অ্যাম্ফিথিয়েটারের অন্তর্বর্তী মল্লভূমি যেখানে জনসমক্ষে হাজার হাজার মানুষের বিচার হত।
বছর আটেক আগে আমি আর আমার উনি দুজনে জেনেভা থেকে ইজি জেটে রোমের উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছিলাম। ইজি জেট মানে যৎসামান্য জিনিস সঙ্গে নেওয়া যাবে, সেইমতো ঘাড়ে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে যাত্রা করলাম। এক ঘণ্টার মধ্যেই রোমে উপস্থিত হলাম। সুন্দর, ছিমছাম গোছানো শহর। বাড়ি ঘর সব ইউরোপীয় কায়দার৷ রাস্তায় অনেক খাবারের দোকান, সেইসব দোকানে সবাই খেতে আর গল্প করতে মশগুল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তখন আমার মাতৃসত্তার বিকাশ ঘটেনি৷ জীবন জগৎ দেখার দৃষ্টিভঙ্গিও ছিল পৃথক৷ সব কাজ অনেক সময় নিয়ে করতাম৷ এখনকার মতো সদাব্যস্ত অবস্থা প্রায় ছিল না বললেই চলে। রোমের এয়ারপোর্ট থেকে শেয়ারের ট্যাক্সিতে দুজনে হোটেলে গিয়ে উঠলাম। বেশ সুন্দর হেরিটেজ হোটেল, অনেকটা আমাদের গ্র্যান্ড হোটেলের মতো। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে মেট্রো চেপে কোলোজিয়াম বা ফ্লেবিয়ান অ্যাম্ফিথিয়েটার দেখতে গেলাম। মেট্রো স্টেশন থেকে বেরিয়েই সেই দু’হাজার বছরের পুরনো সৌধের সামনে দাঁড়িয়ে যেন বাকশক্তি রোহিত হয়ে গেলাম। বিকেল হয়ে যাওয়াতে জানতে পারলাম কোলোজিয়াম বন্ধ হয়ে যাবে, অগত্যা আশপাশ ঘুরে দেখতে লাগলাম আর বিকেলের রোমের অপূর্ব শোভা উপভোগ করতে লাগলাম। রোম এক অদ্ভুত শহর, দু’হাজার বছরের পুরনো পৃথিবীর সঙ্গে বর্তমান পৃথিবীর সাবলীল সহাবস্থান, অনেকটা আমাদের দিল্লির মতো। অনেকটা সময় পায়ে হেঁটে ঘুরলাম, আশপাশের অনেক মিনার, সৌধ ঘুরে দেখলাম। রোমের মজা হল ইতিহাসকে এখানে ছুঁয়ে দেখা যায়। দিনটা ছিল শনিবার, রাত অব্দি ঘোরাঘুরি করে হোটেলে ফিরে এলাম। পরের দিন রবিবার কোলোজিয়ামের ভেতরে যাব বলে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে বেরিয়ে গেলাম। রবিবার কোলোজিয়ামের সামনের রাস্তায় গাড়ি চলতে দেয় না তাই রাস্তা ফাঁকা দেখে বেশ কিছু ছবি তুললাম। তার মধ্যে রোমের রাস্তায় কালো চশমা পরে উত্তমকুমারের একটা ছবি দেখেছিলাম কোনও এক পত্রিকায়, সেই ভঙ্গিতে একখানা ছবি তুললাম। তারপর টিকিট কেটে অ্যাম্ফিথিয়েটারের ভেতরে ঢুকে আরও বেশি করে যেন মুগ্ধ হয়ে গেলাম। বড় বড় সিঁড়ি বেয়ে নীচ থেকে ওপরে উঠে গেলাম, কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে চারপাশটা দেখতে লাগলাম আর মানুষে মানুষে, মানুষে পশুতে, রথে রথে প্রতিযোগিতা৷ প্রাচীন বিখ্যাত যুদ্ধের দৃশ্যায়ন কল্পনা করতে লাগলাম। একসঙ্গে ৬৫০০০-৮০০০০ দর্শক সংকুলানের ব্যবস্থা ছিল সেখানে। পরে জেনেছিলাম খ্রিস্টীয় ৮৪ অব্দে যখন এটি তৈরি হয়ে প্রথম জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয়েছিল তখন থেকে ১০০ দিন ব্যাপী