রবিবার ২১ জুলাই, ২০২৪


"মুখর দিনের চপলতা-মাঝে স্থির হয়ে তুমি রও"

‘পথ আমারে শুধায় লোকে পথ কি আমার পড়ে চোখে’—এই হবে যার মনের দশা সে তো ছুটবেই পথের তোয়াক্কা না করেই! আর অমনিই সব চেনাপথের আগলহীন গল্পকুটির কুড়িয়ে নেবে সে পথভোলাকে, তারপর?
কী আর?
গল্প গল্প এবং গল্প!!
সেই গল্পই বলি আজ তবে একটা।

মেদিনীপুর জেলাসদরের দশ কিলোমিটারের মধ্যেই আছে এমন এক নিশ্চিন্দিবোনা গল্পের দেশ। সেখানে কাঁসাই নদীর চিকচিকানির পাশ দিয়ে সমান্তরালে বইছে আবহমান এক জনপদ, ‘একই বৃন্তে দুটি কুসুম’—এই ছেলেমানুষি বিশ্বাস এখনও যেন কেমন করে বিশ্বস্ত সে অবাক-করা দেশটায়!

দেশ? হ্যাঁ তো! যেখানে বিশু দোলুই আর সাবিয়া খাতুন নামের দুই পাড়াতুতো ভাইবোনে পুরোনো শ্যাওলা ধরা মন্দিরের আঙিনায় দাঁড়িয়ে সমান গর্বের সুরে বলে ওঠে, ‘এই আমাদের খেলার ঘর, এ যে কী সুন্দর ছিল আরও, চলো দেখাই?’—সে জায়গাটা এই আমাদের রাজনৈতিক মানচিত্রে গড়া চেনা দেশের মধ্যে আঁটে কি? কক্ষনো না।

"স্তব্ধ অতীত, হে গোপনচারী..."

তাই তো এই ধুলোবালির চোখজোড়া ওই কাঁসাইয়ের জলে ধুয়েমুছে তকতকে হয়ে দাঁড়ায় তার সামনে হাত পেতে—পাথরা, মুছে আসা মন্দিরগাঁ, পাঁচশোরও বেশি বছর ধরে মুছতে থাকা গপ্পোজমিন এক, যাবে তো চলোওওওও…

গপ্পোকথায় জানা যায় সেই এক যে ছিল গুপ্তরাজার দিনে, বাংলাদেশের যখন সত্যিই ছিল সুবর্ণযুগ, তখন এই মেদিনীপুরের তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে কতশত চাঁদবেনের সপ্তডিঙা ভাসত এদিক-সেদিক। সে সময়ের সেই বর্ধিষ্ণু মেদিনীপুরের নাকের ডগায় এই জনপদের বেশ রমরমা ছিল। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি নবাব আলিবর্দি খান এখানকার এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি বিদ্যানন্দ ঘোষালকে রাজস্ব আদায়ের ভার দেন। সেই তিনিই নাকি যথাসময়ে রাজস্ব জমা না দিয়ে নিজের মতো করে এই অঞ্চলে বিভিন্ন দেবালয় গড়ে তুলে নবাবের বিরাগভাজন হন। নবাবের আদেশে তাঁকে হাতির পায়ের নীচে ফেলে পিষে মারার দণ্ড দেওয়া হলেও হাতি নাকি পিষে দেওয়ার পরিবর্তে পা উঠিয়ে নেয়, সেই ‘পা উৎরা’—থেকেই এ জনপদ পাথরা নামে খ্যাত হয়।

ইতিহাস চেতনা যেন এক পাখির মতন...

আবার, এখানে আড়াইশো বছর আগে গড়ে ওঠা পোড়ামাটির ছোট ছোট ইটে আর পাথরে গড়া মন্দিরগুলি দেখতে দেখতে ‘পাথরা’ নামটি হয়তো পাথুরে মন্দির থেকে এসেছে বলেই হতে পারে যেকোনও অবাকচোখো ভ্রামণিকের। তা জনশ্রুতি বা দর্শনেন্দ্রিয় এই দুই চিরাচরিত চক্ষুকর্ণের বিবাদে না গিয়েও বলা যায়—’আহা কী দেখিলাম!’

এই মুচমুচে শীতের দিনে মেদিনীপুর শহর থেকে হাতিহাল্কার দিকে যেতে যেতে ছোটখাট যেকোনও চা-ব্যাপারীই বলে দেবেন—’মন্দিরগাঁ তো, হুইইইই সুজ্জাআআআ চলি যান!’
হ্যাঁ, তাঁরা অধিকাংশই মসজিদের আরাধনার মানুষ, কিন্তু সরলরৈখিক ইতিহাসচেতনার কোনও ফাটল চোখে পড়বেই না এই দশ কিলোমিটার পথে—সে চেতনা শিকড়ের গন্ধের যে!
রাসমন্দির, কাছারিবাড়ি, আটচালা, শিবমন্দির, তুলসীমঞ্চ— ইতিহাস শ্যাওলা তুচ্ছ করে ফিসফিসোয় বিগ্রহবিহীন, অথবা আশপাশে পায়েল-গণেশ-হাঁদু দোলুইদের মতো জ্যান্ত বিগ্রহী-প্রতিগ্রহীদের মুখ চেয়েই সে আবহমানের পথচলা!
বেশ লাগে ওদের কুচোজীবনের কাছে হাত পেতে দাঁড়িয়ে নিজেদের হৃতগৌরবের কাহিনি শুনতে।
নাই-বা হল সেসব তথ্যে সত্যে পরিপাটি,

‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে গড়া’, অনুভবটি এ জীবনে একবার তো উপলব্ধি চিনুক!
যদি সেই উপলব্ধির মুখ চিনতে চান কেউ, সেই দুরাশায় রইল তার হালহদিশ— রেখাচিত্রে, আলোছায়ার মায়ায়…

ছবি ও ভিডিও ক্লিপ : লেখক

বাইরে দূরে

লেখা পাঠানোর নিয়ম : এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে বেশ কিছু ছবি ও ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ পাঠাতে হবে। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না। ইমেল : samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content