ছোমরংয়ের পথে পথজোড়া অন্নপূর্ণা।
প্রথম দিন: ঘানদ্রুক, কিমরং খোলা ও ছোমরং
অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প যাত্রার প্রাক্কালে মনোভাবটি অনেকটা এমন—যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো…। হাঁটু ব্যথা, ছুটির সমস্যা, দীর্ঘ পথের শ্রম, এইসব নানাবিধ ‘না’ বাচক পিছুটান। কিন্তু হিমালয়ের ডাক একবার ভিতরে ছটফটানি জাগালে, সে-সব আর একেবারেই কাজ করে না, আগেও দেখেছি। অতঃপর রক্সৌল স্টেশন, তারপর গাড়ি চেপে পোখরা।
সুবিখ্যাত ফেওয়া লেকমুখী একটি ব্যাকপ্যাকার্স হোস্টেলে কাটলো প্রথম রাত। পরদিন দুটি গাড়িতে আমরা মোট ৬ জন এবং আমাদের গাইড গিয়ালজিন তার সঙ্গীসাথী ৪ জন সমেত মোট ১০ জন এসে নামলাম ঘানদ্রুকে।
ঘানদ্রুক গ্রাম।
আজ হাঁটা নেই। এক কিলোমিটার উপরে উঠে আমাদের টি-হাউস। ঘানদ্রুক একটি অপূর্ব সুন্দর নেপালি গ্রাম। নেপালের ট্রেক পথের থাকার আস্তানাগুলিকে বলা হয় টি-হাউস। আমাদের টি-হাউসের ছাদে বসে ঝলমলে দুপুরে অন্নপূর্ণা, মচ্ছপুছারে কে সঙ্গে নিয়ে লাঞ্চ সারি সকলে। ঘানদ্রুক গ্রামটি পাহাড়ের কোলে তার রং, রূপ ছড়িয়ে বসে আছে। বিকেলটা কাটে গ্রাম ঘুরে ঘুরে আর সিঁড়ি ওঠানামা করে। অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পের পথ নাকি অনন্ত সিঁড়ির মেলা। বঙ্গ-সন্তানদের তারই প্রস্তুতি নেওয়া চলে আর কি।
আরও পড়ুন:
পরিযায়ী মন, পর্ব-১৫: তিনচুলে ও লেপচাজগৎ এর মেঘ-আলয়ে
অমরনাথের পথে, পর্ব-৩: চন্দনবাড়ি থেকে শুরু হল যাত্রা
পরদিন সকাল থেকে টি-হাউসের সামনে পাহাড়ের শৃঙ্গরা রং মাখামাখির প্রতিযোগিতায় নামে যেন। সকাল সাড়ে সাতটায় এই ট্রেকের প্রথম দিনের হাঁটা শুরু হয় আমাদের। জীবনে প্রথমবার পেরোই নেপালের বহুশ্রুত ঝুলন্ত ব্রিজ৷ নদীর নাম কিমরং খোলা। একটু একটু করে বাড়তে থাকে প্রাণান্তকর চড়াই। দুপুর শেষে পৌঁছে যাই ছোমরং। টি-হাউস লাগোয়া উঠোনে বসে পায়ে ভোলিনি মালিশ করতে করতে বিকেলের চায়ে চুমুক দেওয়ার যে কি আমেজ, তা ট্রেকার মাত্রই জানে। হু হু করে বাড়তে থাকে ঠান্ডা।
দ্বিতীয় দিন: ছোমরং, লোয়ার সিনুয়া, ব্যাম্বু, ডোভান
এতোগুলা নাম পরপর দেখে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। ছোমরং থেকে দ্বিতীয় দিনের হাঁটা শুরু করে দিনের শেষে ডোভান৷ নামগুলো গড়গড়িয়ে লিখে দিলেও হাঁটতে গিয়ে বেশ কাছাখোলা অবস্থা।
প্রায় ১০কিমি পথ হাঁটতে হবে শুনেছি। তবে তাতেও ছোমরং থেকে রওনা হওয়ার আগে টি-হাউস লাগোয়া বইনির দোকানে ঢুঁ মারতে ভুল হয়নি, যা দেখি তাই ভালো লাগে। অবশেষে বন্ধু বনে যাওয়া গিয়ালজিনের হস্তক্ষেপে সানগ্লাস হারাতে হারাতেও খুঁজে পেয়ে হাঁটার শুরু।
প্রায় ১০কিমি পথ হাঁটতে হবে শুনেছি। তবে তাতেও ছোমরং থেকে রওনা হওয়ার আগে টি-হাউস লাগোয়া বইনির দোকানে ঢুঁ মারতে ভুল হয়নি, যা দেখি তাই ভালো লাগে। অবশেষে বন্ধু বনে যাওয়া গিয়ালজিনের হস্তক্ষেপে সানগ্লাস হারাতে হারাতেও খুঁজে পেয়ে হাঁটার শুরু।
আরও পড়ুন:
কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-১৪: একটু হোক-ফোক!
