রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


রতনপুর পার হতেই রাস্তা খানিকটা অন্যরকম হয়ে গেল। বুঝলাম যে রাস্তা ধরে আমাদের ড্রাইভার কোরবার দিকে নিয়ে যাচ্ছে সেই রাস্তা তৈরি হচ্ছে অনেকাংশে। সিমেন্ট বালির ঝড়, প্রচণ্ড রোদ, গাড়ির ভেতরে এসিতে বসেও শ্বাস কষ্ট প্রায়। কখনও কখনও ভালো রাস্তা এভাবে পথ চলছে, পথ আর শেষ হয় না। বারোটার পরে রতনপুর থেকে বেরিয়েছিলাম, একটা—দেড়টা, সময় এগিয়ে চলেছে কিন্তু কোরবা আর আসছে না। আমাদের উদ্দেশ্য কোরবা শহরে থাকা নয় কিন্তু কোরবা হয়েই আমাদের যেতে হবে এমন একটি জায়গায় যা আজকে আমাদের থাকবার জায়গা, সাতরেঙ্গা বনাঞ্চল। হঠাৎ যাত্রাপথটা বোরিং লাগতে আরম্ভ করল, এরকম তো হয় না, বুঝলাম খিদে পেয়েছে। খাবারের মতো কোনও জায়গা পাচ্ছি না। কোরবা না এলে খাবারের কিছু পাব বলে বোধও হচ্ছে না।

চলতে চলতে হঠাৎ দেখি একটি গ্রাম মানে একটু উন্নততর গ্রাম। গ্রামের নাম ছররি। কেন গ্রামটা দৃষ্টি আকর্ষণ করল? কারণ এই গ্রামটিতে কোসার কোকুন চাষ হয়। একে বাঙালি, তায় শাড়ি প্রেমী মনটা চনমন করে উঠল। দু’ ধারে প্রচুর দোকান দেখতে দেখতে মনটা একটু ভরে গেল। তার কিছুক্ষণ বাদে এনটিপিসি এলাকা শুরু হল। আমরা সকলেই জানি কোরবা এনটিপিসি-এর সবচেয়ে বড় তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। প্রচুর কর্মী কাজ করে। কোরবার মূল শহর এবং এনটিপিসি টাউনশিপ দুটো আলাদা। এনটিপিসি টাউনশিপ বিরাট এলাকা জুড়ে, স্কুল কলেজ হসপিটাল কোয়ার্টার নানা রকম দোকান তার ভিতর দিয়ে আস্তে আস্তে আমরা মূল কোরবা শহরে প্রবেশ করলাম। এবার আর পেটের খিদে মানছে না।
মূল চক, যার বাঁদিকে আদিবাসীদের মূর্তি রাখা সেখানে এসে সন্ধান পেলাম একটি পাঞ্জাবি রেস্তরাঁর। ক্ষুধার্ত মানুষেরা ঢুকে পড়লাম সেখানে। পাঞ্জাবি তিন ভাই রেস্তরাঁটি চালায়। খুব ভালো বাংলা বোঝে। কারণ কোরবাতে প্রচুর বাঙালি বাস। চাকরির সূত্রে খড়্গপুরের প্রচুর লোক কোরবাতে থাকে। সেখান থেকে দ্বিপ্রাহরিক আহার শেষ করে আমরা জানতে পারলাম আমাদের আরও ৩৬ কিলোমিটার যেতে হবে। তখন ঘড়িতে চারটে বেজে গিয়েছে।

তবে আমরা সাতরেঙ্গাতে প্রবেশ করতে পারব। প্রচুর জলসঞ্চয় করে নিয়ে রওনা দিলাম। জলের কথা বলছি এ কারণে ছত্রিশগড়ে ঘুরতে গেলে আপনি যদি বাইরের জল না খেতে চান মানে আপনি মিনারেল ওয়াটার কিনতে চান তাহলে ছত্রিশগড় ঢোকার আগেই ৫ লিটারের বোতল সংগ্রহ করে নিন। ছত্রিশগড়ে কিন্তু এক লিটারের বোতল ছাড়া পাবেন না যেটি প্রচুর পরিমাণে তুলতে হবে আপনাকে এবং দামও কিছুটা বেশি পড়ে যাবে।
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৬: রতনপুর মহামায়া দর্শন