টানা উৎসব চলেছিল। বিরতির সময় জনসমক্ষে প্রকাশ্যে অপরাধীদের ফাঁসি দেওয়া হত। ভেতরে থাকতে থাকতে মনে হতে লাগল সেসব আর্তনাদ যেন কানের ভেতর দিয়ে হৃদয়ে প্রবেশ করছিল। বুঝলাম আর বেশিক্ষণ সেখানে থাকা যাবে না কারণ যে অনুভূতি একান্ত নিজস্ব যা কারও সঙ্গে ভাগ করা যাবে না তাকে বেশিক্ষণ বয়ে নিয়ে চলা মুশকিল, তাই কিছু ছবি তুলে সেখান থেকে বিদায় নিলাম। দিনটা বেশ মেঘলা ছিল, আবহাওয়াও ছিল মনোরম তাই চারপাশটা ঘুরে দেখতে খুব সুবিধে হয়েছিল।
ভ্যাটিকানসিটি : রোমান ক্যাথলিক গির্জার বিশ্ব সদর দফতর আর পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম রাষ্ট্র।
কোলোজিয়াম ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা খুবই অসাধারণ। কোনও কিছুর সঙ্গেই এর তুলনা চলে না। আমার যেন কিছুতেই ঘোর কাটছিল না, এরই মধ্যে ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হল। যেসময় রোম গিয়েছিলাম সেই সময় গুগল ম্যাপ মানবসভ্যতার ওপর এখনকার মতো সদয় ছিল না, ফলে কাগজের ম্যাপই ছিল একমাত্র ভরসা। অনেকক্ষণ কোলোজিয়ামের মূল চত্বরে ঘোরাঘুরি করে বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে পায়ে হাঁটা দূরত্বে গিয়ে দেখতে শুরু করলাম রোমান ফোরাম। যদিও আগের দিন বিকেলে খানিকটা ঘুরে দেখেছিলাম কিন্তু সকালে আরও ভালো লাগল। মূল রাস্তার দুদিকেই ফোরামের অবশেষ আজও ছড়িয়েছিটিয়ে আছে। আমার মতো প্রাচীন ইতিহাসের অনুরাগীর পক্ষে জায়গাটা কাছ থেকে দেখা মানে যেন হাতে স্বর্গ পাওয়া। পুরোনো পৃথিবীর কল্পনার আতিশয্যে ভেসে যাওয়ার আনন্দই আলাদা। ২৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তৈরি এই রোমান ফোরাম ছিল রোমের সবচাইতে জনবহুল অঞ্চল। সাধারণ মানুষ থেকে রাজরাজড়া থেকে রাজপুরোহিত থেকে রাজকর্মচারী আর সেনেট সদস্যদের দৈনন্দিন জীবনের চারণভূমি ছিল এই ফোরাম। রোমের সবচেয়ে প্রাচীন সৌধ, মিনার, মন্দিরগুলো এই অঞ্চলেই অবস্থিত ছিল, তার মধ্যে ট্রেজানের মিনারটি আজও বিখ্যাত। এরই মধ্যে পরিষ্কার বাংলায় শুনতে পাচ্ছিলাম ‘দিদি ছাতা নেবেন?’ ‘গোলাপ নেবেন?’ এই জাতীয় আবদার। ছাতা যদিও সঙ্গেই ছিল কারণ আমার সঙ্গীটি বরাবরই এসব ব্যাপারে সতর্ক৷ ঘুরতে গেলে আমার মতো ছন্নছাড়া নয়৷ আর এই ছাতা গোলাপের একচেটিয়া ব্যবসা ইতালিতে যে বাঙালিদের হাতে এটা বুঝতে আমার আর কোনও অসুবিধে রইল না। ফোরামের আশপাশে বেশ কিছু খাবারের দোকান আর সেইসব দোকানগুলোতে উপচে পড়া ভিড় দেখেছিলাম। এমনিতেই রোমে সারাবছর পর্যটকদের আনাগোনা খুবই বেশি। এরই মধ্যে দু’পা এগোতেই শুনতে পেলাম এক অপূর্ব সুন্দরী মহিলার মায়াবী কণ্ঠের গান! সে গানের রেশ যেন আজও কানে লেগে আছে। পুরোটাই হচ্ছিল একটা স্ট্রিট পারফরম্যান্স হিসেবে। সেখানে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে গান শুনে ম্যাপ হাতে করে