মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


শিরপুর ভ্রমণ শেষ করে কোনও এক সকালে আপনি বেরিয়ে পড়তে পারেন অন্য কোনও এক ঠিকানার উদ্দেশ্যে। আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল ছিল কাওয়ার্ধা জেলার ভোরামদেব মন্দির চত্বর এবং তার আশেপাশের এলাকা।

শিরপুর থেকে প্রায় ১৮২ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে তবে আপনি পৌঁছতে পারবেন কাওয়ার্ধা জেলায়। একটা জিনিস লক্ষ্য করে দেখেছি, ছত্রিশগড়ের এক জায়গা থেকে আরেকটা জায়গা, বিশেষত যে জায়গাগুলি পর্যটকদের জন্য উল্লেখযোগ্য তার দূরত্ব অনেক। এবং আপনার চারচাকা না থাকলে একটি জায়গা থেকে আরেকটি জায়গায় পৌঁছতে একটি গোটা দিন লেগে যাবে। পরিবহন ব্যবস্থা ততটা উন্নত নয়, কিংবা ধরুন উন্নত কিন্তু জায়গার দূরত্ব এত যে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট পৌঁছতে এতটাই সময় নিয়ে নেবে।
কাওয়ার্ধা পৌঁছতে পৌঁছতে চওড়া রাস্তার দু’ পাশে নজরে পড়বে, প্রচুর রাইস মিল, আদানিদের পাওয়ার প্রজেক্ট, তার সঙ্গে প্রচুর ধানের ক্ষেত। কিন্তু গোটা রাস্তা জুড়ে আপনি দেখার মতো একটি চায়ের দোকানে পাবেন না। অনেক কষ্টে এই ১৮২ কিলোমিটার যাত্রাপথে একটি চায়ের দোকান পাওয়া গিয়েছিল। জিজ্ঞাসা করা হল, ‘এত চায়ের দোকান কম কেন?’ উত্তর পেলাম, ‘ট্যুরিস্ট তো কম।’ স্থানীয় লোকজন রাস্তায় বেরোয় কম, যারা বেরোয় তাদের তিন বেলা খাবার ভাত। ভাত ছাড়া অন্য খাবারকে তারা বিলাসিতা মনে করে। অতএব চায়ের দোকান খুব কম ।রাস্তায় বেরোলে জল এবং খাদ্য সঙ্গে নিয়ে রাখবেন না হলে ছত্রিশগড় ভ্রমণে কিঞ্চিৎ অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে।
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১০: স্থাপত্য ছাড়িয়ে অভয়ারণ্য

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-১০: ব্যস্ত পৃথিবী ছাড়িয়ে কোথায় যেন চলে এলাম উত্তরমেরুর জনমানবহীন এই জঙ্গলে, যেখানে এখন শুধুই রাত

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৫: নৌকো উল্টে সত্যেন্দ্রনাথের আইসিএস পড়তে যাওয়া বানচাল হতে বসেছিল

কাওয়ার্ধা জেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থান ভোরামদেব মন্দির চত্বর। ভোরামদেবকে ‘ছত্রিশগড়ের খাজুরাহো’ বলা হয়। কিন্তু আমরা ভোরামদেব মন্দির ও সারোদা-দাদার ড্যাম এগুলোকে সেদিনের জন্য একপাশে সরিয়ে রেখে এগিয়ে গেলাম ভোরামদেব রিজার্ভ ফরেস্টের এলাকার মধ্য দিয়ে চিল্পীঘাটির দিকে। চিল্পীঘাঁটি ছত্রিশগড়ের গুরুত্বপূর্ণ ঘাট এলাকা। ‘ঘাট’ মানে পূর্বঘাট পর্বতমালার অংশ। যেখান দিয়ে মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে ছত্তিশগড়ের যোগাযোগ এবং নানা ধরনের খনিজ সম্পদ সর্বদা ট্রাকে করে এদিক থেকে ওদিক ওদিক থেকে এদিক হচ্ছে।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২: ‘আও টুইস্ট করে’ গানের জন্য পঞ্চমের সঙ্গে শচীনকর্তার বাক্যালাপও বন্ধ ছিল বেশ কিছুদিন

দশভুজা: সেই ষোলো মিনিটের দূরত্ব কোনওদিন পূরণ হয়নি

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-২: রামকথার পটভূমি এবং মহাভারতে কথকের কথাসূত্র