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১২: সকালবেলার আগন্তুক

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬০: রাতদুপুরে বিপন্নকে বাঁচাতে হাটখোলার পাট আড়তের টাকা এসেছিল জোড়াসাঁকোয়

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-২: এখানে দেশের অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা, বাণিজ্যনীতি এবং বৈদেশিক নীতির চর্চা করা হয়েছে

আবার কিছুটা ভাঙাচোরা পথ অতিক্রম করে সাতরেঙ্গা যাবার রাস্তায় আমরা ঢুকে পড়লাম। এবারে ঝকঝকে রাস্তা বনাঞ্চল ফাঁকা ফাঁকা রাস্তা পেরিয়ে, ছোট ছোট আদিবাসীদের গ্রাম পেরিয়ে আমরা এগিয়ে চলছি সাতরেঙ্গার দিকে। হঠাৎ হঠাৎ কালো গ্রানাইটের পাহাড় একেবারে শিবলিঙ্গের মতো দেখতে নজরে আসবে। আমি কিছু না জেনেই বলেছিলাম শিব ঠাকুরের মতো দেখতে। গাড়ির ড্রাইভার খুব একটা জানে না কিছু। কারণ সে রায়পুর থেকে এসেছে। ফলে তার এই অঞ্চল একেবারেই অচেনা সেও আমাদের মতো নবিশ প্রথম যাচ্ছে।

যাত্রা করতে করতে আমরা সাতরেঙ্গার কাছে পৌঁছে গেলাম। সাতরেঙ্গার একটি ড্যাম আছে এবং সেই ড্যামটি দেখলে মনে হবে প্রায় সমুদ্রের মতো। বাঙ্গো ড্যাম। এবং ড্যামের পাশে ছত্রিশগড় ট্যুরিজমের প্রপার্টি। যে প্রপার্টিতে আপনি একটি রাত কাটাতে পারেন এবং অপূর্ব সুন্দর প্রকৃতির অনুভূতি নিতে পারেন। স্থানীয় মানুষেরা পাশের একটি জায়গায় ড্যামের পাশে পিকনিক করতে আসে। কলেজ ফেরত ছোট ছোট ছেলে মেয়েদেরও দেখেছি সকালবেলায় এসে দুপুরের মধ্যে বেরিয়ে যেতে। হ্যাঁ, এটা ঠিকই যে যখন তখন এলে কিন্তু এখানে অসুবিধে হতে পারে। কারণ যাতায়াতের মাধ্যম মানে কোনও লোকাল ট্রান্সপোর্ট নেই। গাড়ি কিংবা টেম্পো তাদের ভাড়া করেই আপনাকে আসতে হবে।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮: রামচন্দ্রের কৈশোর, ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্র: এক অনন্য উত্তরণ

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৮: সলিল চৌধুরীর সুরারোপিত গান খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতেন পঞ্চম

দশভুজা: তিনিই সারস্বত সাধনার প্রতিরূপা সত্যিকারের দশভুজা

নির্ধারিত জায়গায় রিজার্ভ এলাকায় ঢোকার পর দিয়ে গাড়ির নম্বর লিখে আমরা প্রবেশ করলাম সাতরেঙ্গার কাছে। ট্যুরিজমের প্রপার্টিতে এসে এতক্ষণের জার্নি কোথায় হাওয়া হয়ে গেল। এত সুন্দর একেকটি ছোটখাটো বাংলো, প্রত্যেক টুরিস্ট এর জন্য নির্ধারিত। তিনটে ঘরের এবং নানা রকম জিনিষের সুবিধাজনক বাংলো। তার খরচও খুব কম। সেখানে যদি আপনি শুয়ে দরজা খুলে ড্যাম দেখেন, জানলা খুলে ড্যাম দেখেন তাহলেই আপনার মন ভালো হয়ে যাবে।

