বারবিকিউ করার জায়গা।
কোভিড বিধিসহ ইঁদুর দৌড়ের ব্যস্ত জীবনে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম বেশ কিছুদিন ধরেই। অনেকদিন ধরেই মনে মনে ভাবছি কোথাও ঘুরে আসি। অথচ সময় হাতে নেই। কাছেপিঠে যদি কোথাও একটু ঘুরে আসা যেত একদিনের জন্য, একটু যদি বুক ভরে নেওয়া যেত বিশুদ্ধ অক্সিজেন—তাহলে বড় ভালো হত। ভাবতে ভাবতেই গুগলে সন্ধান মিলল সুন্দরগ্রামের। গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। কলকাতার কেন্দ্রস্থল থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে রাজেন্দ্রপুরে সুন্দরগ্রাম একটি ইকো ভিলেজ। দিগন্তবিস্তৃত সবুজ ধানখেতে ঘেরা রিসর্টটিতে দূষণমুক্ত নির্মল গ্রাম্য জীবনের স্বাদ। স্বল্প সময়ে শহুরে জীবনের চাপ কমাতে সুন্দরগ্রাম একদম আদর্শ। এখানকার শান্ত সহজ গ্রাম্যজীবন আপনাকে দেবে বিশুদ্ধ অক্সিজেন। সিটি সেন্টার টু থেকে প্রায় ২৭ কিলোমিটার এর দূরত্ব। সকাল দশটায় আমরা রওনা দিলাম। ঘটকপুকুর হয়ে সুন্দরগ্রাম পৌঁছতে লাগল প্রায় দেড় ঘণ্টা। সুদৃশ্য কাঠের গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই পল্লিবাংলার চোখজুড়ানো পরিকল্পনা চোখে পড়ল। এখানে অতিথিদের জন্য পাঁচটি ডবল বেডরুম এবং দুটি পারিবারিক কক্ষ আছে। আকাশ, বাতাস, ধামসা, মাদল, একতারা, দোতারা আর বোধি নামে নামাঙ্কিত এই কক্ষগুলি খড়ের ছাউনি দেওয়া মাটির ঘরের আদলে তৈরি।
ভোজনালয়।
আগেই বুকিং করে নিয়েছিলাম। এই রিসর্টটি থেকে বাজারের দূরত্ব বেশ অনেকটাই। হয়তো সেই কারণেই আগের দিন বা পৌঁছনোর দিন খুব সকালেই লাঞ্চের অর্ডার করে দিতে হয়। গাড়িতে যেতে যেতে আমরা দুপুরের মেনু ঠিক করে অর্ডার করে দিলাম। রিসর্টে ঢুকে সমস্ত ফর্মালিটিস পূরণ করে অন্দরমহলে গেলাম নিজেদের জিনিসপত্র রাখতে। সুদৃশ্য কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে অন্দরমহলে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল বাঁশ, তালপাতা ও শীতলপাটির অভিনব অন্দরসজ্জা। আধুনিক ডিভানটিকে সুন্দর করে বাঁশ দিয়ে পরিবেষ্টিত করা হয়েছে; আপাতদৃষ্টিতে দেখে মনে হয় যেন বাঁশের নির্মিত শয্যা। গ্রামের মাটির বাড়ির মতন করে তৈরি হলেও এই কক্ষগুলির ভেতরে রয়েছে আধুনিক সমস্তরকমের সুবিধা—এসি, গিজার ইত্যাদি। স্নান করে ফ্রেশ হয়ে কক্ষের লাগোয়া কাঠের ছোট্ট সুদৃশ্য ব্যালকনিতে বসলাম। চারদিকে শুধু চোখ জুড়ানো সবুজ ধানখেত। কোনও ব্যস্ততার চিহ্নমাত্র নেই কোথাও। দুপুর দেড়টায় লাঞ্চের টাইম। এখানে এসেই টিনটিন এমন সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রাণ ভরে শ্বাস নিচ্ছে, খেলছে, দৌড়াচ্ছে, দোলনায় চড়ছে। দুপুর দেড়টার সময় ওকে নিয়ে লাঞ্চ করতে গেলাম। এখানকার খাবার ঘরটিও খুব সুন্দর। উপরে খড়ের ছাউনি, গাছের গুঁড়িগুলোকে কেটে কোনওরকম ফিনিশিং না করেই একটা ন্যাচারাল