
ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন-প্লেটভিলের শেষ প্রান্তে প্লেট নদীর ধারে একদিন।
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু।’
উইসকনসিনে (যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপশ্চিমের একটি রাজ্য) আমার বাড়ির দেওয়াল জোড়া জানলা দিয়ে নীচের বরফ ঢাকা রাস্তাগুলো যখনই চোখে পড়ে, আমি বারবার এই কবিতাটার কথাই ভাবি। সেই একই সাদা সাদা বরফে আদিগন্ত ঢেকে যায় এখানে। রোজই দেখি। তবুও কেন জানি না আমার সব সময়ই বেশ নতুন রকম লাগে। শীতকাল পড়তে না পড়তেই এখানে শুরু হয়ে যায় তুষারপাত। কখনও আকাশ থেকে থোকা থোকা চন্দ্রমল্লিকার মতো ঝরে পড়ছে, কখনও গায়ে লাগার সঙ্গে সঙ্গেই মিলিয়ে যাচ্ছে, আবার কখনও ঝড়ে এমন সব উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে যে ঘর থেকে বেরোনো দায়।
আজ ভাবলাম আমাদের এই অঞ্চলের এই বরফ পড়ার বিভিন্ন রকমের অভিজ্ঞতা নিয়ে দু-চার কথা লিখি। সকলের ভালো লাগলে পরে এই নিয়ে বেশ বড় করে লেখা যাবে। এটা বছর দুয়েক আগের কথা। ২০১৮-১৯ নাগাদ। আমি থাকি যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপশ্চিমে প্লেটভিল শহরে। উইসকনসিন রাজ্যের দক্ষিণে উইসকনসিন এবং আইওয়া এই দুই রাজ্যের সীমান্তে এই শহর। আমাদের ছোটবেলার ভূগোল বইতে পড়া পঞ্চহ্রদ অঞ্চলের প্রতিবেশী বলা যায়।
প্রথমেই বলি, বরফ পড়ার প্রথম বছরের অভিজ্ঞতার কথা। আমি এখানে এসেছি তিন বছর আগে অধ্যাপনার কাজ নিয়ে। ২০১৮ সালে। আজীবন কলকাতা হাওড়ার চৌহদ্দিতে বেড়ে ওঠা আমি ক্রান্তীয় মৌসুমি ঠান্ডাকেই সবচেয়ে ঠান্ডা বলে জেনে এসেছি। লুইসিয়ানাতে থাকাকালীন দু-একবার শূন্যের নীচে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে বটে কিন্তু সে আমাদের কলকাতা থেকে গ্রীষ্মকালে দুদিনের জন্য দার্জিলিং যাওয়ার মতোই ব্যাপার। তাই এখানে এসে ধনাত্মক ২৪ থেকে ঋণাত্মক ২৪-এ তাপমাত্রার পরিবর্তনে না জানি কী হয়ে যায় ভেবে প্রথমে বেশ ভয়ে ভয়ে ছিলাম। সবার থেকে খবর নিয়ে বেশ গরমের কয়েকটা পোশাক, বরফের ওপর হাঁটার জুতো সব কেনা গেল। তাপমাত্রা শূন্যের নীচে কয়েক ডিগ্রি নামতে না নামতেই আমি ওইগুলো ব্যবহার শুরু করলাম অনেকটাই লোক দেখানোর জন্য। মনে মনে ভাবলাম এ আর এমন কী।

এক তুষার ঘেরা সকালে আমার বাড়ি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে।
কিন্তু প্রকৃতির ক্রিয়াকলাপে স্বয়ং ঈশ্বরেরও কোনও হাত নেই। তার পরিকল্পনা ছিল অন্য। শীত পড়েছে কি পড়েনি, খবর এল পোলার ভর্টেক্স হবে। অর্থাৎ বিশ্বের বায়ুমণ্ডলের চাপ জনিত কারণে মেরুপ্রদেশীয় ঠান্ডা বাতাস ঝড়ের মতো বয়ে যাবে এই অঞ্চলের ওপর দিয়ে। সে এক সাংঘাতিক অবস্থা। তথ্য অনুযায়ী তাপমাত্রা চলে যাবে মাইনাস ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। আমি মাইনাস ২৪-এর জন্য তৈরি হওয়ার চেষ্টা করছি আর সে জায়গায় ঠান্ডা নাকি হয়ে যাবে দ্বিগুণ। সর্বসাকুল্যে গোদের ওপর তার থেকেও বড় একটি বিশাল মাপের বিষফোঁড়া। এবং শুধু তাই নয়, প্রায় এক সপ্তাহ মতো চলবে এই শীতের তাণ্ডব। বিশ্ববিদ্যালয়-সহ সমস্ত অফিস-কাছারি ছুটি ঘোষণা করে দিল পাঁচদিনের। পুলিশের থেকে জরুরিকালীন ই-মেইল এবং মেসেজ চলে এল যে বাইরে যাকে দেখা যাবে তাকেই গ্রেপ্তার করা হবে এবং মোটা রকমের জরিমানা করা হবে। এসবই জীবন রক্ষার স্বার্থে। কারণ ওই ঠান্ডায় কেউ যদি ১০ মিনিটের বেশি বাইরে থাকে তাহলে শরীরের আঢাকা অংশে ফ্রস্টবাইটের সম্ভাবনা প্রবল এবং তাতে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। মনে পড়ে গেল ছেলেবেলায় পদার্থ বিজ্ঞানের একটা কথা—খুব গরম এবং খুব ঠান্ডা—এই দুইতেই নাকি ছ্যাঁকা লাগে হাতে। এতদিন শুনে এসেছি আজ সচক্ষে দেখলাম। —চলবে