রায়পুর থেকে ১৪০ কিলোমিটার দূরে কবীরধাম জেলায় রয়েছে ভোরামদেও অভয়ারণ্য। কাওয়ারধা থেকে এই অভয়ারণ্যে যাবার জন্য রাস্তা রয়েছে। সবচেয়ে মজার কথা এই অভয়ারণ্য পেরোলেই আপনি পেয়ে যাবেন ছত্তিসগড়ের সবচেয়ে দুর্গম পথ সম্বলিত চিল্পিঘাটি। এখানে হায়না, লেপার্ড পাওয়া যায়, ভালুক পাওয়া যায়। গভীর অরণ্য। দিনের বেলায়ও অনেক জায়গায় একফোঁটা আলো পাওয়া যায় না। তার মাঝখান দিয়ে যেতে গেলে বুকের ভিতরটা হঠাৎ করে ধক করে ওঠাটা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। আমার অন্তত হয়েছিল তাই।
১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে স্বীকৃতি পায় গোমরদা অভয়ারণ্য। রায়গড় জেলার স্বর্ণগড়ের কাছে ২৭৫ বর্গকিমি আয়তনবিশিষ্ট এই অভয়ারণ্য জীব বৈচিত্র্যে অতুলনীয়। নীলগাই, সম্বর, গাউর, বুনোমোষ, চৌবিঙ্গ এখানে পাওয়া যায়। ১৯৮৩ সালে স্বীকৃতি পায় পামেদা অভয়ারণ্য, দান্তেওয়ারা জেলায় ২৬০ বর্গকিমি জুড়ে থাকা এই অরণ্যভূমির সীমায় রয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশ। অবস্থানগত কারণে অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনম থেকে এখানে আপনি তাড়াতাড়ি পৌঁছতে পারবেন, নিকটতম রেল স্টেশন কিরন্ডুল। আবার দান্তেওয়ারার পামেদা অভয়ারণ্য রাজনৈতিকভাবে অস্থির। আমরা সকলে জানি যে, যাদের আমরা ‘মাওবাদী’ বলি তাদের অবাধ বিচরণভূমি এই দান্তেওয়ারা অভয়ারণ্য। দুর্গম জঙ্গল, অসংখ্য বন্যপশুর সঙ্গে লড়াই করে জীবন কাটে এখানকার মানুষদের।
আরও পড়ুন:
চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-৩: সবুজের নেশায় অভয়ারণ্য
রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৩: বিমানবন্দর থেকে বেরিয়েই উইসকনসিনের সঙ্গে পার্থক্যটা টের পেলাম, মুহূর্তে ঠোঁট, গাল জমে যেতে লাগল
বাস্তার জেলার নারায়ণপুরে ৪০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে রয়েছে ক্রুশডেল ভ্যালি অভয়ারণ্য। এটি এখনও পর্যন্ত পর্যটকদের খুব নেক নজরে আসেনি। এবং ওই যে বলছিলাম ছত্তিসগড় ট্যুরিজম বোর্ড, তাদের ট্যুরিজম ক্ষেত্রগুলোকে সে ভাবে বিজ্ঞাপিত করার অর্থাৎ যাকে বলে ফোকাস করার সুযোগ কিন্তু সব জায়গায় সমানভাবে রাখেননি। ফলে ক্রুশডেল ভ্যালি অভয়ারণ্য কিন্তু অনেকটাই না জানা। কিন্তু মজা এখানে অনেক গুহা আছে, যে গুহাগুলোতে আপনি চাইলে এখনও কষ্ট করে ঢুকতে পারবেন। বাদালখোল অভয়ারণ্য ১৯৭৫ খ্রিস্টব্দে স্বীকৃতি পায় আর ভৈরামগড় অভয়ারণ্য ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে স্বীকৃতি পায়, জগদলপুর থেকে যাওয়া যায়। আর অন্য কয়েকটি অভয়ারণ্যও রয়েছে-বনের পথে বন-নদী আর বন্যদের সঙ্গে ওঠাবসা করে যে মানুষ সে মানুষদের খোঁজার জন্য।
আরও পড়ুন:
চলো যাই ঘুরে আসি, মধ্যপ্রদেশ বা ছত্তিশগড় নয়, আমাদের এই বাংলাতেই রয়েছেন ডোকরা শিল্পীরা
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৯: গুরুদেবের দেওয়া গুরুদায়িত্ব
ছত্তিসগড়ে বেড়াবার জন্য শীতের আগের বর্ষার আগে পর্যন্ত ঘোরাটা সঠিক সময়। বর্ষাকালটা এড়িয়ে যাওয়াই ভালো প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত হয় এবং বৃষ্টিপাতের প্রভাবেই ছত্তিসগড়ের অরণ্য মূলত ক্রান্তীয় আর্দ্র পর্ণমোচী জাতীয়। লাল মাটির ছোঁয়া আছে। গড় তাপমাত্রা গ্রীষ্মকালে বেড়ে গেলেও সাধারণভাবে খুব বেশি তাপমাত্রা এখানে হয় না। বনজ সম্পদের মধ্যে কাঠ, বিড়ি, আঠা, মহুয়া ছাড়াও নানাধরনের ফুল ফলের সমারোহ আছে। বাঁশ গাছ আছে প্রচুর। মধুও পাওয়া যায় অনেক। এই অরণ্যের এই সব সম্পদ আদিবাসী উপজাতিদের সঙ্গে সঙ্গে ছত্তিসগড়ী মানুষের অর্থনৈতিক নির্ভরতাকে অনেকটা সহজ করেছে। অবশ্য এর পাশাপাশি এখনও চলে শিকার ও কৃষিনির্ভর অর্থনীতি। কৃষি মূলত চাষ হয় ধান। ছত্তিসগড়কে ভারতের ‘রাইস বোল’ বলা যেতে পারে। ধান, ভেন্ডি, আলু আর কিছু আপনি এখানে খুব একটা পাবেন না। আর যেসব সব্জি পাওয়া যায় যেমন কুমড়ো, লাউ কেবলমাত্র আদিবাসীরাই খায়। অন্য লোকেরা প্রায় খায় না। অবশ্য আদিবাসীদের কাছে অযত্নে লালিত এই সব্জিগুলি ভাত ডালের বিকল্প। কারণ, ভাত ডাল তাদের কাছে অপ্রাপণীয়।
আরও পড়ুন:
স্বাদে-গন্ধে: সামনেই জন্মদিন? বিশেষ দিনের ভূরিভোজে বানিয়ে ফেলুন কাশ্মীরি পদ মটন রোগান জোস!
