রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


রেড ক্রেস্টেড পোচার্ড (রাঙামুড়ি)।

চুপি চুপি ঘুরতে যাব। একটাও কথা বলবি না কিন্তু। বারে বারে সাবধান করলাম টিনটিনকে। ভারি অবাক হয়ে টিনটিন আমাকে প্রশ্ন করেছিল—বেড়াতে যাব অথচ হইহুল্লোড় করব না! চুপি চুপি যেতে হবে! সে আবার কেমন জায়গা! হ্যাঁ, চুপি চুপিই যেতে হয়, নৈঃশব্দ্যের শব্দ শুনতে শুনতে ভেসে বেড়াতে হয় পান্নাসবুজ জলে। চুপির চর। প্রকৃতির সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে বর্ধমানের পূর্বস্থলীর ছাড়িগঙ্গার এই অংশ আদর্শ। অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নানা পরিযায়ী পাখির দেখা মেলে চুপির বিশাল অশ্বখুরাকৃতি জলাশয়ে।

গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসেই আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম। মায়াপুর, নবদ্বীপ ঘুরে পৌঁছে গিয়েছিলাম চুপি চরে। মায়াপুরে দুদিন কাটিয়ে পরের দিন নবদ্বীপ সমুদ্রগড় হয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম চুপি। সমুদ্রগড়ের পরেই বর্ধমানের পূর্বস্থলীর চুপি গ্রাম। নবদ্বীপের বেশকিছু মন্দির ও দর্শনীয় স্থান দেখে চুপি পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা দেড়টা বেজে গেল। এখানে তেমন কোনও ঝাঁ-চকচকে হোটেল-রেস্টুরেন্ট নেই। কিন্তু ছোটখাট যেসব হোটেলগুলো আছে সেখানে খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত চমৎকার। একদম ফ্রেশ রান্না। সাদা ভাত, ডাল, ঝুরো আলুভাজা, চিকেনকারি সহযোগে আমরা লাঞ্চ শেষ করলাম। ঘড়িতে তখন তিনটে।
চুপির চর থেকে নৌকা নিয়ে জলে নেমে পড়লাম। একটা নৌকায় চারজনের বেশি যাত্রী পরিবহন করা হয় না। শব্দ এবং দূষণ রুখতে এখানে দাঁড় টানা নৌকা ব্যবহার করা হয়। একটা নৌকায় চারজনের বেশি যাত্রী পরিবহন করা হয় না। এখানে পাখি দেখার সবচেয়ে ভালো সময় ভোর ও বিকেল। দাঁড় ছপছপ তরিতে ভেসে চলেছি নিঃশব্দে। সত্যি কথা বলতে, এখানকার সীমাহীন সৌন্দর্যে আপনি যখন অবগাহন করবেন, তখন বাকরুদ্ধ হবেনই। শব্দের ব্যবহারের অসাড়তা এমন এক সুখের আবেশে আপনাকে জড়িয়ে রাখবে যে, তন্ময় হয়ে যাবেন। গঙ্গার ছেড়ে যাওয়া এই অংশে কচুরিপানা আর নলখাগড়ার পাশাপাশি রয়েছে প্রচুর মাছ। জনসমাগমহীন এই চরের খোঁজ পেয়েছে হিমালয়, মঙ্গোলিয়া, এমনকী ইউরোপের নানা প্রজাতির পাখি। মাঝিভাইয়ের কাছে জানতে পারলাম— এই জায়গার স্থানীয় নাম ছাড়িগঙ্গা। হ্রদের গভীরতা খুব বেশি না হলেও এই অগভীর জলাশয়ে বিচিত্র জলজ উদ্ভিদ, শ্যাওলা, কাঁকড়া, সাপ ও নানারকম পোকামাকড়ের সমাবেশ—যা পাখিদের খুবই প্রিয় খাদ্য। আমরা চুপচাপ শুধু ভেসে চলেছি। কত নাম-না-জানা পাখি আমাদের চারদিকে।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬: গার্হস্থ্য জীবনের প্রারম্ভে ভৈরবী ব্রাহ্মণীর আগমন

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৯: তা বলে কি প্রেম দেব না!