সোজা রাস্তা ধরে ঘরবাড়ি, গলিঘুচি পেরিয়ে পৃথিবী বিখ্যাত ট্রেভির ফোয়ারা দেখতে এগিয়ে গেলাম। ট্রেভির ফোয়ারা নামের কারণ এটা রোমের ট্রেভি অঞ্চলে অবস্থিত। ইতালিয়ান আর্কিটেক্ট নিকোলা সালভি এর ডিজাইন করেন। এটা দেখার জন্য সরু গলির দিয়ে ভেতরে যেতে হয়। গলির ডানদিকে আইসক্রিমের দোকান দেখে চোখ আর মন দুটোই আটকে গেল। আইসক্রিম খেয়ে ট্রেভির ফোয়ারা দেখে পাশেই অবস্থিত রোমান প্যানথিয়নের দিকে এগিয়ে গেলাম। প্যানথিয়ন মানে সমস্ত দেবতার মন্দির। বর্তমানে এটা খুবই সুন্দর ভাবে রক্ষিত আর ক্যাথলিক চার্চ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ইউরোপের বিশেষত্ব হল সেখানকার সমস্ত চার্চ, মিউজিয়ামের ভেতরের ছবি তুলতে দেওয়া হয়। কোথাও কোনও বাধা নেই। তাই প্যানথিয়নের ভেতরের বেশ কিছু ছবি তুললাম। এত বেশি লোকজন ট্রেভির ফোয়ারা আর প্যানথিয়ন দেখতে ভিড় করেছিল তাতে ইতালিতে আছি না দেশে আছি ভুলে যাচ্ছিলাম। বেশ খানিকক্ষণ ঘোরাফেরা করে সেই গলি থেকে বেরিয়ে দুজনে ভ্যাটিকান সিটি যাব বলে ভিড়ে ঠাসা বাসে উঠলাম। বাসে কেউ ইংরেজি বোঝে না আর আমরা ইংরেজি ছাড়া কোনও বিদেশি ভাষা জানি না৷
সিস্টিন চ্যাপেলে মাইকেলেঞ্জেলোর আঁকা বিখ্যাত শিল্পকীর্তি।
আমার মা বলেন, ‘এরপর কী খাব’ ভাব আমার ছোট থেকেই৷ ভ্যাটিক্যান সিটিতে গিয়েও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। সেন্ট পিটার্স স্কোয়ারে ঢোকার আগে ভ্যাটিক্যানের দেওয়াল লাগোয়া দোকান থেকে চিপস্ আর চকোলেট কিনে খানিকটা স্বস্তি হল বলা হয়নি বাসে ভাগ্যক্রমে এক সাহেবকে পেয়েছিলাম যিনি আকারে ইঙ্গিতে ভ্যাটিক্যানের স্টপেজ দেখিয়ে দিয়েছিলেন তাই সে যাত্রায় বেশি ঘুরপাক খেতে হয়নি। সিটির ভেতরে মূল দ্রষ্টব্য হল সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা, ভ্যাটিক্যান মিউজিয়াম আর সিসটিন চ্যাপেল। সেদিন ব্যাসিলিকা দেখার অভিপ্রায়ে যখন চিপসের প্যাকেট খুলে খেতে খেতে লম্বা লাইনের একেবারে পেছনে দাঁড়ালাম ততক্ষণে বিকেল সাড়ে তিনটে বেজে গিয়েছিল। গুটি গুটি পায়ে এগোতে এগোতে পৃথিবী বিখ্যাত সেই স্থাপত্য কীর্তি আর হয়তো কোনওদিনও দেখার সুযোগ হবে না এই ভেবে নিরীক্ষণ করতে লাগলাম। এরই মধ্যে কোনও এক বিষয়ে ওঁর সঙ্গে হালকা বচসা, তার জেরে মনোমালিন্য এবং অন্যমনস্কতায় চিপসের প্যাকেট থেকে সব চিপস চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার সাক্ষী হয়ে থাকল আশপাশের সাহেব, মেম সাহেবরা। উল্লেখ্য তখন আমার আর ওঁর মধ্যে এখনকার মতো, ‘আমার স্বপ্ন তুমি ওগো চিরদিনের সাথী’ জাতীয় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল না। তাই তখনকার মতো স্ব স্ব মতে অটল থেকে নির্বিকার মুখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চিপসগুলোর সদগতি (পায়রার দ্বারা) দেখতে লাগলাম। এরই