মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


সেদিন ছিল নবমী; আকাশে অজস্র তারা চাঁদ তো কোথাও দেখতে পাচ্ছিলাম না স্থানীয় মানুষজন যারা বিলাসপুর থেকে এসেছিলেন, পিকনিকের মুডে এসেছিলেন। অনেক সন্ধ্যার পরে তারা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন ফাঁকা রিসোর্ট টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। একটি কটেজে আমি আর মা আরেকটিতে অমরকণ্টক থেকে এক বাঙালি পরিবার আসবে শুনছি। আর রিসার্টে দূরে ডাইনিংয়ে রান্নাবান্না করছে কর্মচারীরা, ৫-৬ জন কর্মচারী। নেমে গেলাম চলে গেলাম ওদের কাছে,গল্প জুড়ে দিলাম। এসে বসলেন নতুন জয়েন করা ট্যুরিজমের অফিসার, ইয়াং তরুণ তুর্কি উত্তরপ্রদেশে তার বাড়ি। তার সঙ্গে নানা গল্প করতে করতে রাতে কী খাব ঠিক করে নিলাম। তার আগে ওরা টমেটো স্যুপ করে দিল আমাদেরকে। টমাটো শোরবা বলে আমরা যে স্যুপটি পয়সা দিয়ে রেস্তরাঁতে খাই, তার থেকে অনবদ্য কিন্তু ওদের হাতে টমেটো স্যুপ। আদার কুচি মাঝে মধ্যে মুখে পড়ছে। অনবদ্য। খিদেটাকে যেন আরও বাড়িয়ে দিল।
ওরা ফ্রিজ খুলে দিয়ে বলল আপনি কী খাবেন? রোজ একঘেয়ে ভেনডি খেতে খেতে মুখ পচে গেছে, চিকেন খাবো না। খুঁজে খুঁজে দেখলাম একটা কুমড়ো রয়েছে, কুমড়োটাকে নামিয়ে দিলাম। চোখ কপালে তুলে বলল যে কুক: “যে তোমরা এগুলো খাও?”
আমি বললাম: “হ্যাঁ”
বলল: “আমাদের এখানে ভদ্রলোকরা তো এগুলো খায় না।”
আমি বললাম: “আমরা তো খাই, আমাদের ওখানে এগুলো ৩০ টাকা ৪০ টাকা কিলো।”
বলল: “এত দাম?”
আমি জিজ্ঞেস করলাম: “তোমরা কত দিয়ে কিনেছ?”
ওরা বল: “কিনিনা… ওই কারও বাড়িতে গ্রামে হয়েছে ছিড়ে নিয়ে চলে আসি। এগুলো তো টুরিস্টরা খায় না, আমরা খাই।”
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৮: কোষার ভান্ডার ছররি থেকে কুঠাঘাট হয়ে কুরদার

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০: প্রশিক্ষক গুরু বিশ্বামিত্র, নারীহত্যা না মানবধর্ম?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬২: প্রথম রবীন্দ্রজীবনী

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৪: স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের ‘রাত-ভোর’

আমি যখন বললাম আজ রাতে এটি আমার আমাকে খেতে দিতেই হবে অত্যন্ত খুশি হয়ে অপূর্ব সুন্দর একটি সবজি বানিয়ে দিল‌। সঙ্গে মসুর ডাল। অনেকদিন বাদে গোটা মসুর। আক্কা মসুর যাকে ওরা বলে। চমৎকার একটি প্রিপারেশন এবং তার সঙ্গে বলল: “কাল সকালবেলা যদি তোমরা থাকো নদীর মাছ কিনে এনে খাওয়াবো।” কিন্তু কাল সকালে আমাদের নির্ধারিত অন্য জায়গায় যাওয়ার কথাযেতেই হবে। সঙ্গে বৃদ্ধ মানুষ। এবং আবারও বলছি এই অঞ্চলে আপনারা কখনোই বৃদ্ধ-বয়স্ক-অসুস্থ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে আসবেন না, তাহলে আপনাদের আনন্দ একটু হলেও মাটি হতে পারে। কেন না ন্যূনতম প্রয়োজনীয় কোনও কিছু এখানে পাবেন না। কোনও কিছু অসুবিধা না হলেও আতঙ্ক নিয়েই আপনাকে থাকতে হবে।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১০: কিশোর কণ্ঠের উপর যেন এক অলিখিত দাবি ছিল পঞ্চমের

নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে,পর্ব-৩৬: গিরিশচন্দ্রের ‘বিষাদ’ নাটকটি প্রথম অভিনীত হয় এমারেল্ড থিয়েটারে

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪৬: ব্যর্থ প্রেমের বহ্নিশিখা

