বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


কুরদার রিসোর্ট থেকে বেরিয়ে এবার আমাদের যাত্রা অমরকণ্টক, সেটা অবশ্য মধ্যপ্রদেশে। কিন্তু ওই যে বললাম, কুরদার রিসোর্ট থেকে অমরকণ্টকের দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়, ঘণ্টা দেড়েক যাওয়ার পথে সময় লাগে। পথে পেরিয়ে যেতে হয় অচানকমার রিজার্ভ ফরেস্টের আরেকটি প্রান্ত। এবং তারপর চলার পথে অসম্ভব সুন্দর দৃশ্যাবলী পার হয়ে অমরকণ্টক পৌঁছনো যায়। অমরকণ্টক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব না। কিন্তু তার বদলে আমি অমরকণ্টকে থাকার জন্য ছত্রিশগড় ট্যুরিজমের যে রিসোর্টটি আছে তার কথা বলবো। ছেরছেরা টুরিস্টের রিসোর্ট।

অমরকণ্টকে ঢোকার মূল জায়গার পাঁচ থেকে ছয় কিলোমিটার আগে কবীর চবুতারা বলে যে এলাকা, সেখানে এই রিসোর্ট। অমরকণ্টক কিছুটা ঘুরে যখন দুপুরবেলা এই রিসোর্টে ঢুকলাম; শান্ত সমাহিত পরিবেশ, চারদিকে কেউ নেই, একটি বিশাল এলাকায় চারটি কটেজ, প্রত্যেকটি কটেজের মাঝখানের দূরত্বটা অনেক। একটু দূরে অফিস মানে রিসোর্টের অফিস। কটেজটি একদম মৈকাল পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে আছে, আপনি ঢুকলে মোহিত হয়ে যাবেন। সারারাত অবিরাম বৃষ্টি আর কটেজে সর্বমোট চারটি লোক। গা ছমছম করা পরিবেশ আর মা আমাকে মজা করে বললেন: “এ একদম জম্পেশ হানিমুনের স্পট।” সত্যি কিন্তু তাই!
পাহাড়ের একটু উপর দিয়ে আরেকটি রাস্তা চলে গিয়েছে মাঝে মাঝে বাইকের আলো, রাত একটু গভীর হতেই রাতের খাওয়া শেষ করে জম্পেশ ঘুম। পরদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ভয়ংকর টেনশন। ঘর খুলে বারান্দায় বেরিয়ে এক আঙুলও যেতে পারছি না এত কুয়াশা রিসোর্টের লোকেরা বলল যত পাহাড় থেকে নিচে নামবে রাস্তা খুব খারাপ, কুয়াশায় আক্রান্ত হতে পারেন, অ্যাক্সিডেন্ট হতে পারে। প্রাণ যেন হাতের মুঠোয় চলে এলো। রাত যেমনি কাটুক না কেন সকালবেলা ভয়ংকর। অসীম সাহস নিয়ে একটু একটু করে কুয়াশা সরে যাওয়ার পরে আটটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম। কবীর চবুতরার থেকে চার পাঁচ কিলোমিটার যাওয়ার পরে অচানকমার ফরেস্ট রেঞ্জে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশা কেটে গেল।

এ রাস্তায় পাহাড়ের উপরে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে গরু চড়তে দেখার অভিজ্ঞতাও আমাদের হয়েছে। এখান থেকে আরও দু-এক কিলোমিটার গেলে একটি ছোট্ট ঝোরার পাশে জঙ্গলের গভীরে ছত্তিশগড় ট্যুরিজমের আরেকটি রিসোর্ট। শোণভদ্রা। এই রিসোর্ট থেকে অমরকণ্টক সাত আট কিলোমিটার। কেউ অমরকন্টক ভ্রমণ করতে চাইলে তার থাকার জায়গা হিসেবে ছত্রিশগড় ট্যুরিজমের এই দুটো রিসোর্টকে যোগ্য বলে মনে করতেই পারেন।

এরপর শুরু হল আমাদের সেই চমৎকার রাস্তা। ঘাট এলাকা। বপূর্বঘাট পর্বতমালার কিছুটা অংশ, কিছুটা সমতলভূমি, জলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা গাছ এই করতে করতে আমরা এসে পৌঁছালাম ছত্রিশগড়ের ‘ন্যায়ের রাজধানী’ যাকে বলে সেই বিলাসপুরে। বিলাসপুর আর পাঁচটা বড় শহরের মতো। দেখার মতো অনেককিছুই আছে কিন্তু আজ আমরা দাঁড়াবো না। বিলাসপুর অতিক্রম করে আরো ঘন্টা দুয়েকের পথ অতিক্রম করে রায়পুর। সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার এই জার্নি ৪০০ কিলোমিটারের উপরে ছত্রিশগড়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং অতি সুন্দর রাস্তা, বিন্দুমাত্র অনুভব করতে দেবে না আপনারা কত কষ্টে আছেন। হ্যাঁ, খাবারের কষ্ট; মাইলের পর মাইল চলে যাবেন কোন খাবারের দোকান পাবেন না যতক্ষণ না কোনও বড় শহর বা শহরাঞ্চলে এসে পৌঁছচ্ছেন।
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৯: কুরদার ইকো রিসর্ট—অনাবিস্কৃত এক মুক্তা

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৫: যে ছিল আমার ‘ব্রতচারিণী’

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১১: ‘কটি পতঙ্গ’ ছবিতে পঞ্চমের সুরে কিশোর নিজেকে উজাড় করে দেন

ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-৩: এরকম ভুল হল কী করে? তবে কি আমাকে কিছুতে বশ করেছে?