এই সময় যদি সঙ্গে একজন পক্ষীবিশেষজ্ঞ থাকত, তাহলে আরও ভালো হত—এমনটা ভাবতে ভাবতে আর পাখি দেখতে দেখতে কখন যে এক অজানা জগতে হারিয়ে গেছি নিজেই জানি না। মাঝিভাইয়ের কথায় ভাবনায় ছেদ পড়ল। ওই দেখুন, ওই দেখুন, ডানদিকে… বাঁশের মাথায় বসে আছে অসপ্রে। আসলে এরা হচ্ছে (পশ্চিম) অস্ট্রেলিয়ার বাজ। সত্যিই, চুপির চরের সব মাঝিরাই পক্ষীবিশারদ! কত যে পাখির নাম জানে ওরা! ওদের সঙ্গে কথা বললে জানা যায়—কোন পাখির কী নাম, কোন দেশ থেকে তারা এসেছে ইত্যাদি আরও কত কিছু । দাঁড়টানার ছপাৎ ছপাৎ শব্দের সঙ্গে পাখির কূজন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে চুপির চরে।

কমন কিংফিশার ও পাইড কিংফিশারের লড়াই।

চুপকথার স্বর্গরাজ্যে মানুষ ও প্রকৃতির এমন নিঃশব্দ ভাবের আদান-প্রদান সত্যিই বিরল। আমাদের নৌকা থেকে বেশ কিছুটা দূরেই উড়ে যাচ্ছে কত পাখি। আবার জলজ উদ্ভিদের ঝোপঝাড়েও বসে আছে অনেক পাখি। ওদেরকে একটু কাছ থেকে দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। অনুরোধ করলাম মাঝিকে। আমাদের অনুরোধে তিনি খুব সন্তর্পণে নৌকা নিয়ে গেলেন পাখিদের বেশ কাছাকাছি। সেইসঙ্গে আমাদের বললেন—আপনারা কিন্তু কোনও কথা বলবেন না। কথা বলব কি! ভাষাই তো হারিয়ে ফেলেছি। এই পাখিদের ভিড়ে কথা হারিয়ে যাবে আপনাদেরও। খুঁজে পাবেন না কোনও শব্দ, সত্যিই, কিছু সৌন্দর্য এতই তুলনাহীন হয়—যা অব্যক্ত, অবর্ণনীয়। প্রকৃতি যে কত সুন্দর করে সাজিয়েছে তার প্রতিটি উপাদানকে, এই পাখিদের রাজ্যে তা উপলব্ধি করা যায়। জলের গন্ধে, জলজ উদ্ভিদ ও কচুরিপানার ভিড়ে, দেশি-বিদেশি নানা পাখিদের নীড়ে আমরা যেন সত্যিই চলে যাই এক রূপকথার দেশে।

একের পর এক পাখিদের ক্যামেরাবন্দি করছি, এমন সময় দেখি আমাদের নৌকার কিছুটা তফাতেই ভেসে চলেছে বার্ন সোয়ালো, যাকে বাংলায় বলা হয় আবাবিল। এই হ্রদের মাঝে মাঝে কিছু জায়গায় ঘাস ও কাদার ছোট ছোট দ্বীপের মতো রয়েছে। সেখানে রয়েছে বেশকিছু গ্রেহেডেড সোয়ামপেন, গ্রে হিরণ, পারপেল হিরণ, ফেজান্ট টেইলড জাকানা বা জলময়ূর। স্থলের ময়ূর তো আমরা অনেক দেখেছি, দেখেছি তার বিস্তারিত পেখমের সৌন্দর্য! কিন্তু জলে ভেসে বেড়ানো ময়ূরের সৌন্দর্যও যে কিছু কম নয়, তা এই চুপির চরে না এলে অদেখাই থেকে যেত।
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-২: কাজের আশায়, তারকা অশোককুমারের গাড়িতে নয়, লোকাল ট্রেনে-বাসে ঘুরে বেড়াতেন কিশোর

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯: সুন্দরবনের লুপ্ত নদী আদিগঙ্গা

কখন যে সময় একটা ঘণ্টা অতিক্রান্ত হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। এখন চারটে বাজে। আমরা জলাশয়ের বেশ প্রশস্ত একটা জায়গায় এসে পৌঁছালাম। এখানে ঝাঁকে ঝাঁকে সাঁতার কাটছে রেড ক্রেস্টেড পোচার্ড বা রাঙ্গামুড়ি দল। এরাই চুপির মূল আকর্ষণ। কচুরিপানার ওপর নিশ্চিন্তে বসে আছে নর্দার্ন শলভার। মাছ ধরার জাল ফেলার জন্য পোঁতা বাঁশের মাথায় বসেছিল বার্ন সোয়ালোটা, ওকে ক্যামেরাবন্দি করার ঘনঘটা দেখে উড়ে গেল! ইতস্তত উড়ে বেড়াচ্ছে লেজার হুইসলিং ডাকের দল। মোহনার চরে চখা-চখির মেলা। এদের বিদেশি নাম রুডিশ্যাল ডাক।

