শেষনাগের ভোরবেলা।
বালতাল হয়ে একদিনে অমরনাথ যাত্রা করা সম্ভব হলেও কিসের আকর্ষণে এ পথে তিনদিন ধরে অনেক কষ্ট স্বীকার করে বেশিরভাগ মানুষ যাত্রা করে, এ যেন শেষনাগে পৌঁছে বুঝতে পারলাম। সূর্য অস্তাচলে চলেছে। অদূরে বরফঢাকা পাহাড়ে লাল আভা। গোধূলির আলোয় লালচে রঙের খেলায় অপূর্ব শেষনাগ। রাত ৮টায় সূর্যাস্ত হল। সূর্য ডোবার পর সেকি হাড় কাঁপানো ঠান্ডা! হ্রদের ধারে সুপ্রশস্ত বরফে ঢাকা উপত্যকায় অসংখ্য তাঁবু। সেখানেই রাতে থাকার আয়োজন। এখানে দু’ ধরনের তাঁবু আছে। কোনও তাঁবুতে ছটা খাটিয়া পাতা। কোনওটিতে আবার মাটিতে কম্বল বিছিয়ে শোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের পৌঁছাতে একটু দেরি হয়েছিল, তাই খাটিয়াসমেত তাঁবু পেলাম না। তিনজন পাঞ্জাবি ছেলের সঙ্গে তাঁবু ভাগ করে নিতে হল।
এগিয়ে চলার পালা।
বাইরে বড় ভাণ্ডারা আর যথারীতি অঢেল খাওয়ার আয়োজন। কিন্তু শরীরে এত ক্লান্তি যে খাওয়ার ইচ্ছেটুকুও নেই। কিন্তু তাও খেতে হবে। বাইরে কনকনে ঠান্ডা। যদিও তাঁবুগুলো বরফের ওপরেই। ক্লান্ত শরীরটাকে কোনও মতে টেনে নিয়ে ভাণ্ডারার কাছে গিয়ে পৌঁছলাম। সেখানে রীতিমতো হই হই কাণ্ড। যাত্রীরা দিনের শেষে ভিড় করেছে সেখানে। চারিদিক রকমারি খাবারের সুবাসে ম ম করছে। যৎসামান্য কিছু খেয়ে ভাণ্ডারা থেকে মোমবাতি এনে ঢুকে পড়লাম তাঁবুতে। কাল ভোরে রওনা দিতে হবে।
ভোরের আলোতে পথ চলা।
পাঞ্জাবের ছেলেরা এ পথে তৃতীয় বার চলেছে। ওরা আগামী কাল অমরনাথ পৌঁছে যাবে। কিন্তু আমরা কাল পঞ্চতরণীতে রাত কাটাব। কাল সবচেয়ে দুর্গম পথে যেতে হবে আমাদের। ওদের সঙ্গে গল্প করছিলাম। সম্পূর্ণ অপরিচিত তিনজনের সঙ্গে দিব্যি আলাপ জমে উঠলো। এই সময় একটা অনভিপ্রেত কাণ্ড ঘটল। জল তেষ্টা পাওয়ায় মোমবাতির সামান্য আলোয় জল খেতে গিয়ে অসাবধানতাবশত আমার হাতের বোতল থেকে জল গেল পড়ে। সমস্ত লেপ কম্বল ভিজে গেল। একে তীব্র ঠান্ডা তায় সব ভিজে।
এই কি স্বর্গ?
