বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


জলপথে যাত্রা শুরু।

হস্টেলে পৌঁছে আবার দেখা হল অন্যান্যদের সঙ্গে। কিন্তু মার্টিন চলে গেছে অন্য কোনও গ্রামে তার তথ্যচিত্র বানানোর উদ্যেশ্যে; কবে ফিরবে কোনও ঠিক নেই। তাই তার সঙ্গে আর দেখা হল না। কাজেই তাকে আর ধন্যবাদ জানানো হল না এই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার জন্য।

সেদিন রাতেই নৌকাবিহারের জোগাড় করে ফেললাম। হস্টেলের মালিককে জিজ্ঞাসা করতেই সে একটা ঠিকানা দিয়ে দিল। সেখানে গিয়ে পরের দিনের জন্য নৌকাবিহারের বন্দোবস্ত হয়ে গেল। এটা অনেকটাই সাধারণ ট্যুর বুকিংয়ের মতো। ওখানে বেশ কিছু আঞ্চলিক সংস্থা আছে যাদের ওই নদীপথে পর্যটকদের নিয়ে যাওয়ার এবং ব্যবসা করার অনুমতি আছে। পরের দিন রারেনবাক থেকে গাড়ি এসে আমাদের নিয়ে যাবে নৌকা যেখান থেকে ছাড়বে সেখানে।

এখানে বলে নিই যে এই নৌকা যেখান দিয়ে যাবে সেই জায়গাগুলোকে বলে প্যাম্পাস। আমাজনের যেসব জায়গায় গাছের উচ্চতা এবং ঘনত্ব কম, বরঞ্চ তৃণভূমির আধিক্য, তাদের বলে প্যাম্পাস। নদীর দুধারে প্রচুর গাছ আছে কিন্তু সেখানে বিবসি বা ওইরকম উঁচু উঁচু কোনও বৃক্ষজাতীয় গাছ তেমন নেই। তাছাড়া আছে মাইলের পর মাইল বিস্তৃত জলা তৃণভূমি। যেমন আমাদের গ্রামবাংলার পুকুর ধারে ছোট গাছ, নলখাগড়া বা আগাছার বনজঙ্গল হয়ে থাকে সেই রকমই, কিন্তু সেই আগাছার জঙ্গলটাই হয়ে বিস্তৃত হয়েছে প্রায় আট-লক্ষ বর্গকিলোমিটার। আর এখানে নদীর খুব সামান্য অংশ ছাড়া বেশিরভাগটাই প্রায় সরু খালের মতো। গাছপালা সব ঝুঁকে এসে পড়ছে জায়গায় জায়গায়। কখনও সেসব ঝুঁকে পড়া গাছ আর আগাছায় নদীটাই হারিয়ে গেছে। আর এখানেই দেখা মেলে উদ্ভট যত বন্যপ্রাণীর।

