রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


ক্রিস্টাল কণায় ঢাকা কাফেটেরিয়ার ছাদ ও দেওয়াল।

ইউরোপ মহাদেশের অস্ট্রিয়ার কথা এলেই মনে মনে ভাসতে থাকে শ্যামলিমায় ঘেরা অস্ট্রিয়ান আলপ্সের শিরশিরে শীতল বাতাসে খেলতে থাকা মোৎজার্ট-এর সুরতরঙ্গ। তবে এ-যাত্রায় আমার ভ্রমণ বর্ণনায় সুর-তরঙ্গ নয়, আমি ভাসবো স্ফটিক তরঙ্গে অর্থাৎ সোয়ার্ভস্কি-র পৃথিবীখ্যাত ক্রিস্টাল দুনিয়ায়। অস্ট্রিয়ার ইন্সব্রুকের ওয়াটেন-এ রয়েছে এই সোয়ার্ভস্কি (Swarovski) ক্রিস্টাল মিউজিয়াম – যার পোশাকী নাম হল — ‘সোয়ার্ভস্কি ক্রিস্টাল ওয়েল্টেন’।

উত্তর বোহেমিয়ায় (এখন চেক রিপাব্লিক) এক ছোটখাট কাচ-ব্যবসায়ীর ছেলে ড্যানিয়েল সোয়ার্ভস্কি ১৮৯৫ সালে আরম্যান্ড কোস্ম্যানের আর্থিক সাহায্যে গড়লেন এক আশ্চর্য দুনিয়া- জুয়েলারি জগতের নতুন এক উন্মোচন ক্রিস্টাল জুয়েলারি। গড়ে উঠল বিশ্বখ্যাত এক পারিবারিক উদ্যোগ।

অপূর্ব ক্রিস্টাল কীর্তির সঙ্গে লেখিকা।

স্রষ্টার ১০০ বছর পূর্তিকে স্মরণীয় করে রাখতে ১৯৯৫ সালে তৈরি হয় এই দর্শনীয় ক্রিস্টাল মিউজিয়াম। অবাক হতে হয়, যে এই আকর্ষণীয় মিঊজিয়ামের সার্বিক পরিকল্পনা শিল্প-নির্দেশনা, বিন্যাস ও আলোক-পরিকল্পনা যিনি করেছেন — সেই ফ্রাঞ্জ আন্দ্রেঁ হেলার কিন্তু কোন স্থপতি নন। তিনি এক অস্ট্রিয়ান শিল্পী — একাধারে কবি, লেখক গায়ক গীতিকার ও সাংস্কৃতিক সংগঠক। হেলার তাঁর সেই শিল্পসত্তা থেকেই ক্রিস্টাল-এর ব্যবহারে অপরিসীম উদ্ভাবনী ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন।

এই রূপকথার রূপরাজ্যের প্রবেশতোরণে রয়েছে নীল চোখের এক দৈত্য। তার মুখ থেকে বয়ে আসা অবিরল বারিধারা ঝর্ণার মত গিয়ে পড়ছে এক গোলাকার স্বচ্ছ জলাধারে। স্ফটিক খচিত নিস্পলক উজ্জ্বল চোখে আমাদের দেখতে থাকা সবুজ ঘাসের আবরণে ঢাকা সেই বিশালাকার দৈত্যের শরীরের মধ্যে ঢুকে কখন যেন চলে এলাম ঘন নীল রহস্যে মোড়া জাদুর জগতে।
এন্ট্রান্স হলেই চমক। সালভাদর দালি, কেইথ হ্যারিং বা নিকি দ্য সেন্ট ফ্যালের মত আন্তর্জাতিক মানের শিল্পীদের করা ক্রিস্টাল-কেন্দ্রিক অনবদ্য কাজের সূক্ষতা চোখ মন দুই কেড়ে নিল। এসবের মাঝে রাখা আছে সুবিশাল এক ক্রিস্টাল। সোয়ার্ভস্কি বুকলেটে এটিকে ৩,১০০০০ ক্যারাটের সর্ববৃহৎ ক্রিস্টাল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে রয়েছে এক ঝাড়বাতি — প্রতিবার তাকালেই যেন সে রঙ বদলায়।এরপর প্রায় ৪২ মিটার লম্বা স্ফটিক দেওয়াল টপকে পৌঁছলাম একের পর এক রহস্যভরা কক্ষে। সে যেন এক মায়াবী দুনিয়া। দেখলাম জিম হোয়াটিংসের ভিন্ন রূপের শিল্পকর্ম “মেকানিক্যাল থিয়েটার”। আলো আর প্রযুক্তির খেলায় মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততা এবং মেশিনের কাঠিন্য এই দুই বৈপরীত্যের অসাধারণ প্রকাশ ভঙ্গি।