অস্ট্রেলিয়ান বাজ।

চুপির চরে নৌকা বিহারের সময় সঠিক গাইড অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। না হলে পথ-হারানোর সমস্যা ও জলের নীচে বিস্তৃত উদ্ভিদ ও শ্যাওলার জালে নৌকা আটকে পড়ার বিপদও আছে। যদিও এখানকার মাঝিরা প্রত্যেকেই দক্ষ গাইড। কমন কূট, পিগমি গুজ, গাডওয়াল, লেজার হুইসলিং ডাক—একের পর এক পরিযায়ী পাখিদের ক্যামেরাবন্দি করতে লাগলাম। দেখতে দেখতে পাঁচটা বেজে গেছে। অস্তাচলগামী সূর্যের রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ছে হ্রদের জলে। হঠাৎ হঠাৎ করে জল থেকে ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে কত পাখি। দেখে মনে হচ্ছে, প্রকৃতি যেন রং তুলি হাতে ছবি আঁকছে আকাশের ক্যানভাসে। কমন স্নাইপ, কমন রিংড প্লোভারের মতো ছোট ছোট পাখিও আছে।

শেষ বিকেলের পড়ন্ত আলোয় হোয়াইট ওয়াগটেল, গ্রেট ইগ্রেট, কাস্তে বকের (ব্ল্যাকহেড আইবিস) সারিতে চুপির চর মোহময়ী। অস্ট্রেলিয়ান বাজের ক্ষিপ্রগতিতে জল থেকে জ্যান্ত মাছ তুলে এনে তারিয়ে তারিয়ে খাওয়া, কমন কিংফিশার আর পাইড কিংফিশারের চোখ পাকিয়ে ঝগড়া আমাদের শহুরে চোখকে শুধু মুগ্ধতাই দেয় না, দেয় প্রশান্তি। এই জলাভূমির দু’দিকে বিস্মৃত চাষের জমিতে বলদ-লাঙল নিয়ে ব্যস্ত চাষি, আর তাদের সঙ্গে সঙ্গে খাবারের খোঁজে ঘুরতে থাকা শামুকখোল, লেপুইং ও ইগ্রেটের দল। জীবজগতের সর্বশ্রেষ্ঠ চেতন সত্তার সঙ্গে প্রকৃতির অবলা চেতনসত্তার এমন নিবিড়, নির্ভীক সম্পর্ক আপনাকে মুগ্ধ করবেই। চুপ কথার রাজ্যের নিস্তব্ধ মুহূর্তের চলমান সময় মনে করিয়ে দেয়—ফেরার কথা। মন ভরলেও প্রাণ ভরে না। সময় বলে—সময় যে নেই। তাই এই স্বর্গরাজ্যে ভাসতে-ভাসতে আবার ফিরে এলাম ঘাটে। একরাশ মুগ্ধতা, না-বলা কথার দেশের অধরা মাধুরীকে ক্যামেরায় আর মণিকোঠায় বন্দি করে ফিরে এলাম মায়াপুর। চুপিতে এলে যেমন কথা হারিয়ে যায়, তেমনি এর সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গিয়েও শব্দ হারিয়ে যায়! অবর্ণিত থেকে গেল আরও কত পাখির কথা। অদেখা রয়ে গেল আরও কত পরিযায়ী। এ জানার, এ চেনার শেষ নেই।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩২: আটার চেয়ে ময়দা ঢের গুণ ভালো?

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-২: ভারতের স্থাপত্যশৈলীতে ভিতরকুঠি টেরাকোটা শিব মন্দিরের অবদান অপরিসীম

 

কীভাবে যাবেন

প্রাইভেটকারে কলকাতা থেকে কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে ধরে সরস্বতী ব্রিজ পার হয়ে প্রথমে কালনা তারপর সমুদ্রগড় পার করলেই পৌঁছে যাবেন পূর্বস্থলী স্টেশন। এখান থেকে কাষ্ঠশালী বাজার হয়ে চুপির চরে পৌঁছতে হবে। যদি ট্রেনে আসতে চান, তাহলে হাওড়া অথবা শিয়ালদা থেকে কাটোয়াগামী ট্রেন ধরে পূর্বস্থলী পৌঁছতে হবে। পূর্বস্থলী স্টেশনের কাছেই পেয়ে যাবেন চুপির চর যাওয়ার জন্য টোটো।
 

কোথায় থাকবেন

চুপিতে পঞ্চায়েত সমিতির পরিযায়ী আবাস রয়েছে। তাছাড়া মায়াপুর/ নবদ্বীপেও থাকতে পারেন। সেখান থেকেও আসতে পারেন চুপির চরে।

ছবি সৌজন্যে: লেখক

* বাইরে-দূরে: চুপির চর (Travel – Chupir Char) : সোমা চক্রবর্তী (Soma Chakrabarti), শিক্ষিকা, নিমতা জীবনতোষ ঘোষ মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল (উচ্চ মাধ্যমিক)।

আপনার রায়

ইসরোর চন্দ্রযান-৩ কি তৃতীয় বারের এই অভিযানে সাফল্যের স্বাদ পাবে?

Skip to content