শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


বৈদ্যর ঘর থেকে বেরিয়ে মঙ্গলের বাড়িতে যখন নিয়ে গেল, মঙ্গল যেহেতু টুরিসম বিভাগের কর্মচারী, একটা নির্দিষ্ট মাইনে আছে মাইনের ভিত্তিতে ওর ঘর একটু পরিসরে বড়। একটি টয়লেট আছে বাড়িতে। মেয়ে, বউ এবং মাকে নিয়ে সংসার। ওঁর বাড়িতে পেঁপে ও কুমড়ো গাছ দেখলাম। লক্ষ্য করে দেখেছি ছত্রিশগড়ের শহরাঞ্চলের লোকেরা এই দুটো সবজিকে খুব একটা ভালো নজরে দেখে না, খায় না।
বাইগাদের সঙ্গে চলতে চলতে আরও দুটো ওয়াচ টাওয়ারে গিয়ে উঠলাম। পড়ন্ত বিকেলের সূর্য পাহাড়ের ফাক দিয়ে আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে, চারিদিকে ধোঁয়াশা ছড়িয়ে আছে। ফিরে এলাম রিসোর্টে। সেখানে একটা অংশে বাইগা আদিবাসীদের নির্দিষ্ট রীতি অনুযায়ী নির্মিত ঘর, দেওয়ালের কারুকাজ দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল আদিম ভারতবর্ষে ফিরে গিয়েছি। সবচেয়ে বড় কথা আপনি এই অঞ্চলে আপনার মোবাইলের টাওয়ারটা কিন্তু পাবেন না। অতএব যে কদিন আপনি এখানে আছেন সভ্য ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয় একেবারে শান্তিতে ঘুমাতে পারবেন, সময় কাটাতে পারবেন। রাত্রিবেলা খাবারের অর্ডার দিতে বলল, “আলু পোস্ত করে দেবো?”

অবাক বিস্ময় তাকিয়ে বললাম, “তুমি আলুপোস্ত করে দেবে?”

বলল, “হ্যাঁ।”
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১২: বাইগা রিসর্ট ও বস্তি

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-১১: কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দু’ একটি ছবি তুলতে না তুলতেই হাত অসাড় হয়ে যাচ্ছিল

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৬: কবির ভালোবাসার পশুপাখি

খুব কৌতুহলবশত আলুপোস্ত অর্ডার দিলাম। এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে, বাংলার বাইরে বেরিয়ে এলে আমার সেই ডাল, ভাত, আলুপোস্ত, মাছের ঝোল এরই চাহিদা থাকে, আমি স্থানীয় খাবারই খেতে পছন্দ করি। আদিবাসী একজন মানুষ আলুপোস্ত করে দিতে চাইছে, কী হবে এই ভেবেই আলুপোস্তর অর্ডার দিলাম। চমৎকার আলুপোস্ত। বললাম, “তুমি কোথা থেকে শিখলে?”

বলল, “আপনাদের মতোই বাঙালি টুরিস্ট আমাকে শিখিয়েছে।”

অতএব পরম তৃপ্তির সঙ্গে খাওয়া দাওয়া করি, এরপর বিছানায় শুয়ে পড়া ছাড়া আর কোনও কাজ নেই। রাত যত বাড়ছে চারপাশে নানা ধরনের পোকার আওয়াজ। পোকার যে এত আওয়াজ হতে পারে, এত ধরনের আওয়াজ হতে পারে, তা আজ প্রথম অনুভব করলাম।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪: অপবাদ এবং রামচন্দ্রের সুশাসনের রামরাজত্ব

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৯: সুরের আকাশে ঘটালে তুমি স্বপ্নের ‘শাপমোচন’

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৪: পঞ্চমকে সিনেমা হলে বসিয়েই বেরিয়ে যান রীতা

পরদিন সকালবেলা অভ্যাসবশত পাঁচটার আগে ঘুম ভেঙে গেল। জানলার পর্দাটা সরিয়ে চেয়ারে বসেছি। ওমা সেকি কথা! চোখের সামনে সূর্য উঠছে। এই সূর্যোদয় দেখতে টাইগার হিল থেকে শুরু করে পণ্ডিচেরি সমুদ্র পর্যন্ত কোথায় না কোথায় ছুটে গিয়েছি আজকে ঘরে বসে চেয়ারে দোলা খেতে খেতে আস্তে আস্তে সূর্যোদয় দেখলাম। নানা রঙের খেলা ছড়িয়ে ছড়িয়ে পাহাড়ের মাথায় কখনও লাল, কখনও সোনালি, কখনও সাদা আলোয় আলোকিত করতে করতে সূর্য উঠলো। সে এক অনির্বচনীয় সুখ, ঘরে বসে সূর্যোদয়।