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫২: সব ঘরই ‘তাসের ঘর’
আর সে কি সিঁড়ির বহর রে বাবা! নামতে নামতে অতলে পৌঁছে চঞ্চলা ছোমরং খোলা! এ বার ঠেলে ওঠা আর ওঠা। লোয়ার সিনুয়া পৌঁছে চা বিরতিতে এক বিদেশি দম্পতির সঙ্গে আলাপকালে তাঁদের বয়স জেনে শ্রদ্ধাবনত হই আপনা থেকেই। ফেসবুকিয় প্রচার ছাড়াই তাঁরা কর্তা-গিন্নি অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প থেকে ফিরছেন। সূদুর সুইজারল্যান্ড থেকে ছুটে এসেছেন হিমালয়ের গহীনে। শরীরের বয়সে ৭৭, মনে ২৫ হয় কি হয় না!
ডোভানে দেখা মচ্ছপুছারেতে সূর্যাস্ত।
আবার ওঠা এবং নামা, সিঁড়িবদ্ধ অন্নপূর্ণার পথ ধরে। কখনও বাঁশগাছে ঢাকা জঙ্গুলে পথে, কখনও নামা বোল্ডারের খাড়া ৫৯০টি সিঁড়ি (ফেরার পথে গোনা হয়েছিল) ভেঙে। ব্যাম্বুতে লাঞ্চ। খাদ্য, চাইলে মদ্য ইত্যাদির কোনও অভাব নেই এ পথে। দাম দুর্গমতা অনুযায়ী একটু চড়া হলেও, সহনীয়। বিদেশি ট্রেকার প্রচুর বলে নেপালে ট্রেকপথে টি-হাউসের রমরমা। এই দূর্গম পাহাড়েও তাদের ব্যবস্থাপনা অতি নিঁখুত।
আরও পড়ুন:
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৬: বুকে ব্যথা মানেই কি গ্যাসের ব্যথা? হার্ট অ্যাটাকের উপসর্গ না কি গ্যাসের ব্যথা, বুঝবেন কী ভাবে?
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৩: বাড়ির কাজের লোককে নিজের সম্পত্তির অধিকার দিতে দ্বিজেন্দ্রনাথ দলিল পাল্টেছিলেন
ব্যাম্বু থেকে ক্লান্ত শরীর টেনে নিয়ে আবার ওঠা ওপরপানে। গিয়ালজিন ভয় দেখিয়েছে, ডোভান পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে। একটা মরীয়া ভাব নিয়ে সন্ধ্যের আগে রাস্তা শেষ করার জন্য ছুটছি প্রায়। মানে নড়বড়ে পা নিয়ে যতটা সম্ভব!
হঠাৎ একি! সামনে লেখা ডোভান। আর মনে হাজারো ওয়াটের আলো ছড়িয়ে হাত ছোঁয়া দূরত্বের মচ্ছপুছারে তে সূর্যাস্তের রং খেলা! আচমকা যেন লটারি পাওয়ার অনুভূতি!
আর গিয়ালজিনের মুখে তখন দুষ্টুমির হাসি! ভাগ্যিস ভয় দেখিয়েছে, নইলে কি এমন দ্রুতলয়ে চলতাম, আর এই সোনাগলা বিকেলটা তো নইলে অধরাই থেকে যেতো!
শহুরে মধ্যমানের এবং অকিঞ্চিকর একজন মানুষের মনে তখন ঘোরাফেরা করে…
তবু এই নির্জনতা থাক
একাকী এই হেমন্ত সন্ধ্যায়
কেউ কেউ হেঁটে যাক
বিষন্ন নিঃসঙ্গতা জড়ানো পথে… —চলবে।
ছবি: লেখিকা
হঠাৎ একি! সামনে লেখা ডোভান। আর মনে হাজারো ওয়াটের আলো ছড়িয়ে হাত ছোঁয়া দূরত্বের মচ্ছপুছারে তে সূর্যাস্তের রং খেলা! আচমকা যেন লটারি পাওয়ার অনুভূতি!
আর গিয়ালজিনের মুখে তখন দুষ্টুমির হাসি! ভাগ্যিস ভয় দেখিয়েছে, নইলে কি এমন দ্রুতলয়ে চলতাম, আর এই সোনাগলা বিকেলটা তো নইলে অধরাই থেকে যেতো!
শহুরে মধ্যমানের এবং অকিঞ্চিকর একজন মানুষের মনে তখন ঘোরাফেরা করে…
একাকী এই হেমন্ত সন্ধ্যায়
কেউ কেউ হেঁটে যাক
বিষন্ন নিঃসঙ্গতা জড়ানো পথে…
ছবি: লেখিকা
* লেখিকা মৌসুমী সেনগুপ্ত শিক্ষিকা, গয়েশপুর নেতাজি বালিকা বিদ্যামন্দির (উচ্চ মাধ্যমিক)।