চিল্পীঘাটি থেকে ৫৫ মিটার দূরে কানহা রিজার্ভ ফরেস্ট। এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা আপনাদের সকলেরই জানা আছে। কিন্তু চিল্পীঘাটির রাস্তা অসম্ভব ভয়ের, জিগজ্যাক। যাকে বলে এক পাশ থেকে গাড়ি আসলে আরেকদিকের ড্রাইভার সতর্ক না থাকলে কতবার যে কত ধরনের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে আমাদের বাহন চালক সে গল্প শোনাতে শোনাতে ওই ভয়ংকর রাস্তাটির অতিক্রম করল। চিল্পীঘাটিতে পৌঁছবার আগে ভোরামদেব অরণ্যে যে পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা চেকপোস্ট এর মধ্য দিয়ে আমরা গিয়েছিলাম, সেই রাস্তায় জঙ্গল এত গভীর যে দুপুর বেলা একটার সময় প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন পথ দিয়ে গা ছমছম করতে করতে আমাদের যাত্রা।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৭: আপন হতে আপন জন ‘রাইকমল’

হেলদি ডায়েট: বেশি কলা খাওয়ার অভ্যাস কি স্বাস্থ্যকর? মারাত্মক কোনও রোগের কারণ হয়ে উঠবে না তো?

অ্যালঝাইমার্সের যত্ন বেশ চ্যালেঞ্জের, সঠিক পরিচর্যায় ধৈর্যশীল, সহনশীল, সংবেদনশীল এবং কৌশলী হতে হবে

চিল্পীঘাটি পার করে এসে আরও ৪ কিলোমিটার এগিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে বাইগা ট্যুরিস্ট রিসোর্ট। এই বাইগা ট্যুরিস্ট রিসোর্ট ছত্তিশগড় ট্যুরিজমের এক অপূর্ব সম্পদ। যারা বাইগাতে থেকেছেন রাত কাটিয়েছেন তারাই জানেন যে এখানে থাকাটা কত মনোমুগ্ধকর। আপনার কটেজের রুমের জানলাকে খুলে দিলেই পাহাড়। আচ্ছা কে ঘরে বসে সূর্যোদয় দেখে? জানি না তবে আমি তো আমার জীবনে প্রথম সূর্যোদয় এত চমৎকারভাবে ঘর থেকে বসে দেখতে পেলাম। বাইগা ছত্তিশগড়ের এক উপজাতি। এই রিসোর্ট এর কাছাকাছি বাইগাদের গ্রামও আছে। রিসোর্ট এর মধ্যে বাইগা আদিবাসীদের শিল্পকলা তাদের ঘর ইত্যাদি সুন্দরভাবে জনসাধারণের জন্য প্রজেক্ট করা হয়েছে। রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ রাজি হলে বা ট্যুরিস্টরা চাইলে সন্ধ্যেবেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, ছত্রিশগড়ের দূর্গ, রায়পু্র, বিলাসপুরের কাছে যে সমস্ত মানুষেরা থাকেন তাদের কাছে বাইগা উইকেন্ড ট্যুরের একটি চমৎকার জায়গা। অবশ্য আবারও বলে রাখছি, এই সমস্ত জায়গায় আসতে গেলে নিজস্ব বাহন কিংবা চারচাকা ভাড়া করেই আসতে হবে। স্থানীয় পরিবহন কিছু পাওয়া যাবে না। বাইগা ট্যুরিস্ট রিসোর্টে ঢুকলে ফুরফুরে মন নিয়ে আপনি স্থানীয় আদিবাসী, যারা ওই রিসোর্টের কর্মচারী, তাদের আপনার পরিচর্যায় নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দিতে পারেন ২-৩ টি দিন।—চলবে

ছবি: লেখিকা
* চেনা দেশ অচেনা পথ (Travel Offbeat): লেখক— অর্পিতা ভট্টাচার্য (Arpita Bhattacharya), অধ্যাপিকা, বাংলা বিভাগ, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ। শৈলীবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। বর্তমান আগ্রহ ও কাজ ভ্রমণ-সাহিত্য, ইকো-ট্যুরিজম, কালচার ট্যুরিজম, স্মৃতিকথা নিয়ে। এছাড়াও মুক্তগদ্য চর্চা ভালো লাগার জায়গা। এখন পর্যন্ত প্রকাশিত ৫টি গ্রন্থ এবং ৫০ টিরও বেশি প্রবন্ধ। সম্পাদনা করেছেন একটি বই এবং ধারাবাহিক সম্পাদনা করেন রবীন্দ্রনাথ টেগোর অ্যাডভান্সড রিসার্চ সেন্টারের জার্নাল।

Skip to content