শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


হাউলার মাঙ্কি: এক প্রজাতির বানর।

পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙল এক অদ্ভুত শব্দে। একটু ভূতুড়ে মতো, অনেক মানুষ একসঙ্গে, খুব জোরে জোরে শব্দ করে গোঙাতে শুরু করলে যেমন আওয়াজ হবে, অনেকটা সেইরকম। তার সঙ্গে মাঝে মাঝে যোগ হচ্ছে সামরিক চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপটে সৈনিকরা যেমন ঠোঁটে আঙুল দিয়ে উলু দেওয়ার মতো যেমন আওয়াজ করে সেরকম আওয়াজ। ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। আমি তো প্রথমেই ভাবলাম যে হয়তো মরে গিয়েছি। নরকে যমদূতেরা আমাকে ফুটন্ত কড়াইতে দেওয়ার আগে অমন শব্দ করছে, বা হয়তো যাদের ইতিমধ্যেই ফুটন্ত কড়াইতে ফেলে দিয়েছে তারাই গোঙাচ্ছে কষ্টে। খানিক পরে যখন আশ্বস্ত হওয়া গেল যে, না… তেমন ব্যাপার নয়; বেঁচেই আছি, তখন তাঁবুর বাইরে এলাম। এসে দেখি, গাছের বহু ওপর থেকে, চারদিক থেকে সেসব শব্দ আসছে। হাউলার মাঙ্কি। চিড়িয়াখানার বাইরে, একমাত্র আমাজনেই এদের দেখা মেলে। গাছের আড়ালে আবডালে বসে বসে চিৎকার করছে। এই চিৎকার কি তাদের নিত্য কর্মসূচি নাকি আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে চাইছে বলা মুশকিল। তবে আবিলো বলল যে এরা প্রতিদিন সকালেই এমন করে। বেশিক্ষণ থাকলে এরা খুব জ্বালাতন করবে। সব খাবারদাবার কেড়ে নিতে পারে, নষ্ট করে দিতে পারে। আমরাও তাঁবু গোটাতে লাগলাম ভয়ে ভয়ে। রামায়ণ পড়ার স্বার্থে বানরকুলের শক্তি সম্পর্কে আমার যথেষ্ট সমীহ আছে। আর এই কালো কালো বিরাট বিরাট বীর-হনুমানগুলোকে দেখে, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই বেশ ভয় লাগছিল। বাড়িতে কালীপুজোর চকলেট বোমা ফাটিয়ে হনুমান তাড়িয়েছি বটে। কিন্তু সে তো ভারতীয় বানর, রামের ভক্ত, সেই সূত্রে মানুষজনের প্রতি হয়তো একটু শ্রদ্ধা সমীহ আছে। কিন্তু এই আমাজোনিয়ান বানরের মানুষের প্রতি সেরকম শ্রদ্ধা ভক্তি আছে বলে তো মনে হয় না। কাজেই সন্তর্পণে কাজ সারতে লাগলাম। ইতিমধ্যে একটি বাঁদর গাছের অনেকটা নিচে নেমে এল আমাদের দিকে দাঁতমুখ বের করে। ভাবখানা যেন এই যে, ‘কে হে তোমরা? দু’ পায়ে চলে, আমাদের মতো সাজার চেষ্টা করে এসেছ। মতলব কী এখানে? অনেক হয়েছে, এবার মানে মানে সরে পড়ো তো।… না হলে….’ নাহলে কী করত আমি জানি না। আমরা আবার হাঁটা শুরু করলাম।