এরপর “দ্য ওয়ান্ডার অফ ফ্যাসেট”। মনে হল যেন ক্রিস্টাল জোয়ারে ভেসে চলেছি। উপরে নিচে ডাইনে- বাঁয়ে সর্বত্র আলোর প্রতিফলন। আর বিবিধ রঙের অজস্র প্রতিবিম্বের ঝলকানিতে স্নাত গোটা কক্ষ। ঝলসে বেরিয়ে আসছে অন্তরালের শিল্পকর্ম। জানা গেল প্রায় ৫৯৫টি আয়না ব্যবহার হয়েছে এই আশ্চর্য দৃশ্যসৃষ্টির অন্তরালে।

ক্রিস্টাল সৃষ্ট লেভাইথ।

বিভ্রান্তি কাটতে না কাটতেই মুহূর্তে হারালাম পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ক্যালাইডোস্কোপ (Kaleidoscope)-এর বর্ণচ্ছটায়। এক অদ্ভুত শান্তির অনুভূতি। ঠিক কক্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে নিচে চোখ রাখতেই মনে হতে থাকলো পায়ের তলায় কিছু নেই!! যেন সম্পূর্ণ মহাশূণ্যের অন্ধকার। ওয়ান্ডার অফ কালারের কক্ষ পেরিয়ে পা রাখলাম কল্পনার মঞ্চে। যেখানে ‘সূয্যি মামা হাসে / চাঁদা মামার পাশে’। স্ফটিকের মধ্য দিয়ে গাছপালার রূপান্তর ঘটে প্রজাপতিতে আর স্ফটিকের নদী কুলকুল করে বয়ে চলে সেই ঘর দিয়ে। আহা কি অপূর্ব দ্য ওয়ান্ডার অফ ফ্যান্টাসি!

দেখলাম এরপর ক্রিস্টাল ক্যালিগ্রাফি। শব্দের হয়ত সীমাবদ্ধতা কখনও থাকতে পারে, কিন্তু আলোর কাব্যপ্রবাহ অসীম। আলোর গতি, ছন্দময় শক্তি শব্দের সীমাকে অতিক্রম করে সারা পৃথিবীকে কিভাবে একত্রিত করতে পারে তা গ্লাস আর্টিস্ট পল সেইড অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পরিবেশন করেছেন। পরের কক্ষ নিশ্চুপ শুনশান। আলো-আঁধারির হাত ধরে ভয়ে ভয়ে এগিয়ে চলেছি। চারিপাশ রহস্যে ঘেরা। প্রতি পদক্ষেপে কাচভাঙ্গার মৃদু আওয়াজ। না কি পুরোটাই মনের ভ্রম!! ঠিক যেমনটা হতো ছোট্টবেলায়। ছুটির দিনে খুড়ো দাদুর কোলে গুঁড়িসুড়ি মেরে বসে ভূতের গল্প শোনার সময়…সাঙ্গ হল ‘দ্য ওয়ান্ডার অফ ইল্যুশন’। এরপরের দুই কক্ষ নিয়ে ‘দ্য ওয়ান্ডার অফ ভেরিয়েশন। এটাই সোয়ার্ভস্কি ক্রিস্টাল ওয়ার্ল্ডের প্রদর্শনী কক্ষ। যেখানে সাজানো রয়েছে বৈচিত্র্যপূর্ণ আধুনিক শিল্পের নজরকাড়া নমুনা।
আরও পড়ুন:

নাট্যকথা: রোদ্দুর ও অমলকান্তি/৫

শারদীয়ার গল্প-৫: ধান চোর ইঁদুর

বিদেশ: রোমের ভ্যাটিকান কথা

আমার দুর্গা

জানলাম যে ২০১০ এর নভেম্বর মাসে এই চেম্বার্স অফ ওয়ান্ডার্স-এর গায়ে চেম্বার্স অফ ওয়ার্ল্ডস ওয়ান্ডার্স-এর তকমা লাগে। প্রবেশ তোরণে যে দৈত্য দেখেছি এখন সটান সেই দৈত্যরাজের কামরায়। মানে সেই স্কুলে-পড়া ঈশপের নীতিকথার ‘ফ্রেন্ডলি জায়েন্ট’। যে নাকি সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়িয়ে ফিরে আসে ভূ-গহ্বরস্থিত বিশাল সাম্রাজ্যে। তার সবসময়ের ভ্রমণসঙ্গী ওয়াকিং স্টিক বা বেড়ানোর লাঠি, আংটি, দস্তানা আর মিঠে সুরের একোর্ডিয়ান, যা এখানে সযত্নে রক্ষিত একটি বিশেষ কক্ষে ‘দা ওয়ান্ডার অফ সাইজ’-এ।

শিল্পের পরিপূর্ণতা যে কোনও রূপেই আসতে পারে। তবে মাধ্যম সংগীত হলে তা যেন অন্যরূপে ধরা দেয়। আমেরিকার কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী জেসি নরম্যান- এর ক্রিস্টাল ডোমের অনুষ্ঠান এখনো যেন মাঝেমধ্যে নাড়া দিয়ে যায়। তাঁর সেই কন্ঠ প্রতিভাকে তুলে ধরা হয়েছে মাদাগাস্কারের এক প্রাকৃতিক স্ফটিকের মধ্য দিয়ে। কোথাও যেন মনুষ্য সৃষ্ট সাঙ্গীতিক ক্ষমতা আর প্রকৃতি সৃষ্ট পাথরের শক্তি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তারই ঝলক ‘দ্যা ওয়ান্ডার অফ হারমোনি’ কক্ষে।

সোয়ার্ভস্কি ওয়র্ল্ডের গেট ও জয়েন্ট'স গার্ডেন।

এবার সুর থেকে ভাসলাম সাগরে। গ্রিকপুরানে উল্লেখিত জলদেবতা পোসাইডনের নীল জগতে। হালকা নীল আভায় যেন গভীর জলের অতলে গা ভাসিয়েছি। দা ওয়ান্ডার অফ দা ওয়েভস থেকে এরকমই এক অভিজ্ঞতা সঙ্গে নিয়ে বেরোলাম।

পরের কক্ষ ওয়ান্ডার অফ ইনফিনিটি-তে দাঁড়িয়ে ৫৫ লক্ষ টুকরো ক্রিস্টালের সাথে সংগীত ও আলোর বর্ণবৈচিত্র্যের অতুলনীয় সমাহার। ব্রিটিশ মিউজিশিয়ান কম্পোজার প্রডিউসার এবং শিল্পী ব্রায়ান ইনোর কাজে মোহিত হলাম। অগুণতি অসংখ্য স্ফটিক-কণার ঝলকিত রূপ মুহূর্তেই বদলে বদলে যাচ্ছে চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে। দ্বিতীয়বার যা অধরাই থেকে যাচ্ছে। এই ক্ষণস্থায়ী মুহূর্ত স্মৃতিতে রইলো চিরস্থায়ী হয়ে, এখানেই শিল্পীর মহত্ব।

বিশালাকার ক্রিস্টাল।

কক্ষ থেকে কক্ষান্তরে। এ কক্ষ শিল্পের মাপকাঠিতে বেশ খানিক অগোছালো। কেমন যেন এলোমেলো। সৃজনশীলতায় এক নতুন ধারা তা হল সাদৃশ্য সমতা ভেঙে অসমতাকে দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তোলা। এরকমই এক পাকদণ্ডী কক্ষের মধ্যে দিয়ে দীর্ঘ চলা। যেন স্বপ্নিল জগতে হেঁটে চলেছি। ৪৮টি ক্রিস্টাল খচিত পলিগনের মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে বিবিধ চিত্র। সমাজ ইতিহাস প্রকৃতি সংস্কৃতি বিজ্ঞান ধর্ম অর্থাৎ মানব সভ্যতার ভিন্ন ভিন্ন অধ্যায় প্রকাশ পেয়েছে ক্রিস্টালের নিখুঁত প্রয়োগনৈপুণ্যে গ্রাফিক্স এবং এনিমেশনের মাধ্যমে। সত্যিই অবাক করল ‘দ্য ওয়ান্ডার অফ দা ওয়ার্ল্ড’। এরপর চলে এলাম বিদায়ী কক্ষে।