নৌবিহারের দপ্তরেই জানলাম যে আমাদের সঙ্গে থাকবে একজন মাঝি। সে-ই হবে আমাদের গাইড। সে যে শুধু নৌকো করে আমাদের জঙ্গলের, বা বলা ভালো প্যাম্পাসের গভীরে নিয়ে যাবে তা-ই নয়, সে আমাদের সব জায়গাতে নামিয়েও দেখাবে যেখানে এনাকোন্ডা বা কাইমান দেখার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। তবে প্রথমেই জানিয়ে দেওয়া হল যে তাদের দর্শন নির্ভর করছে ভাগ্যের ওপর। এটা কোনও চিড়িয়াখানা নয় যে খাঁচার মধ্যে উঁকি মারলেই দেখা যাবে, অথবা কোনও সাফারি বা রিসার্ভড ফরেস্টও নয় যে নুন ছড়ানো জায়গায় জন্তু জানোয়াররা আসবে আর আমরা তাদের দেখব। হক কথা। কী আর করা যাবে। সেই ক্ষেত্রে শিকাগোয় শেড অ্যাকুয়ারিয়াম-এ খাঁচার মধ্যে যে এনাকোন্ডাটিকে দেখে এসেছি তাকে মনে করেই খুশি থাকতে হবে। তখন তাকেই না হয় মানসচক্ষে একবার বসিয়ে দেব ওই জঙ্গলের মধ্যে। অনেকটা ওই ‘পোকেমন গো’ গেমটার মতো। যেখানে মোবাইল ফোনের ক্যামেরা এবং জিপিএস-এর মাধ্যমে পারিপার্শ্বিক পরিবেশের ছবি নিয়ে তাতে বিভিন্ন জায়গায় কিছু পোকেমন বসিয়ে দেওয়া হয় আর খেলোয়াড়কে হেঁটে হেঁটে সেই জায়গায় গিয়ে পোকেমনটাকে ধরতে হয়।
যাই হোক, পরের দিন সকাল সকাল রারেনবাক থেকে গাড়ি নিয়ে চললাম যেখান থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হবে সেখানে। আমরা ছয়জন যাত্রী, এক ব্রিটিশ দম্পতি, নিউজিল্যান্ড-বাসী দুই মহিলা, আর একজন নেদারল্যান্ডের। আর সঙ্গে গাড়ি চালাচ্ছে বনি, যে কিনা একাধারে আমাদের গাড়ির চালক, নৌকার চালক এবং গাইড। এই মুহূর্তে, এই নেদারল্যান্ড-বাসীর সম্পর্কে একটু না বললেই নয়। তার নাম মার্টিন ভন মিউরিখ, বয়স মাত্র ১৯। আমার এ যাবৎ দেখা সবচাইতে কমবয়সি সোলো-ট্রাভেলার। মার্টিন তার হাইস্কুলের পাট চুকিয়েই বেরিয়ে পড়েছে আমাজন অভিযানে। ইউরোপে বিভিন্ন দেশে এই রকম ব্যাকপ্যাকিং, বা সোলো ট্র্যাভেলের মতো ঘুরে বেড়ানোর প্রচলন খুব সাধারণ। সম্ভবত তাদের অভিযাত্রিক ইতিহাসেরই রেশ, যা শুরু হয়েছিল কলম্বাস, ভাস্কোদাগামা বা ম্যাগেলানের মতো অভিযাত্রীদের হাত ধরে। তাই পৃথিবীর যেকোনও প্রান্তে যেকোনও জায়গায় গিয়েই ইউরোপিয়ান দেশগুলির বহু অভিযাত্রীর সঙ্গে আমার দেখা হয়েই থাকে। কিন্তু আমি এই প্রথম কাউকে দেখলাম যে অনূর্ধ্ব ২০। শুধু তাই নয়, সে বেরিয়ে পড়েছে একক অভিযানে; তাও বলিভিয়ান আমাজনের মতো দুর্গম অরণ্য প্রান্তরে যেখানে পর্যটনশিল্প এখনও তেমন গড়ে ওঠেনি।

প্রায় ঘণ্টাখানেকের পথ। রাস্তা এখনও তৈরি হচ্ছে। তাই গাড়ি লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে। হঠাৎ করে ওই আদিম অরণ্য থেকে বেরিয়ে এখানে একটু অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। দেখে একটু খারাপই লাগল কীভাবে জঙ্গল কেটে সাফ করে সেখানে রাস্তা বানানোর চেষ্টা চলছে। ধুলো ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে চারদিক। এখানে আর আগের দুদিনের মতো প্রাণ ভরে শ্বাস নেওয়া যায় না। শুধু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে একবার ভাবলাম যে কেমন সুন্দর হত যদি এই অংশটিও হেঁটে হেঁটে পার হতে হত আগের মতো। কিন্তু সে সব ভেবে লাভ নেই; সভ্যতার নিয়মই ওই। আমরা প্রত্যেকেই যারা বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত বা তাদের সাহায্যে জীবনযাপন করি বা অর্থ উপার্জন করি, তারা কেউই এই অপরাধের ঊর্ধ্বে নই। এবং যেখানে কোনও অলৌকিক বা অত্যাশ্চর্য ঘটনা ছাড়া সমস্যার আশু সমাধান সম্ভব নয় তা নিয়ে বেশি মাথা ঘামিয়ে খুব লাভ আছে বলে মনে হয় না। তাই খানিকক্ষণ সেসব নিয়ে আলোচনা করার পর সকলেই ভাবলাম, থাক সে আলোচনা। আমরা বরং বনির সঙ্গে গল্প করতে লাগলাম আমাজন সম্পর্কে। তার থেকেই জানলাম প্যাম্পাসের কথা, সেখানে জন্তুজানোয়ারের বৈচিত্র্যের কথা, ইত্যাদি ইত্যাদি।