ভোরবেলাতে উঠে পড়েছে সকলে। আজ তাড়াতাড়ি রওনা দিতে হবে। পথে পড়বে মহাগুনাস পাস। ১২টার মধ্যে পাস পার হয়ে এগিয়ে যেতে হবে। নচেৎ আবহাওয়া খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। স্বেচ্ছাসেবকরা এই ভোরেই যাত্রীদের সুবিধার জন্য গরম জলের ব্যবস্থা করে রেখেছে। কিন্তু এত ক্লান্তি, যে আর উঠে গিয়ে অন্য লেপ ইত্যাদি আনতে ইচ্ছা করল না। ঘুমিয়ে পড়লাম ওই অবস্থাতেই। সে রাতে কোনও শরীর খারাপ হয়নি। মাঝেমধ্যে মনে হয়, এই যে এত পাহাড়ে যাই, এমনকি শীতকালেও কতবার সিকিম বা দার্জিলিং গিয়েছি বেড়াতে, কত আরামে হোটেলে থাকি, সাবধানে থাকি যাতে শরীর খারাপ না হয়। অথচ ওই তীব্র ঠান্ডায় তুষার রাজ্যে শরীরও বুঝি সয়ে গিয়েছিল, একঘুমেই রাত কাবার হয়েছিল। ঘুম ভাঙল, ভোর চারটে তখন। তাঁবুর বাইরে বহু মানুষের যাতায়াত, কথাবার্তা।
পূর্বদিক ঊষার আলোয় অপূর্ব মনোরম। শেষনাগ যেন পিছু ডাকছে। মনে হচ্ছে থেকে যাই! কিন্তু আমাদের তো এগিয়ে যেতেই হবে সামনের দিকে। আগেই বলেছি, যাত্রাপথে আজকের পথ সবচেয়ে দুর্গম। এ পথে গাছপালা নেই বললেই চলে। বরফের চাদরে মোড়া পথে এগিয়ে চলেছি ধীরে, সাবধানে। অনেক জায়গায় বরফ গলে যাওয়ায় কর্দমাক্ত হয়ে আছে, যা বিপজ্জনক। তার মধ্যে ঠান্ডার জড়তা তো রয়েছেই।
মহাগুনাস টপ।
ক্রমশ চড়াই পথে এগিয়ে চলেছি। ক্লান্তিবোধ হলে সামান্য জিরিয়ে নিই। আবার পথ চলি। বিপরীতগামী কিছু মানুষ এই বলে আশ্বস্ত করে এগিয়ে যান, আর সামান্য গেলেই পাস এ পৌঁছে যাবেন। পথে হঠাৎ দেখি ক্র্যাচ হাতে এক যুবক একপায়ে এগিয়ে চলেছে অবলীলায়। কোনও কষ্টের আভাসমাত্র নেই তার চোখে মুখে। ‘পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম্’ পড়েছি, আজ চাক্ষুষ করলাম। কিসের আশায় সে চলেছে এভাবে? কীভাবেই বা এত মনের জোর একত্র করে পথ চলেছে? জানা নেই উত্তর। ভাবতে ভাবতে পথ চলেছি আর পৌঁছে গিয়েছি মহাগুনাস টপ। এটা এই পথে সর্বোচ্চ স্থান, সমুদ্র তল থেকে ১৪৮০০ফুট উঁচুতে। স্থানীয় লোক বলে গণেশ টপ।
দুর্গমের পথে।
আজ এখানে পরিষ্কার আবহাওয়া। তবে বেলা ১২টার পর অন্যরকম হতেও পারে। মাথার ওপর সূর্যের প্রখর কিরণ। বরফের অনেক নীচে খরস্রোতা নদী প্রবহমান। জওয়ানেরা বেলচা দিয়ে বরফ কেটে সিঁড়ি তৈরি করে দিচ্ছেন। অতি সাবধানে সে পথ দিয়ে এগিয়ে চলি। প্রতি মুহূর্তে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা (দু’ একবার পড়েওছি)। অতি উৎসাহী কেউ কেউ স্কি করে চলেছে।—চলবে
বাইরে দূরে
লেখা পাঠানোর নিয়ম: এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। লেখার সঙ্গে বেশ কিছু ছবি পাঠাতে হবে। চাইলে ভিডিও ক্লিপও পাঠাতে পারেন। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com