মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪


মহানদীকে সঙ্গে করে যেতে যেতে কখন যে ছত্রিশগড়ে সড়কের দু’ পাশের বনভূমিতে প্রবেশ করে যাবেন আপনি টেরও পাবেন না। ঝকঝকে রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে হঠাৎ দূরে চোখে পড়বে ছোট্ট একটি পাহাড় আর জলাভূমি, মনে হবে এ আর কি! কিন্তু যত কাছে যাবেন জঙ্গলের ঘনত্ব বাড়তে থাকবে আর দেখতে দেখতে পৌঁছে যাবেন কুডার ড্যামের কাছে।
আগেই বলেছি ছত্রিশগড় এমন একটি রাজ্য, যে রাজ্যে সবচেয়ে বেশি ঝর্ণা এবং ড্যাম আমার দেখা; অন্তত চোখে পড়ে এবং নদী বলতে তো মহানদী এবং ইন্দ্রাবতী। কিন্তু এত ড্যাম, ছোট ছোট নদী বিভিন্ন জায়গায়, তার স্থানীয় নাম এবং সেই স্থানীয় নাম অনুযায়ী ড্যামগুলির নাম অথবা গ্রামের নাম অনুযায়ী ড্যামগুলির নাম। কুডার ড্যাম এমন নিস্তব্ধ একটি ড্যাম যে, যেখানে দাঁড়িয়ে শুধু আপনি এবং সে আপনার সঙ্গী। তাছাড়া একটি জনমানুষের দেখা আপনি পাবেন না। যখন গিয়েছিলাম, সেদিন আমি আর আমার বাহন চালক ছাড়া সেখানে আর কেউ ছিল না। নিস্তব্ধ ড্যামের জলে একটি পাতা পড়লে তার শব্দ যেন আপনার কানে বিশেষ আকর্ষণ তৈরি করছে। ড্যামের কাছাকাছি একটি মন্দির সেখানে দশেরা উপলক্ষে স্থানীয় জনজাতির স্থানীয় আদিবাসীদের ভিড়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মন্দিরটি দুর্গা কৃষ্ণ ইত্যাদির। আলাদা কোনও বিশিষ্টতা নেই। কিন্তু মন্দিরের চাতালে উঠলে আপনি কুডার ড্যামের আরেকটি অন্য দৃশ্য দেখতে পাবেন। মন্দির এবং কুডার ড্যামের লাল মাটির রাস্তা থেকে বেরিয়ে এসে আবার মূল সড়কপথে উঠলে আপনি চলে আসবেন ভোরামদেব অভয়ারণ্য এলাকায়। মহাসমুন্দ জেলার শিরপুরে।
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-৬: প্রকৃতি নিয়ে পর্যটন

জ্যোতির্লিঙ্গ যাত্রাপথে, পর্ব-৪: কাশীর পথে-ঘাটে

শিরপুর রায়পুর থেকে মোটামুটি ৬৫ কিলোমিটার দূরে, পুরনো দক্ষিণ কোশলের রাজধানী শ্রীপুর বা শিরপুর সপ্তম শতকে নির্মিত। শিরপুরের খ্যাতি মূলত বৌদ্ধ বিহারের জন্য। অনেক অনেক বৌদ্ধ বিহার আছে। কিছু আগে পাওয়া গিয়েছে ২০০৩, ২০০৪, ২০০৫, ২০০৬, ২০১২ সাল পর্যন্ত খনন করা প্রচুর বৌদ্ধ বিহারের নিদর্শন এখানে পাবেন। মূল সড়ক থেকে শিরপুরের রাস্তায় আপনি প্রবেশ করলেন, দু’পাশে জঙ্গল বেড়ে যাচ্ছে আর ঝকঝকে রাস্তা আপনাকে আকর্ষণ করছে। মাঝে মাঝে নাম না জানা অজানা পাখির ডাক, একটু বৃষ্টি তার থেকে আরেকটু বেশি বৃষ্টি, বৃষ্টির এক অন্য আওয়াজ। শুনশুন থেকে শো শো আওয়াজ আপনার মনকে মুগ্ধ করবেই।
শিরপুরের বিশিষ্টতা নিয়ে আলোচনা করবার আগে যে জিনিসটা বলা দরকার সেটা হচ্ছে এর অবস্থানগত তাৎপর্য। ভারত ইতিহাসের ভৌগোলিক মানচিত্রে শিরপুর কে উল্লেখযোগ্য স্থান দেওয়া উচিত। এবং ভ্রমণার্থী ও দর্শনার্থীদের জন্য তার নানা রকম সুযোগ-সুবিধে ছত্রিশগড় পর্যটন করে রাখলেও যাতায়াতের ব্যবস্থাটি কিন্তু মোটেই সহজলভ্য নয়। আপনার সঙ্গে যদি চারচাকা থাকে বা দু’ চাকা থাকে তবেই আপনি শিরপুরের মূল কোর এলাকায় ঢুকতে পারবেন। স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে কথা বলার মাধ্যমে জেনেছি যে, খুব প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য তাদের যেতে হলে ১৭ কিলোমিটার এসে মূল রাস্তার থেকে মহাসমুন্দ কিংবা রায়পুরে যেতে হয়। স্কুল আছে হায়ার সেকেন্ডারি পর্যন্ত। সেখানকার মাস্টারমশাইরাও মহাসমুন্দ বা রায়পুর থেকে এসে তারপর নিজস্ব ব্যবস্থায় শিরপুরে আসেন। স্থানীয় পরিবহন বলতে ব্যক্তিগত মোটরসাইকেল, ব্যক্তিগত সাইকেল অন্য কিছু নেই।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৬: বাড়িতে ঢুকে জুতো মজা দস্তানা খুলে প্রথমেই দেখলাম ‘ফ্রস্টবাইট’ হয়ে গিয়েছে কিনা!

নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে, পর্ব-৩০: গিরিশ ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমার মনের বাঁক যাবে তো?” ঠাকুর বললেন, “যাবে, ঠিক যাবে”

অধিবাসীদের মূল জীবিকা বনের কাঠ সংগ্রহ এবং কৃষি। কৃষি মানেই ধান। আমি আগেই বলেছি ছত্রিশগড়ে প্রচুর ধান চাষ হয়। তার সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে কিছু ভুট্টা এবং ভেন্ডি মানে ঢেঁড়স। অথচ জায়গাটি মহানদীর পারে চমৎকার অঞ্চল। মহানদীর সূর্যাস্ত শিরপুরের বসে দেখা, সেও এক চমৎকার অভিজ্ঞতা। স্থানীয় অধিবাসীদের জীবনধারণ খুব একটা সুখকর নয় রোজকার খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করতে তাদের কাল ঘাম ছোটে। এক বেলা বা দু’ বেলার জন্য আপনি যদি শিরপুরে থাকেন প্রয়োজনীয় বস্তু সামগ্রী আগের থেকে না বলে রাখলে আপনার কাছে সহজলভ্য হবে না।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৭: যত কাশি, তত কাফ সিরাপ?

হেলদি ডায়েট: ডার্ক চকোলেট হার্টের অসুখ-সহ নানা রোগের দাওয়াই, কতটা খাবেন, কেন?

এমনকি ২০২২ সালে সামান্য বিস্কুট সংগ্রহ করতে পারিনি। মন্দির, মন্দিরকে কেন্দ্র করে ফুলমালা বিক্রি ইত্যাদি আর পর্যটনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় অধিবাসীরা গাইডের কাজ করে, সেই গাইড হিসেবে যতটুকু পয়সা পাওয়া যায়। আহার্য বস্তু আপনাকে সীমার মধ্যে রাখতে হবে, চাইলেও তারা আপনাকে অন্য কিছু দিতে পারবে না অথবা অনেক আগে বলে রাখতে হবে। হাট দু’দিন বসে। সেই দু’দিন তারা তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করে রাখে।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-২: এসেছে দৈব পিকনিকে

হেলদি ডায়েট: অ্যাডিনোভাইরাসের প্রকোপ বাড়ছে শিশুদের মধ্যে! ভাইরাস এড়াতে খুদের পাতে কী কী রাখবেন?

শিরপুরের বৌদ্ধবিহারগুলো নিয়ে আলোচনার করার আগে আরেকটি জিনিস আলোচনা করতে চাই আমাদের ধারণা একমাত্র পশ্চিমবঙ্গের বিষ্ণুপুরে অন্যতম ইটের মন্দির আছে কিন্তু তা নয়। ভারতের অন্যতম বিখ্যাত ইটের তৈরি লক্ষ্মণ মন্দির শিরপুরেই অবস্থিত। শিরপুরে আরও অনেক প্রাচীন মন্দির আছে। ওই যে বললাম মহানদীর পাড়ে অবস্থিত মন্দির, গন্ধেশ্বর মহাদেবের মন্দির তার মধ্যে অন্যতম। মন্দিরটি সাদামাটা কিন্তু তার ভৌগোলিক অবস্থানটি চমকপ্রদ। মকর সংক্রান্তির পুণ্য স্নানে এখানে অনেক লোক আসে।

ছবি: লেখিকা
* চেনা দেশ অচেনা পথ (Travel Offbeat): লেখক— অর্পিতা ভট্টাচার্য (Arpita Bhattacharya), অধ্যাপিকা, বাংলা বিভাগ, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ। শৈলীবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। বর্তমান আগ্রহ ও কাজ ভ্রমণ-সাহিত্য, ইকো-ট্যুরিজম, কালচার ট্যুরিজম, স্মৃতিকথা নিয়ে। এছাড়াও মুক্তগদ্য চর্চা ভালো লাগার জায়গা। এখন পর্যন্ত প্রকাশিত ৫টি গ্রন্থ এবং ৫০ টিরও বেশি প্রবন্ধ। সম্পাদনা করেছেন একটি বই এবং ধারাবাহিক সম্পাদনা করেন রবীন্দ্রনাথ টেগোর অ্যাডভান্সড রিসার্চ সেন্টারের জার্নাল।
 

বাইরে দূরে

লেখা পাঠানোর নিয়ম: এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। লেখার সঙ্গে বেশ কিছু ছবি পাঠাতে হবে। চাইলে ভিডিও ক্লিপও পাঠাতে পারেন। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content