ফেরার পথে আমরা দুটি জায়গা দেখে ফিরব এরকমই পরিকল্পনা; প্রথমটি হচ্ছে বানজারা মাতার মন্দির, পপুলার টেম্পেল আর যেহেতু আমরা পুজোর সময় গিয়েছিলাম তাই নবরাত্রি আর দশেরাকে কেন্দ্র করে প্রচুর জনসমাগম হয়। স্থানীয় মানুষ সবচেয়ে বেশি যায় এখানে। যেহেতু একটু দুপুরবেলা অতএব অল্প অল্প ফাঁকা পেয়েছিলাম। পরবর্তী গন্তব্য কৈবল্যধাম জৈন টেম্পেল। সম্পূর্ণ মার্বেল পাথরে তৈরি এই মন্দিরটি শহর থেকে একটু দূরে শান্ত নিরিবিলি। অনেকগুলো মন্দির একসঙ্গে আছে।

খুব বেশি পুরনো না, শহরটি সাজানোর জন্য হয়তো তৈরি হয়েছে। হোটেলের পথে ফেরার সময় রায়পুরের মেন অ্যাট্রাকশন স্বামী বিবেকানন্দ সরোবরের পাশ দিয়ে আপনি যখন ফিরবেন যাকে ‘বুড়া তালাও’ বলে মানে ‘ওল্ড লেক। এর রূপ সকালে এক রকম, দুপুরে একরকম, সন্ধেবেলায় আলোর কারুকার্যে আরও সুন্দর। ক্লান্ত শরীর মনে হলো একটু ভগবানের পায়ে অর্পণ করি। অতএব ইস্কন টেম্পেল। সারা ভারতবর্ষে ইস্কন মন্দিরগুলো যে রকম হয় সেরকম একটি মন্দির। প্রসাদ নিয়ে সেদিনের পরিক্রমা শেষ।
আরও পড়ুন:

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৩৩: ‘অপরাজিত’র সম্পাদনার সময় সত্যজিতের মনে হয়েছিল মিলি চরিত্রটির প্রয়োজন নেই, অগত্যা বাদ পড়লেন তন্দ্রা

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-১৩: এখানকার একমাত্র ভারতীয় রেস্তরাঁর মালিকও বাঙালি

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৩: গগনেন্দ্রনাথের‌ ঘুড়ি ওড়ানো

শহর রায়পুরে ছোটখাট বেড়াবার মতো জু, নানা ধরনের শপিংমল ইত্যাদি আছে ঘুরতেই পারেন। কিন্তু সেগুলো নতুন কোন অ্যাট্রাকশন আপনার কাছে তুলবে না। পরদিন সকালবেলায় আমাদের দিন শুরু হল মহামায়া মন্দির দর্শন করে। মহামায়া মন্দিরের অদ্ভুত সুন্দর পুরাতাত্ত্বিক কারুকার্য এবং ইতিহাস। মহামায়া টেম্পেল ৯০০ বছর আগের তৈরি এবং এর একটি ঐতিহাসিক-প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব আছে। এই মন্দিরে মহাকালী, শিব, ভৈরব ভদ্রকালী, হনুমানজি এবং আরও অনেক দেবতার পূজো হয়। খুব ভিড় থাকে না, সুন্দর ভাবে আপনি পুজো দিতে পারেন। পুরোহিতরা অনেকেই বাংলা কথা বোঝে। আপনারা নিজের মনের মতো করে পূজো দিতে পারেন। এটি ছত্রিশগড়ের খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এরপরেই চলে আসুন টাউন হল দেখতে। এখন এটি একটি সরকারি অফিস। কিন্তু এটা ১৮৮৯ সালে তৈরি হয়েছিল এবং তখন নাম ছিল ‘ভিক্টোরিয়া জুবিলী হল’, স্বাধীনতা সংগ্রামের অনেক কাহিনি এই টাউন হলে কথিত আছে। কঙ্কালীতলা সেটাও একটি পুকুর।
আরও পড়ুন:

স্বাদে-আহ্লাদে: তপ্ত দিনে প্রাণ জুড়োতে বন্ধুদের জন্য বানিয়ে ফেলুন আমপান্না

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১১: কুরুপাণ্ডবদের অস্ত্রগুরু কৃপাচার্য, দ্রোণাচার্য এবং কয়েকটি প্রশ্ন

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২০: শোওয়ার বালিশ বিছানা কেমন হবে? শক্ত না নরম?

