মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


ছত্তিসগড়ে বেড়িয়ে পড়ার আগে এই রাজ্যের ইতিহাস ভূগোলের ঠিকানাটা বড্ড জরুরি। কারণ, প্রাথমিক চেনা জানা না থাকলে পথ খুঁজে অন্য পথ খোঁজার আনন্দ থাকে না। ছত্তিসগড়ের আজকের যে ছিমছাম চেহারা সেটি খুব বেশি দিনের নয়। আগে মধ্যপ্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং সমগ্র রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক অস্তিত্বই জড়িয়ে ছিল মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে। গন্ডোয়ানার একটা অংশ ছত্তিসগড় স্বতন্ত্র অস্তিত্ব জানাত।

একটা অঞ্চলের যখন আঞ্চলিক অস্তিত্ব রয়েছে, তখন তার একটা অতীত অবশ্যই থাকবে। এবং সেই ধূসর অতীতের খোঁজে বেরোলে অনুসন্ধান, গবেষণা, অনুমান, দেখা ইত্যাদির ভিত্তিতে যেমন মহাকাব্যের ঘটনাধারার সঙ্গে সংযোগ মেলে, তেমন গুহাচিত্রের প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শন মেলে। মানুষের জীবনযাত্রার নানা যোগাযোগ মেলে। সব মিলিয়ে এক অন্য ইতিহাস আমাদের সামনে ফুটে ওঠে। যেমন ধরুন মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের আধিপত্য ছত্তিসগড়ে প্রতিষ্টিত হবার পরে মৌর্য সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ শুঙ্গবংশের শাসনে এখানে প্রভুত্ব করেন। তারপর একে একে সাতবাহন, গুপ্ত বংশ, দশম শতাব্দীর সোম রাজবংশের পর ক্রমান্বয়ে কালচুরি বংশের আধিপত্য প্রতিষ্টিত হয়।
এখন ছত্তিসগড় ভ্রমণে গেলে এই কালচুরি রাজাদের ইতিহাস পুরাকীর্তির নানা নিদর্শন আপনারা দেখতে পাবেন। মারাঠাদের ভোঁসলে রাজবংশের কৃতিত্বের মাঝে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অনুপ্রবেশ ঘটে যায়। এই সূত্রে রায়পুরে সিপাহী বিদ্রোহের আগুন জ্বললে মহারানি ভিক্টোরিয়া শাসনভার গ্রহণ করেন। গড়ে ওঠে আঠারোটি জেলার সমবায়ে সেন্ট্রাল প্রভিন্স। এরপরে ছোট বড় ,ভাঙ্গা গড়া, যোগবিয়োগ বহুদিন ধরেই চলছিল। ১৯৪৮ সালে সেন্ট্রাল প্রভিন্স হিসেবে মধ্যপ্রদেশ গঠিত হয় এবং রাজধানী হয় নাগপুর। ১৯৫৬সালে আবার মধ্যপ্রদেশকে কিছুটা গুছিয়ে তোলার কাজ চলে, ১৯৬১-তে ৪৩টি জেলা-সহ ভূপালকে রাজধানী করে মধ্যপ্রদেশ সুসজ্জিত হয়।

এই নতুন ব্যবস্থায় ছত্তিসগড় বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু ভেদ-বৈষম্যের সীমারেখা মুছে যায় না। কারণ, পাহাড়-অরণ্য অধ্যুষিত আদিবাসী, উপজাতিদের দুনিয়া, যে দুনিয়ায় এখনও ২০২২ সালেও খাবার, সামান্য বেঁচে থাকার উপকরণগুলো পাওয়া যায় না। সেখানের মানুষের অবদমিত কণ্ঠস্বর আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হতে লাগল। দীর্ঘদিনের অবহেলা, যন্ত্রণা, ক্ষোভ আগুন হয়ে জ্বলল। তাদের পুঞ্জীভূত দাবিগুলো নিয়ে সরব হয়ে ওঠেন শঙ্কর গুহ নিয়োগী। তাঁর নাম আমরা বাইলাডিলা খনি আন্দোলনের নেতৃত্ব হিসেবে পেয়ে থাকি। এরপরে ২০০০ সালের ৩১ অক্টোবর ভারতের ২৬তম রাজ্য হিসাবে স্বাধীন স্বতন্ত্র ছত্তিসগড়ের জন্ম হয়।
আজকের ছত্তিসগড়কে ভারতের ছটি রাজ্য চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে আর এর রাজধানী রায়পুর, রায়পুর জেলার মধ্যে অবস্থিত। অন্যান্য ১৫টি জেলা হচ্ছে ধামতারি, দুর্গ, রাজনন্দন গাঁও, মহাসমুন্দ, কাওরধা, বস্তার, দান্তেওয়ারা, বিলাসপুর, কাঙ্কের, জাজাঙ্গির চম্পা, রায়গড়, কোরবা, জসপুর, সরগুজা ও কোরিয়া। সমস্ত জেলাই আরণ্যক প্রকৃতির প্রেক্ষাপটে চমৎকার পর্যটক আকর্ষণের কোলাজ নির্মাণ করে। আশ্চর্য সবুজের দেশ এই ছত্তিসগড়। চারপাশে মালার মতো পাহাড়, ঘাট বলে যা বিখ্যাত তার কত না রঙ, রূপ, সৌন্দর্য। এই সবুজ পাহাড়ের সারি দেখছেন, দেখতে দেখতেই ধূসর কালো রঙের ন্যাড়া পাহাড়।
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১: ছুটি ও ছোটা ছুটি

