্মাণের তত্ত্বাবধান করছে শ্রীরাম জন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র। ২০২০সালের ৫ আগস্ট ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দ্বারা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তটি স্থাপিত হয়। রাম মন্দিরের মূল নকশাটি ১৯৮৮ সালে আহমেদাবাদের সোমপুরা পরিবার তৈরি করেছিলেন। মন্দিরের প্রধান স্থপতি চন্দ্রকান্ত সোমপুরা। তাঁকে তাঁর দুই ছেলে স্থপতি নিখিল সোমপুরা ও আশিস সোমপুরা নকশায় সাহায্য করেন। মূল নকশা পরিবর্তন করে একটি নতুন নকশা ২০২০ সালে তাঁরা বাস্তুশাস্ত্র ও শিল্পশাস্ত্র অনুযায়ী তৈরি করে। উত্তর ভারতীয় মন্দির স্থাপত্যের গুজরা-চৌলুক্য শৈলীতে নকশা করা হয়েছে। মূল মন্দির চত্বরে সূর্যদেব,গণেশ, মহাদেব, দুর্গা,বিষ্ণু ও ব্রহ্মার মন্দিরও নির্মিত হবে। শ্রীরামচন্দ্রের শিশু রূপ রামলালা রামজন্মভূমি মন্দিরের প্রধান দেবতা।

আমাদের গেস্টহাউস থেকে পায়ে হাঁটা পথ ধরে পৌঁছে স্থানীয় পুলিশ ও কমান্ডো বাহিনীর সতর্ক প্রহরার মধ্যে কিছুটা লাইন দিয়ে আমরা রামলালার জরি ও রত্নখচিত সুন্দর বিগ্রহ দর্শন করলাম। পাশে লোহার রেলিং ও মাথার ওপর জাল দিয়ে ঘেরা পথ ধরে একদিক দিয়ে দর্শনার্থীরা প্রবেশ করছেন এবং অন্য দিক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। ভজনসঙ্গীতের রেকর্ডের সুরে পরিবেশ আরো সুন্দর হয়ে ওঠে। দর্শনকারীদের ফোন, ব্যাগ, ঘড়ি, ছাতা, ক্যামেরা কোন কিছু নিয়ে ওখানে প্রবেশ নিষেধ। ওই পথে এক স্থানে প্রাচীন মন্দিরের ভাঙা পাথরের ধ্বংসাবশেষগুলো চোখে পড়ে, যেগুলো সমবেত ভাবে রাখা আছে। প্রতিটি পাথরেই সুন্দর স্থাপত্যের নিদর্শন লক্ষিত হয়। প্রাচীন মন্দিরটি আণুমানিক ১২ শতাব্দীর।

কনক ভবনের বিগ্রহ।

রামলালা দর্শনের পথে স্থানীয় লোকশ্রুতি অনুযায়ী ‘মাতা সীতা কি রসোই’ নামক স্থানে একটি মন্দির দেখেছি, যেখানে সীতা প্রথম রান্না করেছিলেন বলে কথিত আছে। মন্দিরটিতে রাম সীতার সুন্দর বিগ্রহ শোভিত। রামলালার মন্দির ছাড়াও ছিয়াত্তরটি সিঁড়ি সমন্বিত হনুমানগড়ি মন্দিরটি বিশেষ প্রসিদ্ধ। দশম শতাব্দীর মন্দির এটি। মন্দিরে মা অঞ্জনির ক্রোড়ে বালক হনুমানের মূর্তি দেখতে পেলাম, যা বাৎসল্য রসের প্রতীক। মন্দিরটি রামানন্দী সম্প্রদায়ের বৈরাগী মহান্ত এবং নির্বাণ আখরার দ্বারা পরিচালিত। রামজন্মভূমি মন্দিরের নিকটেই-এর অবস্থান। অযোধ্যার নবাব ১৮৫৫ সালে এই মন্দিরটিকে সুরক্ষিত করেন। পৌরাণিক তাৎপর্য ও ভক্তিরসের মহিমার জন্য অসংখ্য তীর্থযাত্রীর সমাগম লক্ষিত হয়। এখানকার বিশেষ উৎসব হিসাবে রামনবমী, দশেরা ও দীপাবলি প্রসিদ্ধ। এই মন্দিরের বিগ্রহের ছবি তোলা নিষেধ।
আরও পড়ুন:

ছোটদের যত্নে: কোন সময় গর্ভধারণ করলে সুসন্তান লাভ সম্ভব? নব দম্পতির মা হওয়ার আগের প্রস্তুতির পরামর্শে ডাক্তারবাবু

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৮: মেয়ের জন্য হেমন্তবালা কবির পরা জোব্বা নিয়েছিলেন

গল্প: পরশ

আমাদের গেস্টহাউস থেকে অযোধ্যার পুরোনো গলিপথ ধরে কনকভবন ও দশরথমহল ইত্যাদি নানান দ্রষ্টব্য স্থানে পৌঁছে গেলাম। অযোধ্যার পুরোনো বাড়িগুলো সারিবদ্ধ ভাবে গায়ে গায়ে অবস্থিত। অযোধ্যার রামকোট স্থিত দশরথ মহল অর্থাৎ দশরথের রাজমহল, যাকে এক সিদ্ধপীঠ বলে মনে করা হয়। বৈষ্ণব পরম্পরার সিদ্ধপীঠও এটি। ত্রেতা যুগে দশরথ এই মহল স্থাপন করেন। এই পৌরাণিক ভবনটি কয়েক বার সংস্কার করে পুনরায় নির্মাণ করা হয়েছে। রামের বিবাহ, দীপাবলি, শ্রাবণমেলা, চৈত্র রামনবমী এবং কার্তিক মেলা উৎসাহ সহ এখানে পালিত হয়।

বর্তমানে পবিত্র রাম মন্দির রূপে দশরথ মহল লক্ষিত হয়। এখানে রাম, সীতা, লক্ষণ, শত্রুঘ্নর মূর্তি পূজিত হয়। প্রধান প্রবেশ দ্বার দিয়ে প্রবেশ করে দ্বিতীয় দরজা এবং ভেতরে কারুকার্য খচিত রঙিন দেওয়াল গাত্র সমন্বিত ভবনটির শোভা অনিন্দ্য সুন্দর। আমরা মন্দিরে এক কিশোরকে হারমোনিয়াম বাজিয়ে ভজন সঙ্গীত পরিবেশন করতে দেখি। ভক্ত সমাগমও ছিল লক্ষ্যণীয়। অযোধ্যায় সব মন্দির এবং রাস্তায়, গলিতে অসংখ্য বাঁদর ঘুরে বেড়ায়। কোন পর্যটক অন্যমনস্ক হলে জিনিসপত্র হাত থেকে কেড়ে নেয়। তাই সতর্ক হয়ে চলতে হয়।

হনুমান গড়ি মন্দির।

রামলালার মন্দিরের সন্নিকটে কনকভবন দর্শন করেছি। অন্তঃপুরের মহল সহ সুদৃশ্য ভবনটি নির্মাণের পর বহুবার ভেঙে ধ্বংস করা হয়। ১৮৯১ সালে বৃষভানু কুবারী (মধ্যপ্রদেশের টিকমগড়ের রানি) দ্বারা পুনরায় নির্মিত হয়। লোকশ্রুতি আছে ভবনটি রামের সঙ্গে সীতার বিবাহের পর কৈকেয়ী সীতাকে উপহার দেন। মন্দিরের গর্ভগৃহে রামচন্দ্র ও সীতা ও রামের ভাইদের স্বর্ণমুকুট পরিহিত সুন্দর মূর্তি দৃষ্ট হয়। ভবনটির উজ্জ্বল রঙ সোনার ভবনের কথা মনে করিয়ে দেয়। কৈকেয়ী সীতার বসবাসের জন্য জন্য কনকভবনের মতো সুন্দর গৃহ স্বপ্নে দেখে দশরথকে অবহিত করেন এবং গৃহনির্মাণের কথা ব্যক্ত করেন। —চলবে

Skip to content