আমাদের পরবর্তী গন্তব্য পুরখাউতি মুক্তাঙ্গন। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম উদ্বোধন করেছিলেন। বিশাল প্রাঙ্গণ প্রায় আড়াই একর জমি জুড়ে ছত্রিশগড়ের বায়ো-কালচারাল ডাইভারসিটিকে দর্শিত করানো হয়েছে। যেখানে আপনারা দেখতে পারবেন ছত্রিশগড়ের বিভিন্ন আদিবাসীদের নানা ধরনের ফোক আর্ট, তাদের নানা সম্পদ। সমস্ত কিছুর মিনিয়েচার, রিয়ালিস্টিক ফিগার। এটা এক ধরনের শিক্ষনীয় বিষয় বটে।

আপনি রায়পুরের বুকে বসে কাওয়ার্ধা, দন্তেশরী মন্দির, দান্তেওয়ারা, জগদ্দলপুর ফরেস্ট, চিত্রকোট, বাস্তার সমস্ত জায়গার এবং নানা ধরনের ফোক ডান্স-এর মডেল দেখে কিছু শিক্ষা লাভ করতে পারবেন। ব্যাটারি চালিত গাড়িতে এই পুরো মুক্তাঙ্গনটি আপনারা ঘুরতে পারবেন। রয়েছে ছোট্ট একটি খাবার জায়গায় এবং ডোকরা শিল্প সামগ্রী বিক্রয় কেন্দ্র। কিন্তু আপনার পকেটে যথেষ্ট না থাকলে ওদিকে হাত দেওয়া যাবে না। সেখান থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরে আমাদের গন্তব্য রাজিম।
রাজিমের থেকে ন’ কিলোমিটার দূরে চম্পারন ঘুরে আমরা রাজিমে যাব। চম্পারণ-এর আগে নাম ছিল চম্পাঝড়, এটা খুব বিখ্যাত ধর্মীয় কেন্দ্র হিন্দুদের। বলা হয় যে বৈষ্ণবদের যে বল্লভ শাখা; সেই শাখার যিনি প্রবর্তক মহাপ্রভু বল্লভাচার্য, তাঁর জন্মস্থান। দুটি খুব সুন্দর মন্দির আছে। প্রকাট্য বৈঠকজি আর মোট প্রকাট্য বৈঠকজি। প্রত্যেক বছর ধর্মীয় উৎসব হয়। এই মন্দিরের একটা বৈশিষ্ট্য আপনি গেলে সুন্দর অন্নভোগ পেতে পারবেন অতি সুস্বাদু সেই ভোগ। এখান থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে রাজীবলোচন মন্দির। রাজিমে মহানদী অন্যান্য নদীর সঙ্গে মিশেছে তাই এটিকে সকলে ছত্রিশগড়ের প্রয়াগ বলে। প্রতিবছর মাঘ মাসে মেলা বসে, রাজীবলোচন মন্দির মূলত বিষ্ণু মন্দির। অদ্ভুত সুন্দর কারুকার্য চমৎকার ঐতিহ্য দেখবার মতো জিনিস।

আমার ছত্রিশগড় ভ্রমণের এবারের পর্ব এতোটুকুই। বাদবাকি ছত্রিশগড় আবার যবে নতুন করে আবিষ্কার করব। তবে আবার করে ‘চেনা দেশে অচেনা পথে’ এগোবো। যা বললাম যা লিখলাম তার বাইরেও অনেক কিছু রয়ে গেল যেটা বলে বা লিখে বোঝানো যায় না। সেটা গিয়ে উপভোগ করতে হয়। ছত্তিশগড় গিয়ে আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি অনেক বড় উঁচু আকাশ। আমার মনে হয়েছিল আকাশটা অনেক উঁচুতে তার কারণ প্রকৃতি এত সুন্দর, এত স্বচ্ছ। এই জন্য বারবার এই আন্ডার রেটেড রাজ্যে আমার মন ছুটে যাবে।—শেষ
* চেনা দেশ অচেনা পথ (Travel Offbeat): লেখক— অর্পিতা ভট্টাচার্য (Arpita Bhattacharya), অধ্যাপিকা, বাংলা বিভাগ, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ। শৈলীবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। বর্তমান আগ্রহ ও কাজ ভ্রমণ-সাহিত্য, ইকো-ট্যুরিজম, কালচার ট্যুরিজম, স্মৃতিকথা নিয়ে। এছাড়াও মুক্তগদ্য চর্চা ভালো লাগার জায়গা। এখন পর্যন্ত প্রকাশিত ৫টি গ্রন্থ এবং ৫০ টিরও বেশি প্রবন্ধ। সম্পাদনা করেছেন একটি বই এবং ধারাবাহিক সম্পাদনা করেন রবীন্দ্রনাথ টেগোর অ্যাডভান্সড রিসার্চ সেন্টারের জার্নাল।

Skip to content