ডায়েট ফটাফট: সানস্ক্রিন মাখবেন তো বটেই, এবার খেয়েও দেখুন—সিঙ্গল ইনভেস্টমেন্টে ডবল প্রফিট!

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২: ন্যাড়া মাথায় ভালো চুল গজায়?

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-২: অনন্তের সন্ধান আর সেই দরজার তালা ও চাবি তো তাঁর কাছেই রাখা আছে

এখানে আপনি হিমালয় পর্বত খুঁজলে পাবেন না। বরফ ঢাকা হিমালয়ের ধ্যানগম্ভীর মৌনরূপ এখানে নেই। আকাশছোঁয়া গম্ভীর ভয়ঙ্কর পাহাড়, তার খাদ সেই সৌন্দর্যও এখানে পাবেন না। তবে আছে কী? পাহাড় আর অরণ্যের মেলামেশা। পাহাড়ের ভিড়ে কত না নাম না জানা অচেনাদের উঁকিঝুঁকি। আমরা তো বিন্ধ্য আর সাতপুরা পর্বতের নামই জানি, হঠাৎ করে দেখতে পাই মৈকাল পর্বত, মনে পরে ভূগোলে তো পড়েছিলাম। চিত্রকূট, বাইলাডিলা আরও কত ছোট ছোট পর্বতশ্রেণি বিজলা, ফুটকা, শিউয়া, মহুলা, পৌসার, চিল্পিঘাটি, মাতুলা, বৃন্দাবনগড়, ডোঙ্গরি, কন্টাগাও, তামাং, চেরাগাঁও, এরকম ছোট- বড়, সুগম-দুর্গম অজস্র পাহাড় বা পাহাড়শ্রেণি। চেহারায় ভীষণ নয়, কিন্তু উঁচু পাহাড়ি শরীরের আঁকাবাঁকা পথ আর তার গিরিগুহাগুলো, প্রাকৃতিক ভাস্কর্য, ভয় আর বিস্ময়ে আপনাকে রোমাঞ্চ সঞ্চারিত করে দেবে।

শুধু কী তাই? এত অজস্র ঝরনা আপনি হিমালয় অঞ্চলে গেলেও পাবেন না। এত অজস্র জলপ্রপাত, তার সৌন্দর্য আপনাকে পাগল করে দেবে। নাম তো শুনেছেন শুধু চিত্রকূট, কিন্তু কিছুক্ষণ বাদে বাদে কৃশকায় নদী বয়ে চলে এঁকেবেঁকে পৃথুলা উদ্দাম স্রোতের জলপ্রপাত সৃষ্টি করেছে,
এত যে নদী, আর নদীর থেকে নদীর ড্যাম, সেটাও কিন্তু ছত্তিসগড়ের এক বৈশিষ্ট্য। ভারতবর্ষের এত রাজ্যে ঘোরার পরে এ অভিজ্ঞতা আমার কাছে নতুন যে প্রতি একশো, দুশো, তিনশো কিলোমিটার বাদে বাদে একটি করে ড্যাম এবং বিশাল আকৃতির ড্যাম। নদীর মধ্যে প্রধান মহানদী। ছত্তিসগড়ের রায়পুর জেলার দণ্ডকারণ্যের পাদদেশ থেকে উৎপন্ন হয়েছিল তারপর ওড়িশার দিকে চলে গিয়েছে। তার যে যাতায়াত পথ অর্থাৎ উঁচু পার্বত্য এলাকা থেকে নিচের দিকে যাচ্ছে, যেতে যেতে নানা জলধারা, ছোট ছোট নদী তার মধ্যে এসে মিশেছে। ছত্তিসগড়ের অন্যতম নদী হচ্ছে শোন। নর্মদার বিপরীত মুখে বেরিয়েছে, অমরকণ্টক পাহাড় থেকে জাত এই নদ কিছুটা উত্তরাভিমুখী হয়ে কাইমুর পর্বতশ্রেণি ছুঁয়ে এ রাজ্যের ভিতর ঢুকে গিয়েছে।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-১: পৃথিবী খ্যাত ডালটন হাইওয়ে এই শহরকে ছুঁয়েছে আর্কটিক বৃত্ত তথা উত্তরমেরুর সঙ্গে