বুলেট অ্যান্টদের ফেলে যাওয়া এক কলোনি।

কথায় বলে ‘মর্নিং শোজ দা ডে।’ সকাল বেলায় মর্কট পর্ব থেকে বেরোনোর সময়ও ধারণা ছিল না আজকের দিনটি ঠিক কতটা রোমহর্ষক হতে চলেছে। আজকের আগে আমাদের কোনও ধারণাই ছিল না যে মৃত্যুর অনুভূতি ঠিক কেমন হতে পারে। আমরা ভাবতেও পারিনি যে আজ দিন শেষ হওয়ার পূর্বে দু’বার আমরা মৃত্যুকে অনুভব করব এত কাছ থেকে। একবার খুব কাছ থেকে কানে শোনা, আর একবার একদম চোখের সামনে দেখা। সেই গল্পই এখন বলব। তবে যাত্রা শুরু হোক তার একটু আগে থেকে। কিছু ছোটখাট বিপদের হাত ধরে। তাতে করে সেই ঘোর বিপদের পূর্বে পাঠকের মনে একটু প্রেক্ষাপটও তৈরি হবে ঠিক যেমন হয় কোনও ছায়াছবিতে। তবে ছায়াছবির মতো এ ঘটনা কাল্পনিক নয়। পুরোটাই বাস্তব। তাই আশা করি পাঠকের ভালোই লাগবে।
পরিকল্পনামাফিক এগিয়ে চলেছি। মশার কামড়, আগাছায় ঘেরা পিচ্ছিল রাস্তা অতিক্রম করে আমরা যাচ্ছি আগের দিনের মতোই। সারা দিন ওই সকালের বানরসেনার গল্প করতে করতেই এগোচ্ছিলাম। হঠাৎ সামনে দেখি এক বিশাল অংশ জুড়ে পিঁপড়েদের ফেলে যাওয়া আস্তানা। মাটি খুঁড়ে বানানো পিঁপড়েদের এই ঘর দেখতে একই রকম যেমন আমরা দেখি বাগানে, পথেঘাটে সর্বত্র। কিন্তু যখনই এর উচ্চতা হাঁটুর কাছাকাছি চলে আসে, তখনই মনে আশঙ্কা আর অল্পবিস্তর ভীতিরও উদ্রেক হয়। আবিলো আর বাদিয়ার কথায় জানা গেল যে এটাই মার্ডারার-অ্যান্ট বা বুলেট-অ্যান্টদের কলোনি। এরা দৈর্ঘ্যে হয় প্রায় ২ ইঞ্চির কাছাকাছি মানে প্রায় আমাদের কড়ে আঙুলের সমান। এদের চার-পাঁচটা একসঙ্গে কামড়ালে মানুষের মৃত্যু হতে পারে। এদের পুরো কলোনি এক জায়গায় থাকলে আমাদের সেই রাস্তায় মুশকিল হয়ে যেত। কিন্তু আমরা যখন সেখানে পৌঁছলাম কয়েকটি মাত্র এদিক-ওদিক চলে বেড়াচ্ছিল। তাছাড়া তাদের কলোনি প্রায় শূন্য।

মার্ডারার বা বুলেট অ্যান্ট: পৃথিবীর সবচাইতে বড় পিঁপড়ে।

কিছুদূর গিয়েই তার উত্তর মিলল। দেখলাম একটা সরু সুড়ঙ্গের মুখ। আবিলো বলল যে এটা আর্মাডিল্লোর কাজ। আর্মাডিল্লো হল পিপীলিকা-ভুক। তারা পিঁপড়েদের কলোনির একটু দূর থেকে মাটি খুঁড়ে সুড়ঙ্গ বানিয়ে সেই কলোনিতে আক্রমণ করে এবং পিঁপড়েদের খেতে শুরু করে। একবার আর্মাডিল্লো একটি কলোনির খোঁজ পেলে বারবার সেখানে আক্রমণ করতে থাকে যতক্ষণ না সব পিঁপড়ে খাওয়া হয়ে গিয়ে কলোনি ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। যেসব পিঁপড়েরা প্রাণ রক্ষা করতে পারে তারা পালিয়ে যায়, বা বলা ভালো অভিপ্রয়াণ করে অন্যত্র নতুন কলোনি গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে। সেই কারণেই মার্ডারার অ্যান্টদের এই বিশাল কলোনিটি প্রায় ফাঁকা। মনে মনে ওই আর্মাডিল্লো টিকে অথবা তাদের দলটিকে একবার দোষারোপ করলাম অমন আকর্ষণীয় একটি অভিজ্ঞতা থেকে, মানে এক পরিপূর্ণ হরা-ভরা মার্ডারার এন্ট কলোনি দেখার অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের বঞ্চিত করার জন্য। আবার পরমুহূর্তেই তাদের একবার ধন্যবাদ জানালাম আমাদের যাত্রাপথকে সুগম করে তোলার জন্য।

কিন্তু তখনও জানতাম না দিন শেষ হওয়ার আগে আর কী কী অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য।—চলবে

ছবি সৌজন্য: লেখক

বাইরে দূরে

লেখা পাঠানোর নিয়ম : এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে বেশ কিছু ছবি ও ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ পাঠাতে হবে। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না। ইমেল : samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content