সূর্যোদয়ের পরেই আমাদের আজকের গন্তব্যগুলো আমরা নির্ধারিত করে ফেললাম। প্রথম যাব ভোরামদেব মন্দির চত্বর দেখতে। ভোরামদেব মন্দির চত্বর চিল্পী ঘাঁটি থেকে যেতে হলে আবার আপনাকে পার করে যেতে হবে ওই ভোরামদেব রিজার্ভ ফরেস্টের ৫ কিলোমিটার, যেখানে সকালবেলায়ও আলো প্রবেশ করে না। সেটি পার করে চলে এলাম ঝিলের পাশে, সেখানে লোকে বোটিং করছে, অপূর্ব চারিদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছে। তার ঠিক পাশেই ভোরামদেব মন্দির চত্বর। হাওয়া দিচ্ছে, হাওয়ার এত আওয়াজ, ঝড় নয় কিন্তু, স্বাভাবিক হাওয়ার এত আওয়াজ, ভাবা যায় না।
আরও পড়ুন:

পর্দার আড়ালে, পর্ব-২৯: অমরগীতি ছবিতে রাজাবাবু চরিত্রে তরুণ মজুমদারের প্রথম পছন্দ ছিলেন ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৩: সারাদিন যত পারেন জল খান! এতে শরীরের ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে না তো? কী করে বুঝবেন?

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮: ‘বাইরে বেরুলেই বিপদ!’

খানিকটা যেন দুয়োরানীর মতো স্ট্যাটাস ভোরামদেব মন্দিরের শিল্পকার্যের। সত্যিই পর্যটক কম, খাজুরাহের পাশাপাশি এই মন্দির রাখলে এও কম যায় না ইরোটিক আর্ট এবং স্কাল্পচারে। ভিতরে শিব মন্দির। কলচুরি রাজাদের অমর সৃষ্টি, কিন্তু এই মন্দিরের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে শিব ভগবানের সঙ্গে একইসঙ্গে পূজিত হচ্ছেন গণেশজি এবং দুপাশে রয়েছে রাজা এবং রানির প্রস্তরীভূত দুটি মূর্তি। দেখে আপনি বুঝতে পারবেন না। অনেকটা পুরনো দেবতাদের মূর্তির মতোই দেখতে।

কিন্তু পুরোহিত বললেন আমাকে রাজা এবং রানীর মূর্তি। গোটা মন্দির চত্বর শুধুমাত্র ঘুরে ঘুরে বোঝার জন্য ছবি তোলার জন্য ঘণ্টা দুয়েক সময় কাটিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য এখানে কোনও গাইড নেই যে, সমস্ত ভাস্কর্যগুলির একটা সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করতে পারে আমাদের মধ্যে একটা ইতিহাসবোধ জাগিয়ে তুলতে পারে।—চলবে

ছবি: লেখিকা
* চেনা দেশ অচেনা পথ (Travel Offbeat): লেখক— অর্পিতা ভট্টাচার্য (Arpita Bhattacharya), অধ্যাপিকা, বাংলা বিভাগ, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ। শৈলীবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। বর্তমান আগ্রহ ও কাজ ভ্রমণ-সাহিত্য, ইকো-ট্যুরিজম, কালচার ট্যুরিজম, স্মৃতিকথা নিয়ে। এছাড়াও মুক্তগদ্য চর্চা ভালো লাগার জায়গা। এখন পর্যন্ত প্রকাশিত ৫টি গ্রন্থ এবং ৫০ টিরও বেশি প্রবন্ধ। সম্পাদনা করেছেন একটি বই এবং ধারাবাহিক সম্পাদনা করেন রবীন্দ্রনাথ টেগোর অ্যাডভান্সড রিসার্চ সেন্টারের জার্নাল।
 

বাইরে দূরে

লেখা পাঠানোর নিয়ম: এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। লেখার সঙ্গে বেশ কিছু ছবি পাঠাতে হবে। চাইলে ভিডিও ক্লিপও পাঠাতে পারেন। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content