রবিবার ৬ অক্টোবর, ২০২৪


পুরাকথা অনুসারে দেহরাদুন নাকি দ্রোণস্থলী ছিল! অর্থাৎ কৌরব আর পাণ্ডবদের অস্ত্রশিক্ষাগুরু বাস করতেন এই দেরাদুনেই। এসব শুনে চমৎকৃত হচ্ছিলাম। মহাভারত একটা ভীষণ ভালোলাগার গ্রন্থ। আর দ্রোণাচার্য সেই মহাভারতের অনেকটা জুড়ে। সেই দ্রোণ থাকতেন এই দেরাদুনেই! সদ্য দেরাদুন পেরিয়ে এসেছি। যাত্রা এখনও চলছেই। ভাবছিলাম ফেলে আসা দেরাদুনের কথা। পুরাণে উল্লিখিত হয়েছে, কেদারখণ্ডে অবস্থিত এই দেরাদুন। দেরাদুন অর্থাৎ দ্রোণস্থলী এ তো না হয় পুরাকথা বলে। এই দেরাদুন নামটা কী করে হল? ‘দেরা’ অর্থাৎ ‘দেহরা’ বা ‘ডেরা’। যার অর্থ ‘আবাস’। আর ‘দুন’ হল উপত্যকা।
সপ্তম শিখগুরু হর রাই-এর বড় ছেলে ধর্মদ্রোহী বাবা রাম রাই এই স্থানে এসে তাঁর ডেরা বাঁধেন। সেই থেকে এই দুন উপত্যকা দেরাদুন নামে পরিচিত। পুরোনো মানচিত্রে এখনও এই জায়গা গুরুদ্বার নামে উল্লিখিত রয়েছে। শিখগুরুর তৈরি করা গুরুদ্বার আর তাকে ঘিরে ছোট ছোট বেশ কিছু গ্রাম ছিল। আজ এগুলো সবই মূল দেরাদুনের অন্তর্ভুক্ত। এ তো গেল নামের বৃত্তান্ত। দেরাদুনের আশেপাশে দর্শনীয় স্থান কী কী রয়েছে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল টপকেশ্বর মহাদেবের কথা। অনেকটা সিঁড়িপথে নেমে একটা গুহা। পাশ দিয়ে তীব্রস্রোতা এক নদী বয়ে চলেছে। স্থানীয় মানুষদের জিজ্ঞেস করে জানা গেল, এটি আসান নদী। গুহার ভিতরে ঢুকতে হল মাথা নীচু করে। নীচে মার্বেলের মেঝে ওপর থেকে টপ টপ করে পড়া জলে ভিজে রয়েছে। জল পড়ছে শিবলিঙ্গের মাথাতেও। তখন সবে সূর্যোদয় হয়েছে। মন্দিরে আমার মতো বাইরের লোক কেউ নেই। স্থানীয়রাই পুজো দিতে এসেছেন। কেউ জোরে জোরে স্তবপাঠ করছেন। কেউ মন্দির পরিক্রমা করছেন।
আরও পড়ুন:

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৩৭: পুষ্কররাজাকে পরাস্ত করে রাজ্য ফিরে পেলেন নলরাজা

অমরনাথের পথে, পর্ব-৪: বরফমোড়া পথে অতি সাবধানে ধীরে এগিয়ে চলি মহাগুনাস পাসের দিকে

একজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, এই জল কিসের! তিনি বললেন, শিবজির মহিমা। কেউ জানে না, কোথা থেকে এই জল আসে। এদিকে টপটপ করে জল পড়েই চলেছে। আর গুহাময় জলে জলাকার। শিবজির মহিমা না হয়, বুঝলাম। কিন্তু এই জলের উৎস কী এটা আমায় জানতেই হবে। আরও একজনকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি তখন বললেন, এটা নিশ্চয়ই জানো, দেরাদুন মানে দ্রোণনগরী বা দ্রোণের আবাস ছিল। দরিদ্র দ্রোণের পুত্রের জন্য দুধের সংস্থান করা সম্ভব ছিল না। তিনি তখন শিবের উপাসনা করেন। শিবের কৃপায় ছেলের দুধের জোগাড় হয়। সাধারণ মানুষের কথায় সেই দুধ নাকি এই পাহাড়ের গা বেয়ে পড়েছিল।
এমন কত গল্পকথা ছড়িয়ে রয়েছে লোকের মুখে। কষ্টকল্পনা সব। তবুও এই পরিবেশে শুনতে মন্দ লাগে না। দ্রোণ নাকি গুহার মধ্যে এই শিবলিঙ্গের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। টপ টপ করে জল পড়ে শিবলিঙ্গের মাথায়। তাই নাম টপকেশ্বর মহাদেব। গুহা থেকে বেরিয়ে এলাম। বাইরে বয়ে চলেছে আসান নদী। ভোরের আলো পড়ে তীব্র বেগে বয়ে যাওয়া জলধারায় পড়ে চকচক করছে। যমুনানদীর উপনদী হল টন। সেই টননদীর শাখানদী আসাননদী। বেদের অশ্মন্বতী নদীই নাকি এই আসান নদী। আসাননদীর একটি ধারা পাহাড়ের মধ্যে বয়ে চলে। তারই টপ টপ করে গুহার মধ্যে পড়ে অবিরাম। প্রকৃতির কি বিচিত্রতা!
আরও পড়ুন:

শারদীয়ার গল্প-১: প্ল্যানচেট রহস্য

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪: কবে আসবে তুমি মননের সে ‘সহযাত্রী’? [০৯/০৩/১৯৫১]

গুহামন্দির থেকে বেরিয়ে এলাম। বাইরে দু’ চার জন বসে ভিক্ষা করছেন। কোন একটি ব্লগে পড়েছিলাম, এখানকার ভিখারীরা অনেকেই সম্পন্ন ঘরের। কারও স্বামী গত হওয়ার পর শ্বশুরবাড়ির লোক তাড়িয়ে দিয়েছে। কারও বা মানসিক অসুস্থতার জন্য বাবা-মায়ের আশ্রয়ও জোটেনি। কারও বা তিনকূলে কেউ নেই। ভিক্ষাবৃত্তি এদের আশ্রয়। ভোরের হিমেল হাওয়ায় আমাদের অটো এগিয়ে পরের গন্তব্যে। স্মার্টসিটি জেগে উঠছে ধীরে।

ছবি: লেখক

Skip to content