রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন প্লেটভিল। আমার অফিসের ঠিক বাইরে।

পরের সপ্তাহ প্রায় শেষের দিকে আসতে না আসতেই দেখলাম আমার বাড়ির কাছের গাছগুলিতেও রং ধরা শুরু হয়েছে। দক্ষিণ উইসকনসিনে এসে পৌঁছেছে ফল কালার। এই সময়টায় প্রতিদিনই পড়ানো শেষ হলে আমি বেরিয়ে পড়ি হাঁটতে বা গাড়ি নিয়ে চলে যাই কাছেপিঠেই কোথাও। কাছাকাছি সব জায়গাতেই তখন রঙের মেলা। কখনও চলে যাই ম্যাডিসনের দিকে, আবার কখনও চলে যাই ডিবিউকের দিকে, আবার কখনও বা লেক গ্যালেনার দিকে। এখানে একটা মজার ব্যাপার আছে। ওপরে যে তিনটি শহরের নাম বললাম তারা প্রত্যেকেই কিন্তু আলাদা আলাদা রাজ্যে। ম্যাডিসন উইসকনসিনে, ডিবিউক আইওয়া রাজ্যে, আর গ্যালেনা ইলিনয় রাজ্যে। আর প্লেটভিল হলে এদের প্রত্যেকেরই প্রায় সীমানায়। প্লেটভিল আর ডিবিউকের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে মিসিসিপি নদী।
আমাদের যেমন গঙ্গা নদী হাওড়া কলকাতাকে আলাদা করেছে এখানে তেমনি এই মিসিসিপি। আলাদা করেছে উইসকনসিন আর আইওয়া রাজ্য দুটিকে। মিসিসিপির ওপরে নদী পারাপারের জন্য একটি বড় সেতু। তার একদিকে উইসকনসিন আর একদিকে আইওয়া। আর ওই সেতুর মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে যদি লম্বালম্বি নদী বরাবর, বা বলা ভালো উইসকনসিন যেই পাড়ে সেদিকে একটু তেরচা করে তাকানো যায় তাহলে দেখা যাবে ইলিনয়। এই তিন রাজ্যের সহাবস্থানের জন্য এই অঞ্চলকে বলা হয় ‘ট্রাইস্টেট’ অঞ্চল বা তিন রাজ্যের সংযোগস্থল। আর স্থানীয় অনেক লোকে মজা করে এই সেতুকে বলে ‘কোয়াড্রোস্টেট’ বা চার রাজ্যের সংযোগস্থল। আর চতুর্থ স্টেটটির কথা জিজ্ঞাসা করলে তারা বলে ‘স্টেট অফ কনফিউশন’। অর্থাৎ মিসিসিপির ওপরে ওপরে সেতুর মাঝখানে দাঁড়ালে বোঝা দায় যে কোন রাজ্যে দাঁড়িয়ে আছি।
আরও পড়ুন:

বিদ্যাসাগর ও বঙ্কিমচন্দ্রের পরে বাংলাভাষার স্বচ্ছন্দ, স্বাভাবিক প্রয়োগ ও বিস্তারে তাঁর অবদান ভোলার নয়/১

বাইরে দূরে: ফল কালারের রূপ-মাধুরী, পর্ব-৭: রঙের খেলা আর উইসকনসিনের আঁকাবাঁকা ফাঁকা রাস্তা—জীবনীশক্তিকে আরও উসকে দেয়

বাইরে দূরে: দেখব এবার জগৎটাকে, পর্ব-৯: আমাজন যেন স্বর্গের নন্দনকানন, একঝলক দেখে বোঝাই সম্ভব নয় এর ভয়াবহতা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪২: নিজেকে যিনি আড়ালে রেখেছিলেন

সে যে রাজ্যেই দাঁড়িয়ে থাকি দক্ষিণে যখন ফল কালার আসে তখন সে অত রাজ্য বিচার করে আসে না। সে চারদিকে ছেয়ে যায়। আর আমি সেইসময় গাড়ি নিয়ে চলে আসি এই সেতুর ঠিক নীচে চরটায় সেখানে নদীর পারে দাঁড়ালেই দেখা যায় খাড়া পার দুটি ধরে শুধু লালহলুদের বাহার। নদী বরাবর উইসকনসিন, আইওয়া, ইলিনয়-এর সীমা অতিক্রম করে যতদূর চোখ যায় শুধুই সেই রং। ঠিক যেন প্রকৃতির ক্যানভাসে আঁকা জলরং। নদীর জলে তুলি ডুবিয়ে বিধাতা যেন এঁকে চলেছেন নিরন্তর। কখনও সূর্যের দৃপ্ত আলোকে তাকে করে তুলছেন উজ্জ্বল, কখনও বা তার সঙ্গে যোগ করে দিচ্ছেন সূর্যাস্তের মেঘের রং, আবার কখনও বা সে রং পছন্দ না হলে বৃষ্টির জলে ধুয়েমুছে সাফ করে দেবেন সবটুকু রং। আমি এখানে বিকেল হলে মাঝে মাঝেই চলে আসি। হাঁটাচলার বড় একটা জায়গা নেই। গাড়ি নিয়ে নীচে নামার একটা রাস্তা আছে। সেখানে নেমে দু’ তিনটে গাড়ি রাখার জায়গা। আর অল্প কিছুটা জায়গা বেশ পরিষ্কার। একটু-আধটু ঘুরে বেড়ানোর জন্য। বাকিটা নদীর পাড়ে জল আর আগাছায় ভর্তি। সেখানে হাঁটা যায় না। তাই আমি এখানে এসে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি। এক ঘণ্টা, দু’ ঘণ্টা, তিন ঘণ্টা…। আবার যখন সূর্য ডুবে যায় বাড়ি ফিরে চলে যাই।