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪: আপনি কি খেয়ে উঠেই শুয়ে পড়বেন? জানেন কী হচ্ছে এর ফলে
খনিজ সম্পদে ছত্তিসগড় চিরকালই ধনী। মাটির বুকে, পাহাড়ের খাঁজে, খনির গর্ভে, নদীর চরের গভীরে এখানে কয়লা, আকরিক লোহা, তামা, ম্যাঙ্গানিজ, বক্সাইট, ডলোমাইট, স্ট্যালাকলাইট, স্ট্যাগালমাইট, অভ্র প্রচুর পাওয়া যায়। হিরের খনির সন্ধান বা সোনার সন্ধানও এখানে চলছে। যে মাটিতে এরকম সোনা, রূপো, হিরে, পান্না মিশে থাকে সেখানে তো রূপকথার মানুষজনের আনাগোনা চলতে থাকে, এটাই তো আমাদের ভাবনা। কিন্তু তা তো নয়, এখানে সুয়োরানীর সংসারের সদস্য কেউ নয়। ছত্তিসগড়ের বুকে যারা বসবাস করে, ছত্তিসগড়ের অরণ্যের মধ্যে, ছত্তিসগড়ের গ্রামীণ পরিবেশে তাদের সঙ্গী একমাত্র দারিদ্র্য। তারা কেউ গোন্ড, তেলি, কূর্মী, রাওত, সারুয়ারা, পিঞ্জর, হাল্বা, মারিয়া, ভুঞ্জিয়া, কাউয়ার, বাইগা, ধুরুয়া, ওঁরাও এদের মতো আদিবাসী উপজাতি দল। এই আদিবাসীরূপে চিহ্নিত মানুষের ভিড়ে ছিন্নমূল মানুষের মিছিলটা রয়ে গিয়েছে।
আরও পড়ুন:
মাধ্যমিক ২০২৩: পাঠ্যবই খুঁটিয়ে পড়লে বাংলায় বেশি নম্বর পাওয়া কঠিন নয়
ডায়েট ফটাফট: সব খাবারের সেরা সুপারফুড কিনোয়া খান, ওজন কমান
এখানে আপনি পাবেন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মিশনারিদের সাধারণ জীবন আচরণ, তার মধ্যেই আপনি পাবেন টিবেট থেকে আসা আশ্রয়হারা তিব্বতিদের, ছোট্ট ক্ষেত্র মাইনপাটকে। কিন্তু আদিবাসী জীবনের যন্ত্রণা এখনও দূর হয়নি, তাদের হতাশা, অপমান, বঞ্চনার দীর্ঘশ্বাস আপনি আজও বুঝতে পারবেন। কিন্তু কৃষির বিকাশ, শিল্পের অগ্রগতি হলেও, শিক্ষা কিছু কিছু জায়গায় পথ প্রসারিত করলেও জীবন-জীবিকার মৌল চরিত্রটা বোধহয় আজও ছত্তিসগড়ে বদলায়নি। হতদরিদ্র অরণ্যবাসী, বনচারী আদিবাসী বজায় রেখেছে কেবলমাত্র তাদের সাংস্কৃতিক জীবনকে, বন পাহাড়ের পথে পথে সেই সংস্কৃতির ছোঁয়া আপনি এক-পা, দুপা হাঁটলেই বুঝতে পারবেন।—চলবে
ছবি সৌজন্যে: লেখিকা
ছবি সৌজন্যে: লেখিকা
বাইরে দূরে
লেখা পাঠানোর নিয়ম: এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। লেখার সঙ্গে বেশ কিছু ছবি পাঠাতে হবে। চাইলে ভিডিও ক্লিপও পাঠাতে পারেন। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com
* চেনা দেশ অচেনা পথ (Travel Offbeat): লেখক— অর্পিতা ভট্টাচার্য (Arpita Bhattacharya), অধ্যাপিকা, বাংলা বিভাগ, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ। শৈলীবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। বর্তমান আগ্রহ ও কাজ ভ্রমণ-সাহিত্য, ইকো-ট্যুরিজম, কালচার ট্যুরিজম, স্মৃতিকথা নিয়ে। এছাড়াও মুক্তগদ্য চর্চা ভালো লাগার জায়গা। এখন পর্যন্ত প্রকাশিত ৫টি গ্রন্থ এবং ৫০ টিরও বেশি প্রবন্ধ। সম্পাদনা করেছেন একটি বই এবং ধারাবাহিক সম্পাদনা করেন রবীন্দ্রনাথ টেগোর অ্যাডভান্সড রিসার্চ সেন্টারের জার্নাল।