মধ্যে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। এরপর ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় চার্চ সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার ভেতরে ঢুকে অবাক হবার পালা। রেনেসাঁ শৈলীতে তৈরি এর অভ্যন্তরীণ স্থাপত্য (সিলিং আর মার্বেলের কাজ) সারাদিনের ক্লান্তি ভুলিয়ে মনকে যেন আলাদা প্রশান্তি দিল। মূল স্থপতিরা ছিলেন দোনাটো ব্রমান্টে, মাইকেল আঞ্জেলো, কার্লো মেদার্নো এবং লোরেনজো বার্ণিনি। রোমের প্রথম পোপ সেন্ট পিটারের সমাধিক্ষেত্রের উপরে ১৬২৬ খ্রিস্টাব্দে এটি পুনর্নির্মিত হয়। মুগ্ধতার আবেশ নিয়ে যখন ব্যাসিলিকার বাইরে এলাম তখন রাত নেমে গেছে। হোটেলের কাছাকাছি একটা ভারতীয় রেস্তোরাঁয় খেলাম, সে যাত্রায় পেট ভরলেও মন ভরল না। সকালে উঠে আমাদের গন্তব্য ছিল ভ্যাটিক্যান মিউজিয়াম আর সিসটিন চ্যাপেল। ভ্যাটিক্যানের কাছে গিয়ে একজন গাইড (ভদ্রমহিলা) ঠিক করা হল। পরে দেখলাম আমরা ছাড়াও আরও প্রায় ১০-১২ জন তাকেই অনুসরণ করছে। গাইড ভদ্রমহিলার কথা না বললেই নয়, বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছি কিন্তু উচ্ছ্বাস একেবারে দশ বছরের বালিকার মতো। আমরা ভারতীয় শুনে যারপরনাই খুশি হলেন, আগে অনেকবার ভারতে এলেও পশ্চিমবঙ্গে একবারও আসা হয়নি, এই নিয়ে আক্ষেপ করলেন। আমার হাতের পলা বাঁধানো দেখে, ‘আই লভ ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্গেলস্’ বলে উঠলেন। আমিও হাসিমুখে ওঁর সঙ্গে মিউজিয়ামের দিকে এগিয়ে গেলাম। ষোড়শ শতকের এই মিউজিয়ামে জগদ্বিখ্যাত রোমান স্থাপত্য এবং রেনেসাঁ শৈলীর সেরা শিল্পকর্মগুলো রক্ষিত এবং প্রদর্শিত হয়। আমাদের গাইড সিসটিন চ্যাপেলের ভেতরের সিলিং-এ আর দেওয়ালে মাইকেল আঞ্জেলোর অসামান্য ফ্রেসকো পেন্টিংগুলো দেখিয়ে দিতে দিতে জীবন সায়াহ্নে তার অন্ধ হয়ে যাওয়ার গল্পও বলেছিলেন। সৃষ্টি যে স্রষ্টার পঞ্চেন্দ্রিয়ের একটা ইন্দ্রিয়কে বিকল করে দিয়েছিল তার অন্য উদাহরণ বোধহয় ইতিহাসে দুর্লভ। সেবার প্রিয় মানুষদের জন্য রোম থেকে কিছু না কিছু (সুভেনিয়ার জাতীয়) এনেছিলাম। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল পিসা আর ফ্লোরেন্স। অন্য এক সময় সে গল্প করা যাবে।
পুনশ্চ : বৈবাহিক জীবনের শুরুতে ওঁর বদান্যতায় ঘোরা এইসব স্মৃতি আজও আমার কাছে অমলিন ও মূল্যবান হয়ে আছে।
ছবি : লেখক
পুনশ্চ : বৈবাহিক জীবনের শুরুতে ওঁর বদান্যতায় ঘোরা এইসব স্মৃতি আজও আমার কাছে অমলিন ও মূল্যবান হয়ে আছে।
ছবি : লেখক
বাইরে দূরে
লেখা পাঠানোর নিয়ম : এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে বেশ কিছু ছবি ও ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ পাঠাতে হবে। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না। ইমেল : samayupdatesin.writeus@gmail.com