লুক দিয়ে বসার জায়গাগুলো তৈরি। হাত ধোয়ার জায়গাটিও অভিনব। মাটির থালায় সুন্দর করে খাবার পরিবেশন হল। ঝুরি ঝুরি আলুভাজা, ভেজ ডাল, চিকেনকারি, বেগুনভাজা। স্যালাড পরিবেশনের পাত্রটিও নজর কেড়ে নেয়। ছোট্ট গাছের গুঁড়ি কেটে তৈরি এই পাত্রটি দেখে মনে হয়, একটুকরো কাঠের ওপর সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে শসা, পেঁয়াজ, লেবু। শেষপাতে মিষ্টি দই না হলে বাঙালির কি জমে! ছোট পুকুরে মাছের ঝাঁক, কচ্ছপ দেখতে দেখতে মধ্যাহ্নভোজন শেষ হল। ভূরিভোজের পর কক্ষে প্রবেশ করলাম। চারদিকে পাখির ডাক আর এমন স্নিগ্ধ পরিবেশে চোখ জুড়ে ঘুম নেমে এল। যখন ঘুম ভাঙল ঘড়িতে বিকেল পাঁচটা। ধানখেতের শেষপ্রান্তে সূর্য বিদায় জানাচ্ছে। চা খেয়ে আমরা রওনা দিলাম বনবীথির উদ্দেশ্যে।
সন্ধ্যার চাদরে প্রকৃতি যেন ঢেকে দিচ্ছে গ্রামকে। বনবীথিতে আমরা যখন পৌঁছলাম, তখন চারদিকে অন্ধকার। এই রিসর্টটিও উইকেন্ড ট্যুরের পক্ষে আদর্শ। সুইমিং পুল, বাচ্চাদের খেলার বিভিন্ন সরঞ্জাম, ছোট ছোট চৌবাচ্চায় কচ্ছপ, আমবাগান—সবকিছু দিয়েই বেশ সাজানো-গোছানো। তবে কোথাও যেন কৃত্রিমতার ছোঁয়া বড্ড বেশি চোখে পড়ল। আমগাছ থেকে ঝুলন্ত মই নেমে এসেছে মাটিতে। সেই মই দিয়ে আমার মেয়ে টিনটিন গাছে উঠতে শুরু করে দিয়েছে। সুদৃশ্য ট্রি হাউসে আলো জ্বলছে। বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে আমরা ফিরে এলাম সুন্দরগ্রাম। তখন রাত ৮টা। ঝিঁঝি পোকার ডাক পরিবেশটাকে অন্যরকম করে তুলেছে। ব্যালকনিতে বসলাম। ঠান্ডা হাওয়া আর অন্ধকারের মাঝে ছোট ছোট আলোর বিন্দু—সহজ, সরল, অনাড়ম্বর ; তবু বড় চিত্তাকর্ষক। কোনও এক জাদুকাঠির ছোঁয়ায় সময় যেন এখানে বড় মন্থর। রাত নটায় আমরা ডিনার করতে গেলাম। খাবার জায়গাটিতে বৈদ্যুতিক আলো পাটের দড়ি দিয়ে মোড়ানো। আসলে সুন্দরগ্রামের সমস্ত ব্যবস্থাপনাই গ্রামের মোড়কে মোড়ানো আধুনিক জীবনের ছবি। তবু প্রকৃতির স্পর্শ এখানে এতই গভীর যে, শহুরে কৃত্রিমতা বিন্দুমাত্র নেই। ডিমের কারি, ঝুরো আলুভাজা, ডাল, স্যালাড সহযোগে রাতের খাওয়া বেশ ভালোই হল। ফিরে এলাম ঘরে। আলো নিভিয়ে প্রকৃতির চুপকথা শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই।
চড়াই আর ঘুঘুর ডাকে ঘুম ভাঙল ভোর পাঁচটায়। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে দেখি চাষিরা চাষ করছে মাঠে। চাষিবউরাও হাত লাগিয়েছে কাজে। তাদের ঝুঁকে পড়া শরীরী বিভঙ্গে, সবুজের সমারোহে, পাখির কূজনে, নীরব ভৈরবী বেজে চলেছে। রিসর্ট থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম বেশ কিছুটা পথ। দু’ধারে ধানখেত, মাঝে একটু জল, মাছ খেলা করছে সেখানে। কিছুটা দূরেই ইটভাটা। সকালের শান্ত পরিবেশ। এখানে কর্মমুখরতা আছে, কর্মব্যস্ততা নেই। এখানকার মানুষের প্রত্যহযাপনে সেই নির্ভেজাল ব্যস্ততাহীন, প্রতিযোগিতাহীন প্রশান্তির ছবি। সকাল ন’টায় লুচি, আলুর তরকারি, পান্তোয়া আর ডিমসেদ্ধ দিয়ে জলযোগ পর্ব শেষ হল। টিনটিন খেল ব্রেড অমলেট। এবার ফেরার পালা। মহানগরের ব্যস্ততায় ডুবে যাওয়ার সময় এগিয়ে আসছে ক্রমশ। গাড়িতে উঠে বসলাম।