প্রপার্টির উল্টোদিকেই সেই কালো উঁচু শিবলিঙ্গের মতো পাহাড়। আমার মন যা বলেছিল তাই হল। কর্মচারীরা জানালেন ওই পাহাড়টির নাম মহাদেব পাহাড় এবং ওই অঞ্চলকে মহাদেব পাহাড় এলাকাই বলে, কিরকম মিলে গেল। পাহাড়টির কাছে গিয়ে, কিংবা দূর থেকে দেখে যাচ্ছি ওই পাহাড়ে আপনি চড়তে পারবেন না। একেবারে শিবলিঙ্গের মতো দেখতে গ্রানাইট পাথরের শিলা খণ্ড। অদ্ভুত ভূপ্রকৃতি‌। একটু পড়ন্ত বিকেলে পাশের বাংলো থেকে বেরিয়ে এলো কলকাতা থেকে যাওয়া আরেক বাঙালি পরিবার। সবাই মিলে চা পাকোড়া খেতে খেতে ড্যামের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম তারপর নামলো বৃষ্টি। মাটির সোঁদা গন্ধ, বৃষ্টির আওয়াজ, ড্যামের জলে বৃষ্টি পড়ছে, ড্যামের জল যেন আরো ফুলে ফুলে উঠছে সব মিলিয়ে এক মধুর অনুভূতি। রাতের খাবার তেমনি সুস্বাদু রান্না খেতে খেতে মনে হল এখানে বেশ কয়েকটা দিন কাটিয়ে দেওয়া যায়।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২১: কে তুমি নিলে আমার চিরসবুজের ‘অগ্নিপরীক্ষা’

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৭: গরমে পান্তা ভাত কি সত্যিই শরীর ঠান্ডা করে?

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১৭: অর্থনীতির প্রান্তিকতায় নারী এবং তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ

কিন্তু না আমার বেশিদিন থাকার উপায় নেই, কেন না সঙ্গে বৃদ্ধা মা রয়েছেন। এখানে কোনওরকম চিকিৎসা ব্যবস্থার সুযোগ পাওয়া যাবে না। এমার্জেন্সি হলেও ৪০ থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে কোরবা শহরে যেতে হবে। সুতরাং এখানে বিলাস করে দু-তিন দিন কাটানোর মতো সাহস আমি দেখাতে পারব না। অতএব রাতের ঘুম কেটে সকালে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে এখান থেকে বেরিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিলাম। আমার মতো যারা অসুস্থ মানুষ বৃদ্ধ মানুষকে ছাড়া যাবেন, তারা কিন্তু আরেকটা দিন অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারেন শুধুমাত্র বসে শুয়ে বসে ড্যামের সৌন্দর্য দেখে, আর অজস্র অ্যালামুণ্ডার শোভা দেখতে দেখতে। নানা রঙের অ্যালা্মুন্ডা এবং জবা অঞ্চলটিকে মাতিয়ে রেখেছে।

ফেরার পথে মহাদেব পাহাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে রাস্তায় নেমে নেমে পাহাড়ে আনাচে-কানাচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফটোগ্রাফি সেশন। পাহাড় গুলোর অপূর্ব ভঙ্গি এবং তার তলার সমতল ভূমি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। আর যদি একটু সকাল সকাল বেরোতে পারেন তাহলে রোদের মধ্যে আলোয় মিঠে আলোয় গ্রামের মানুষদের সঙ্গে সঙ্গে আপনিও তুলে নিতে পারেন দু’চারটে ফুল, চাষ করা দেখতে পারেন, রাস্তার দু’ধারে অজস্র ঝুলে থাকা কুমড়ো চাল কুমড়ো। অনায়াসে দুই একটা তুলে নিতে পারেন গ্রামের সরল মানুষ আপনাকে চাইলেই হাত বাড়িয়ে দিতে আসছে।—চলবে

ছবি: লেখক
* চেনা দেশ অচেনা পথ (Travel Offbeat): লেখক— অর্পিতা ভট্টাচার্য (Arpita Bhattacharya), শৈলীবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। বর্তমান আগ্রহ ও কাজ ভ্রমণ-সাহিত্য, ইকো-ট্যুরিজম, কালচার ট্যুরিজম, স্মৃতিকথা নিয়ে। এছাড়াও মুক্তগদ্য চর্চা ভালো লাগার জায়গা। এখন পর্যন্ত প্রকাশিত ৫টি গ্রন্থ এবং ৫০ টিরও বেশি প্রবন্ধ। সম্পাদনা করেছেন একটি বই এবং ধারাবাহিক সম্পাদনা করেন রবীন্দ্রনাথ টেগোর অ্যাডভান্সড রিসার্চ সেন্টারের জার্নাল।

Skip to content