বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


বরফ জমা লেক জেনেভার আকাশে সূর্যাস্তের রঙের খেলা।

লেক সুপিরিয়রে ওই হুড়োহুড়ি করতে করতেই দেখলাম যে লোকে ওই জমে থাকা হ্রদের ওপর দিয়েই গাড়ি নিয়ে চলে যাচ্ছে বহুদূর। ওই গাছের ডাল লাগানো রাস্তা ধারে সম্ভবত এপোস্টল আইল্যান্ড পর্যন্ত। কেউ কেউ আবার ওই জমে থাকা হ্রদেরই আরও কিছুটা ভেতরের দিকে বসেছে চড়ুইভাতি করতে। রান্না করে আনা খাবারের সঙ্গে চলে আইস ফিসিং। বরফের মধ্যে বৈদ্যুতিন করাত এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি দিয়ে গর্ত খুঁড়ে তাতে ছিপ ফেলে বসে থাকতে হয়। বরফের নীচে মাছ এসে চারা খেলেই তুলে নিতে হবে। তবে ওই সরু গর্তের মধ্যে দিয়ে মাছকে তুলতে গেলে অনেক রকমের কায়দাকানুন জানতে হয়। সেসব আমরা কেউই জানি না।

আমার শুধু মনে পড়ে গেল অনেক ছোটবেলায় দেখা ‘পিঙ্গু’ নামের কার্টুনটার কথা। সেখানে একটি পেঙ্গুইন পরিবার মাঝে মাঝেই যেত ওইরকম বরফ কেটে মাছ ধরতে। আর একটা সিলমাছ এসে তাদের জ্বালাতন করত। এই অঞ্চলে সিলমাছ আছে কি না জানা নেই। তবে ওই রকম মাপের একটি মাছও যদি ফাতনায় ধরা দেয় তাহলে কী হবে সেই ভেবে আমার বেশ চিন্তা হল। না তো তাকে ওই সরু গর্তের মধ্যে দিয়ে তোলা যাবে, না তো তার মুখ আটকে যাওয়া ফাতনা ছাড়ানো যাবে। পরে জেনেছিলাম যে ওর ছিপটাও অন্য রকমের হয়। মুখটা নাকি অনেকটা ফাঁদ পাতার মতো। অর্থাৎ বড় মাছ এসে চারা খেতে গিয়ে ফাঁদে আটকে যাবে। পরে তাকে তোলা হবে আশপাশের বরফ আরও গলিয়ে গর্তটাকে বড় করে। সে যা-ই হোক, মাছ ধরা নিয়ে আমার বড় একটা উৎসাহ নেই বলে জিনিসটা সম্পর্কে আর বেশিদূর জানা হয়নি।
এরকমই আরেকবার ঠিক করলাম লেক জেনেভা যাব। শীতকালের রবিবারের সকাল, কোনও কাজ নেই। ঘুম ভাঙতেই হঠাৎ মনে হল কোথাও ঘুরে আসি কাছাকাছি। ইন্টারনেটের দৌলতে জানলাম যে লেক জেনেভাতে হচ্ছে তুষারভাস্কর্যের মেলা। বরফের মূর্তি বানানোর প্রতিযোগিতা। আর সেই দেখতে লোকসমাগম। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বরফশিল্পীরা আসে এখানে। হ্রদের ধারে বিরাট অঞ্চল জুড়ে তারা মূর্তি বানায় শুক্রবার সারা দিন রাত। শনিবার দিন হয় প্রতিযোগিতা। আর সেই ঘিরে সপ্তাহান্তে উৎসবে মেতে ওঠে হ্রদের ধারে গোটা শহরটাই। প্রতি বছরই এরকম হয়।

বরফ জমা লেক জেনেভা।

আমি রবিবার যখন পৌঁছলাম সেদিন সকাল থেকে গরমটা একটু বেড়ে গিয়েছিল। আর বাড়ি থেকে রাস্তাও প্রায় ১৩০ মাইল মতো। মানে গাড়িতে করে প্রায় আড়াই ঘণ্টা থেকে তিন ঘণ্টার ব্যাপার। কাজেই আমি পৌঁছে দেখি অনেক মূর্তিই গলতে শুরু করেছে। তাতেও বেশ লাগছিল। কেউ বরফ দিয়ে বানিয়েছে মানুষের মুখ, কেউ বা কোনও পৌরাণিক চরিত্র, আবার কেউ বা তুলে ধরেছে সমসাময়িক সামাজিক সমস্যার কথা। আবার ছোটখাট জন্তুজানোয়ার, পশুপাখির প্রতিকৃতিও আছে। আমি সবটা বেশ হেঁটে হেঁটে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম।

লেক জেনেভার ধারে তুষারভাস্কর্যের মেলা।

তবে সবচেয়ে যেটা ভালো লেগেছিল সেটা হল হ্রদের ওপরে সূর্যের আলোর খেলা। আর আধো গলা আধো জমে থাকা হ্রদে তার প্রতিফলন। আমি প্রায় সূর্যাস্ত কাটিয়েই ঘরে ফেরার পরিকল্পনা করেছিলাম। তাই দিনের বিভিন্ন সময়ে ওই হ্রদের ধারে ধারে প্রকৃতির রংবদলের খেলা চাক্ষুষ করা গেল। ওই হ্রদেরই ধারে ধারে কখনও এই রেস্তোরাঁ কখনও ওই রেস্তোরাঁয় ঘুরে ঘুরে খাবার চাখতে চাখতে, বরফের ভাস্কর্যের মাঝে আর প্রকৃতির রঙের খেলায় দিন যে কীভাবে কেটে যায় তার কোনও খেয়ালই থাকে না। অন্য কোথাও হলে ফিরে আসার সময় হয়তো একটু মন কেমন করত। কিন্তু উইসকনসিন অঞ্চলে থাকার সবচেয়ে বড় পাওনা হল সবজায়গাগুলোই, মায় আমার বাড়ির জায়গাটিও এত সুন্দর যে মনখারাপের কোনও অবকাশ নেই।

প্রকৃতি এখানে দুহাত ভরে দিয়ে গেছে তার সবটুকু, আর আমিও দুচোখ ভরে তাকে শুধু দেখেই চলেছি। তার অকৃপণ দানের প্রতিদান দেওয়ার কোনও ক্ষমতাই আমার নেই। শুধু জানতে পারি তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতাবোধ। এর কারণ অবশ্য শুধু তার এই বরফ ঘেরা রূপ নয়, তার প্রাণবন্ত ফল কালারের অবদানও অনস্বীকার্য। সেই লেখা নিয়ে আসছি পরবর্তী পর্যায়ে। কারণ তুষারপাত যদি হয় মৃত্যুর শান্তি, ফল কালার হল সেই জীবনেরই উল্লাস। একে অন্যকে ছাড়া কখনওই পরিপূর্ণতা লাভ করে না। অন্তত এই অঞ্চলে তো নয়ই।

*ড. অর্ঘ্যকুসুম দাস (Arghya Kusum Das) অধ্যাপক ও গবেষক, কম্পিউটার সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস
 

বাইরে দূরে

লেখা পাঠানোর নিয়ম: এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। লেখার সঙ্গে বেশ কিছু ছবি পাঠাতে হবে। চাইলে ভিডিও ক্লিপও পাঠাতে পারেন। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content