চড়াই আর ঘুঘুর ডাকে ঘুম ভাঙল ভোর পাঁচটায়। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে দেখি চাষিরা চাষ করছে মাঠে। চাষিবউরাও হাত লাগিয়েছে কাজে। তাদের ঝুঁকে পড়া শরীরী বিভঙ্গে, সবুজের সমারোহে, পাখির কূজনে, নীরব ভৈরবী বেজে চলেছে। রিসর্ট থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম বেশ কিছুটা পথ। দু’ধারে ধানখেত, মাঝে একটু জল, মাছ খেলা করছে সেখানে। কিছুটা দূরেই ইটভাটা। সকালের শান্ত পরিবেশ। এখানে কর্মমুখরতা আছে, কর্মব্যস্ততা নেই। এখানকার মানুষের প্রত্যহযাপনে সেই নির্ভেজাল ব্যস্ততাহীন, প্রতিযোগিতাহীন প্রশান্তির ছবি। সকাল ন’টায় লুচি, আলুর তরকারি, পান্তোয়া আর ডিমসেদ্ধ দিয়ে জলযোগ পর্ব শেষ হল। টিনটিন খেল ব্রেড অমলেট। এবার ফেরার পালা। মহানগরের ব্যস্ততায় ডুবে যাওয়ার সময় এগিয়ে আসছে ক্রমশ। গাড়িতে উঠে বসলাম।
প্রকৃতির উজাড় করা ভালোবাসা।
গ্রামের ভিতরে এক অন্যরকম গ্রাম সুন্দরগ্রাম। এখানে মেনিকিওরড লন, কৃত্রিম পুকুর (যেখানে মাছ ধরতে পারেন, হাঁসের ঘর থেকে হাত দিয়ে ডিম বার করতে পারেন অতি স্বল্প মূল্যের বিনিময়ে) বারবিকিউ, পূর্ব সূচনা সহযোগে বাউল গানের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শীতকালে খেজুরের রস আর সুন্দরগ্রাম থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে মালঞ্চের কাছে বিদ্যাধরী নদীর সূর্যাস্ত উপভোগ করতে পারেন। আধুনিক সুযোগ সুবিধা সহ মাটির ঘরে সাজানো রিসর্টটি। ব্যস্ত শহরজীবনের বাইরে নির্ভেজাল বিরতি উপভোগে সুন্দরগ্রাম ইকো ভিলেজ আপনাদের মুগ্ধ করবেই।
কীভাবে যাবেন
সায়েন্স সিটি থেকে বাস বা ম্যাজিক ভাড়া করে ঘটকপুকুর বাজার, তারপর সেখান থেকে টোটোতে সুন্দরগ্রাম পৌঁছে যেতে পারেন। এছাড়াও প্রাইভেটকারে কলকাতা থেকে খুব সহজেই পৌঁছে যেতে পারেন সুন্দরগ্রাম। বিস্তারিত জানতে ওয়েবসাইট দেখে নিতে পারেন।
ছবি: লেখক
যোগাযোগ: ৯০৫১০৬৪৫১০
সায়েন্স সিটি থেকে বাস বা ম্যাজিক ভাড়া করে ঘটকপুকুর বাজার, তারপর সেখান থেকে টোটোতে সুন্দরগ্রাম পৌঁছে যেতে পারেন। এছাড়াও প্রাইভেটকারে কলকাতা থেকে খুব সহজেই পৌঁছে যেতে পারেন সুন্দরগ্রাম। বিস্তারিত জানতে ওয়েবসাইট দেখে নিতে পারেন।
ছবি: লেখক
যোগাযোগ: ৯০৫১০৬৪৫১০
বাইরে দূরে
লেখা পাঠানোর নিয়ম : এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে বেশ কিছু ছবি ও ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ পাঠাতে হবে। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না। ইমেল : samayupdatesin.writeus@gmail.com