উইসকনসিনের রাস্তায় কোনও এক জায়গায়।

কখনও আবার ইচ্ছা হলে বেরিয়ে পড়ি স্প্রিংগ্রিনের দিকে। আমার বাড়ির কাছে ডজভিল বলে একটি জায়গা আছে। সেখান আবার স্প্রিংগ্রিন যাওয়ার মধ্যে ছাব্বিশ মাইল রাস্তাটি উইসকনসিনের অন্যতম সুন্দর রাস্তা বলে পরিগণিত হয় এই ফল কালারের সময়। সেই রাস্তা ধরে উইসকনসিন-রিভার পেরিয়ে সোজা চলে যাই স্প্রিংগ্রিন শহরে। প্রথম যেবার সেখান দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলাম সেবার বেশ মজা হয়ে ছিল। ডজভিল থেকে রাস্তার প্রথমার্ধে ফল কালার সেরকম নেই বললেই চলে। আমার তো সেখান দিয়ে গাড়ি চালাতেই বিরক্ত লাগছিল প্রথমে। ভাবছিলাম যে কেন এই রাস্তার এত নাম ফল কালারের জন্য। এর থেকে ওই মিসিসিপির ধরে গিয়ে বসে থাকলে ভালো হতো।
আরও পড়ুন:

সাজকাহন: স্টাইলিশ শাড়ি পরার হরেক কায়দা আছে, কিন্তু এ ভাবে শাড়ি পরা যায়, জানতেন?

দিনদিন আপনার ত্বক যে আর্দ্রতা হারাচ্ছে বুঝবেন কীভাবে? রইল ৫টি সহজ উপায়

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-১৪: আশা-নিরাশা ও ভরসার সে এক অন্য ‘মনের ময়ূর’

দশভুজা: ‘ওগো তুমি যে আমার…’— আজও তাঁর জায়গা কেউ নিতে পারেনি/২

ভুল ভাঙল প্রায় দশ মাইল পরে রাস্তা যখন এসে পৌঁছল একটি ছোট্ট টিলার মাথায়। সেখান থেকে দৃশ্য অদ্ভুত। টিলার সামনে কিছুটা সমতল আবার ওপাশ থেকে শুরু হয়েছে আরও একটি উঁচু টিলা। এবং সমতল থেকে যেন ধাপে ধাপে উঠে গিয়েছে ফল কালার। আরও কিছুটা এগোতে দেখি চারদিকে বেশ কিছু উঁচু নিচু টিলা আছে। এবং পুরো অঞ্চলটাই একটা অদ্ভুত ঢেউ খেলানো ভঙ্গিমায় ফল কালারের রঙে ঢাকা। এবং একটু জোরে গাড়ি চালালে ওই ঢেউগুলোই যখন দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে একটার পর একটা সে অভিজ্ঞতা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। প্রায় দশ থেকে পনেরো মাইল এক খেলা চলে শেষ হয়ে যায় স্প্রিংগ্রিন শহরে ঢুকে।
প্রথমবার গাড়ি চালিয়ে বেশ মজা লাগল। কাজেই শহরের শুরুতেই একটা তেল ভরানোর জায়গা থেকে আবার ঘুরে চলে গেলাম রাস্তার উলটোদিকে অনেকটা, অর্থাৎ যেদিক থেকে এসেছি সেদিকেই, মানে ডজভিলের দিকে। আবার রাস্তার ধারে একজায়গায় বাঁক নিয়ে আবার চললাম স্প্রিংগ্রিনের দিকে। বেশ মজা হয়েছিল সেদিন। তার পর থেকে বহুবার গিয়েছি এই রাস্তা ধরে এই সময়ে। কোনও বছরই বাড়ির কাছে এই রাস্তা ধরে গাড়ি চালানোর মজা হাতছাড়া করি না।

* ফল কালারের রূপ-মাধুরী (Wisconsin Fall Color : ড. অর্ঘ্যকুসুম দাস (Arghya Kusum Das) অধ্যাপক ও গবেষক, কম্পিউটার সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস।

 

বাইরে দূরে

লেখা পাঠানোর নিয়ম: এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। লেখার সঙ্গে বেশ কিছু ছবি পাঠাতে হবে। চাইলে ভিডিও ক্লিপও পাঠাতে পারেন। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content