জ্যোতির্লিঙ্গ যাত্রাপথে, পর্ব-২: বারাণসীকুলপতি বিশ্বনাথ

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৭: পুরীতে বাড়ি— রবীন্দ্রনাথের, গগনেন্দ্রনাথ-অবনীন্দ্রনাথের

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৩৮: মাছের ডিম বার্ধক্যের ছাপ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়! মাছের ডিমের এই অবাক করা গুণের কথা জানতেন?

এই যে কাইমুর পর্বতশ্রেণী, এর ও এক অদ্ভুত অবস্থান। ৪ কিলোমিটার ডানদিকে গেলে মধ্যপ্রদেশ আবার ৪ কিলোমিটার বাঁদিকে এলে ছত্তিসগর। তার সঙ্গে রয়েছে তার শাখানদী রিহান। শোন নদী পুরাণ এবং লোককথার নুড়িপাথর ভেঙ্গে ছত্তিসগড়ের মুকুটে সৌন্দর্যের পালক যোগ করে দিয়েছে। রাজ্যের দক্ষিণে বয়ে চলেছে ইন্দ্রাবতী নদী। গোদাবরীর উপনদী এই ইন্দ্রাবতী ওড়িশার কালাহান্ডি থেকে উৎপন্ন হয়ে সেখান থেকে বাস্তার জেলার মধ্যে দিয়ে কিছু পথ পাড়ি দিয়ে গোদাবরীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এই ইন্দ্রাবতীরই হাস্য-লাস্যে ভরা মোহিনী মূর্তি হচ্ছে চিত্রকূট জলপ্রপাত। চিত্রকূট পাহাড় থেকে ৯৬ ফুট নীচে ঝাঁপিয়ে পরা ইন্দ্রাবতীর নরম শরীরী বিহঙ্গ আমাদের মুগ্ধ করেছে।
‘ভারতের নায়াগ্রা’ বলে পরিচিত চিত্রকূট। এই নদী ছাড়াও তার সঙ্গে মিলিত অন্যান্য জলধারা সীতা, মোড়ান, কাঙ্কের, হাসদো, তুন্দলা, কানহার প্রত্যেকটি নদী যেমন তার শাখা প্রশাখা বিস্তার করেছে, যেমন এঁকেবেঁকে গিয়েছে ছত্তিসগড়ের লোকজীবনও তেমন তার সঙ্গে সঙ্গে বেঁকে বেঁকে একটি নিটোল কবিতা তৈরি করেছে। যেমন অদ্বৈত মল্লবর্মণ তিতাসে লিখেছিলেন মালোপাড়ার জীবন তিতাসের বাঁকের সঙ্গে বাঁক নেয়; ছত্তিসগড়ের জীবনও এই নদীগুলির, এই জলধারাগুলির বাঁকের সঙ্গে এক একটি কবিতা তৈরি করে ফেলে। —চলবে
 

বাইরে দূরে

লেখা পাঠানোর নিয়ম: এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। লেখার সঙ্গে বেশ কিছু ছবি পাঠাতে হবে। চাইলে ভিডিও ক্লিপও পাঠাতে পারেন। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.co

* চেনা দেশ অচেনা পথ (Travel Offbeat): লেখক— অর্পিতা ভট্টাচার্য (Arpita Bhattacharya), অধ্যাপিকা, বাংলা বিভাগ, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ। শৈলীবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। বর্তমান আগ্রহ ও কাজ ভ্রমণ-সাহিত্য, ইকো-ট্যুরিজম, কালচার ট্যুরিজম, স্মৃতিকথা নিয়ে। এছাড়াও মুক্তগদ্য চর্চা ভালো লাগার জায়গা। এখন পর্যন্ত প্রকাশিত ৫টি গ্রন্থ এবং ৫০ টিরও বেশি প্রবন্ধ। সম্পাদনা করেছেন একটি বই এবং ধারাবাহিক সম্পাদনা করেন রবীন্দ্রনাথ টেগোর অ্যাডভান্সড রিসার্চ সেন্টারের জার্নাল।

Skip to content