রাত্রিবেলা বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা পড়লো, বৃষ্টি পড়ছে ঘুমিয়ে গেলাম। দশটার সময় হঠাৎ হইচই শুনে দেখি সেই বাঙালি পরিবারটি অমরকণ্টক থেকে ফিরেছেন ওই পাহাড়ি রাস্তায় অতি কষ্ট করে। কারণ, তাঁদের গাড়ি খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তাঁদের সঙ্গে পরিচয় হল। তাঁরা বললেন, তাঁরা বিশাখাপত্তনামের প্রবাসী বাঙালি। খুব খুশি তারা তিনদিন এখানে কাটাবেন সমস্ত শহরের লৌকিক জীবন থেকে দূরে সরে টেলিফোনের সুইচ অফ করে। এরকমটা কাটাতে পারলে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে বেশ অনবদ্য হবে।
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১৯: উন্নয়নের কাণ্ডারী নির্ণয়ে পিতৃতান্ত্রিক পক্ষপাতিত্ব

বিদ্যাসাগর ও বঙ্কিমচন্দ্রের পরে বাংলাভাষার স্বচ্ছন্দ, স্বাভাবিক প্রয়োগ ও বিস্তারে তাঁর অবদান ভোলার নয়/১

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৯: পাকা আম খাবেন, নাকি কাঁচা আম?

রাতের পর সকাল। আস্তে আস্তে পাখির ডাকে দরজা খুলে দেখলাম রিসর্টের কুকুরটি আমার সঙ্গে সারারাত ওখানে শুয়ে ছিল। এবং ও আমাদের পাহারাদারের কাজ করল, আমি দরজা খুলে বেরোলাম ও বারান্দা থেকে নেমে গেল। ঘুরছি, প্রকৃতিকে অনুভব করার চেষ্টা করছি পাহাড়ের অত উপরে স্তুপিকৃত মেঘ দেখতে দেখতে কখনও কখনও ভয় লাগছে। এখান দিয়ে নামবো কী করে? এত বৃষ্টি। গেট থেকে বেরিয়ে রিজার্ভ ফরেস্টের দিকে এক কিলোমিটার হেঁটে গিয়েছি সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার হোটেলে কর্মচারীর, “আপ কেয়া কর রাহে হো?” পেছন পেছন দৌড়ে দৌড়ে আসছে। আমার সত্যিই দুঃসাহস হয়ে গিয়েছিল কারণ তখনও অচানকমার রিজার্ভ ফরেস্ট খোলা নেই। মানে সেখানে ঢোকার অনুমতি নেই।
১৬ অক্টোবরের পরে ভারতের সবকটা রিজার্ভ ফরেস্ট যেমন খোলে তেমন এই রিজার্ভ ফরেস্টও খোলে। আর সেখানে অনেক বাঘ আছে এ কথাটা মাথায় খেয়াল হয়নি। জোর করে প্রায় টেনে নিয়ে আসলো। টেনে নিয়ে আসার পরে এক প্লেট অনবদ্য উপমা আর ঘন একটি চা দিল, যেটা খেতে পারলাম না সেটা প্যাকেট করে দিয়ে দিল। নিয়ে যাও রাস্তায় খাবে। হঠাৎ কথার মাঝে দেখি আমার ড্রাইভার দেখাচ্ছে গাড়িতে তুলে দিয়েছে দুটো কুমড়ো। আমি বললাম, “করেছ কী? এখনও আমার চারদিন ট্যুরের বাকি। এ কুমড়ো নিয়ে আমি কলকাতায় ফিরব কীভাবে?” সহজ সরল আদিবাসীরা আমাকে জানালো। “তোমরা ৩০ টাকার কেজি কুমড়ো কেন বড্ড খারাপ লাগছে।” ট্যুরিজমের কর্মচারী যে অফিসার ভদ্রলোকটি অনুরোধ করলেন, আমার অভিজ্ঞতা লিখে যেতে আর কী কী উন্নতি করা যায় সবার কাছে প্রচারের জন্য। সত্যি বলব ছত্তিশগড়ের অনেক জায়গা ‘আনএক্সপ্লোরড’। টুরিস্টদের যাওয়া দরকার। তবে জনান্তিকে বলে রাখি, একটু আনএক্সপ্লোরোড থাক তা না হলে প্লাস্টিক আর বিতিকিচ্ছিরি জনসমাবেশ স্নিগ্ধতা নষ্ট করে দেবে।
* চেনা দেশ অচেনা পথ (Travel Offbeat): লেখক— অর্পিতা ভট্টাচার্য (Arpita Bhattacharya), অধ্যাপিকা, বাংলা বিভাগ, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ। শৈলীবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। বর্তমান আগ্রহ ও কাজ ভ্রমণ-সাহিত্য, ইকো-ট্যুরিজম, কালচার ট্যুরিজম, স্মৃতিকথা নিয়ে। এছাড়াও মুক্তগদ্য চর্চা ভালো লাগার জায়গা। এখন পর্যন্ত প্রকাশিত ৫টি গ্রন্থ এবং ৫০ টিরও বেশি প্রবন্ধ। সম্পাদনা করেছেন একটি বই এবং ধারাবাহিক সম্পাদনা করেন রবীন্দ্রনাথ টেগোর অ্যাডভান্সড রিসার্চ সেন্টারের জার্নাল।

Skip to content