প্রকৃতি এবং প্রযুক্তি এই দুই শক্তিকে সর্বদাই — দুই বিপরীত মেরুতে দেখতে চোখ অভ্যস্ত। কিন্তু দ্য ওয়ান্ডার্স অফ দ্য এলিমেন্টস কক্ষে দেখা গেল অন্য কিছু। ভিডিও আর্টের পুরোধা শিল্পী ফেব্রিঝিও প্লেসি তাঁর অসাধারণ কাজের মধ্য দিয়ে এই দুই শক্তিকেই একত্রিত করেছেন। তবে এসব দেখতে দেখতে চোখ বাঁধা পড়ল থমাস ফ্যুয়ার্স্টেইন-এর সৃষ্ট ১০ হাজারেরও বেশি টুকরো ক্রিস্টালের সমন্বয়ে অতিকায় এক সামুদ্রিক জেলিফিশের আদলে তৈরি ঝাড়বাতিতে। শিল্পী তাঁর সৃষ্টির নামকরণ করেছেন “লেভাইথ” (leviathan) — বাইবেল অনুসারে লেভাইথ এক অতিকায় সমুদ্রদানব। যেন স্বপ্ন থেকে স্বপ্নান্তরে। ঘন আলোর মাঝেই বিদায় নিলাম ক্রিস্টাল ফরেস্টের মধ্য দিয়ে।

স্ফটিক পিরামিড।

এরপর রয়েছে রাতের ঝিকিমিকি তারাময় আকাশ বা দিনের উজ্জ্বল আলোয় উচ্ছ্বসিত পৃথিবীর সবথেকে বড় সোয়ার্ভস্কি স্টোরস। যেখানে বিক্রি হচ্ছে নানা দামের নানা মাপের অনবদ্য ক্রিস্টাল জুয়েলারি। সাজানো ভিআইপি লাউঞ্জ টপকে ক্যাফেটেরিয়া। জল পাথর আর কাঠের অপূর্ব ব্যবহারে সেজে উঠেছে এই কাফেটেরিয়া। কফি কাপে ঠোঁট ছোঁয়াতে ছোঁয়াতেই চোখ ঘুরতে থাকল কাফেটেরিয়ার ছাদ আর দেওয়াল জোড়া ছোট ছোট ক্রিস্টালের টুকরোয় ভাসতে থাকা আলোক কণিকায়। আর যেখানেই জলধারা সেখানেই ক্রিস্টাল।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪: কবে আসবে তুমি মননের সে ‘সহযাত্রী’? [০৯/০৩/১৯৫১]

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৬: শারদীয় সংখ্যায় লিখে পাওয়া অর্থ বন্যাপীড়িত মানুষের কল্যাণে

অমরনাথের পথে, পর্ব-২: লিডারের তীরে তখন যাত্রীদের তাঁবুর মেলা…

ছোটদের যত্নে: বাচ্চা খেতেই চায় না? কী করে খিদে বাড়াবেন? কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন? জানুন শিশু বিশেষজ্ঞের মতামত

বেরিয়ে এলাম দৈত্যের সাজানো ঐশ্বর্যের সাম্রাজ্য ছেড়ে জায়েন্টস গার্ডেনে। ক্রিস্টাল ওয়ার্ল্ডের বাইরে এসেই আকাশ ছুঁয়ে থাকা চোখজুড়োনো নরম সবুজ প্রান্তর। ক্রিস্টাল ওয়ার্ল্ড ঘিরে সেই সাজানো বাগান। সেখানেই এসে খানিক চুপ করে বসে ভাবতে থাকলাম এতক্ষণ কী দেখলাম? কত কত বিনিদ্র রাত কেটেছে এই সৃষ্টির পিছনে… কত কত মানুষের ক্রমাগত পরিশ্রম পৃথিবীর বুকে গড়ে তুলেছে এই স্বর্গীয় উপহার।

চিত্র সৌজন্য: সত্রাগ্নি

Skip to content