পিরানহার আক্রমণ থেকে বাঁচতে আমাদের নৌকায় লাফিয়ে উঠে পড়া একটি মাছ। লেজের দিক থেকে তাকে খেতে শুরু করেছিল পিরানহার দল।

এইরকম রাস্তায় যেতে যেতেই হঠাৎ একজায়গায় বনি গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিল। রাস্তার ধারেই একটা মাঝারি উচ্চতার গাছ। তার মগডালে ঝুলছে এক শ্লথ। প্রকৃতির অদ্ভুত কারণে এরা স্তন্যপায়ী হয়েও শামুকের চাইতেও ধীরগতিসম্পন্ন। মনে পড়ে গেল জুটোপিয়া কার্টুন ছায়াছবিটির কথা যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অফ মোটর ভেহিকেলের কর্মচারীদের দেখানো হয়েছে শ্লথ হিসেবে। সেই নিয়ে একচোট হাসি তামাশা হল যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের সম্পর্কে। ভাগ্য ভালো যে দলের মধ্যে আমি এক যুক্তরাষ্ট্রীয় অভিবাসী ছাড়া আর কেউই নেই এই দেশ থেকে। আলোচনা সূত্রেই উঠে এল বলিভিয়ার বর্তমান রাজনীতির কথা। প্রসঙ্গত বলে রাখি আমরা যারা চে গুয়েভারা (বলিভিয়ান উচ্চারণে শে-গি-বরা) নিয়ে খুব মাতামাতি করি, বলিভিয়াতে তিনি তেমন জনপ্রিয় বলে মনে হল না। অনেকেই তার নামও জানে না। তবে বনি জানত। এবং সে-ই বলল যে পরবর্তী নির্বাচনের জন্য বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধীপক্ষ তাঁর আদর্শকেই ব্যবহার করছে নির্বাচনে জেতার অস্ত্র হিসেবে। যাই হোক, আমরা এসব কূটনৈতিক আলোচনাকে পাশে রেখে এগিয়ে চললাম প্যাম্পাসের দিকে।
প্যাম্পাসে পৌঁছলাম যখন প্রায় সকাল দশটা। সেখানে একদম শুরুতেই সুন্দর থাকার ব্যবস্থা। প্যাম্পাসের একপ্রান্তে বেশ কয়েকটা ছোট ছোট কুটির বানিয়ে রাখা, অনেকটা রিসর্টের মতোই। তার মধ্যে শোয়ার বন্দোবস্ত। তার একটিতে খাওয়ারও বন্দোবস্ত। আমরা জলখাবার খেয়েই বেরিয়ে পড়লাম প্যাম্পাসে নৌবিহারে।

ঘাটেই বাঁধা ছিল তিন-চারটি নৌকো। নৌকোগুলো গঙ্গাবক্ষে দেখা সাধারণ নৌকার মতোই। তবে অনেকটা সরু যাতে করে খুব সরু খালের মধ্যে, গাছপালার মধ্যে দিয়েই ঢুকে যেতে পারে। আর অবশ্যই তাতে কোনও ছই নেই; চারদিক খোলা, যাতে চারদিক দেখা যায়। নৌকাগুলিতে মোটর লাগানো আছে। ওড়িশায় চিল্কা হ্রদে যেরকম দেখা যায়, অনেকটা সেইরকম। এক একটা খোলা নৌকোয় সাত-আট জনের বসার বন্দোবস্ত। তাতে করেই রওনা দিলাম প্যাম্পাসের গভীরে। আবার অরণ্যে; আদিম জগতের সন্ধানে।

ছবি: লেখক

বাইরে দূরে

লেখা পাঠানোর নিয়ম : এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে বেশ কিছু ছবি ও ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ পাঠাতে হবে। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content