তৃতীয় দিন ও চতুর্থ দিনের সকাল
ডোভান, হিমালয়, দেওরালি, মচ্ছপুছারে বেস ক্যাম্প
ডোভান থেকে মচ্ছপুছারে বেস ক্যাম্প পর্যন্ত যাওয়া হবে। সকালে ব্রেকফাস্টে বসে নিজের পাপের শাস্তি ভোগ করছি। আগের রাতে গিয়ালজিনের দেওয়া কয়েকটি বিকল্পের মধ্যে চেয়ে রেখেছি স্বাস্থ্যকর মুয়েসলি আর ট্যালট্যালে দুধের কম্বিনেশন।
সেটি খাওয়া দূরের কথা, তাকাতেই ইচ্ছে করছে না। কারণ চোখ তখন অনতিদূরের টেবিলে খুব আকর্ষণীয় গোলাকার ডিশজোড়া বড় নিমকির মতো খাবারের দিকে। তার নাম নাকি গুরুং ব্রেড! এটার কথা তো গিয়ালজিন বলেনি! এমন টুংটাং নামের খাবার ফেলে সাতসকালে প্রায় ১১ কিমি পথ হাঁটার আগে এখন খাও কড়মড়ে মুয়েসলি আর বিস্বাদ দুধ!
আরও পড়ুন:
অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পের পথে, পর্ব-১: টি-হাউসের সামনের পাহাড়ের শৃঙ্গ-রা যেন রঙের উৎসবে মেতে উঠেছে
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫২: সব ঘরই ‘তাসের ঘর’
ডোভান থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষণ চলা, ওঠা, নামা, সিঁড়ি সব মিলিয়ে। হিমালয় পৌঁছে চা বিরতি। এরপর প্রথম ধাক্কা—টানা বড় বড় বোল্ডার আর ঝুরো মাটির খাড়াই রাস্তা, ওপরে তাকিয়ে কোনও লাভ নেই। কারণ তারও ওপরে সে উঠে গিয়েছে, উঠেই গিয়েছে ক্রমাগত। এমনটা ঘণ্টা দেড়েক চলার পর হিঙ্কু কেভ। তারপর আরও পা কেঁপে কেঁপে নামা, ওঠা ইত্যাদির পর দেওরালি।
এখানে লাঞ্চ ব্রেক। দেওরালি এসে সবাই হাত-পা ছড়িয়ে এমন ভঙ্গিমায় বসে গেলাম, যেন এখানেই রাতে থাকার কথা ভাবা হয়ে গিয়েছে। জুতো খুলে, মোজা শুকোতে দিয়ে, রোদে পিঠ এলিয়ে আয়েশ করে চা পান চলছে। এরপর গরম ভাতের ওম, সঙ্গে রাইশাক, ডাল আর সব্জি।
ক্রমাগত ঠান্ডা বাড়ছে। আকাশের মুখ ভার দেখে গিয়ালজিন আর দেরি করতে রাজি নয়। এখনো প্রায় পাঁচ কিমি পথ চলা বাকি। আবার সকলে দল বেঁধে নেমে এলাম পথে। চড়াই রয়েছে বেশ, তবে আগের চেয়ে সিঁড়িভাঙার অঙ্ক কিছুটা কম যেন।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৪: সুন্দরবনের রাজমাতা দেবী নারায়ণী
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব ৪৭: শীতকালে দই খেতে নেই?
দলের সবাইকেই কেমন আমার চেয়ে বেশি শক্তিশালী বোধ হয়। ফিসফিস করে পা দুটোকে বোঝাই, এই তো আরেকটু পর মচ্ছপুছারে বেস ক্যাম্প, একটু টেনে দে বাবা!
দেওরালি থেকে ৪ কিমি পথ। হাঁটা শুরু করার কিছুক্ষণ পরে ঝরঝর, রিমঝিম করে বয়ে চলা অপরূপ সুন্দর মোদীখোলা বারেবারে গতি শ্লথ করে। চারপাশে সবুজ গাছের পরিমাণ কমতে শুরু করেছে।
দেওরালি থেকে ৪ কিমি পথ। হাঁটা শুরু করার কিছুক্ষণ পরে ঝরঝর, রিমঝিম করে বয়ে চলা অপরূপ সুন্দর মোদীখোলা বারেবারে গতি শ্লথ করে। চারপাশে সবুজ গাছের পরিমাণ কমতে শুরু করেছে।
সঙ্গে থাকা গিয়ালজিনের আদর্শ ছাত্র নুরী অনেক উঁচুতে কোনও এক অনির্দেশ্য দিকে হাত দেখিয়ে বোঝায় ওই যে ওই অনেক ওপরে হল মচ্ছপুছারে বেস ক্যাম্প। নুরী হিন্দি বলতে পারে না। এক দুর্বোধ্য, দেশজ নেপালি ভাষায় কথা বলে। বাকিটা মাইমে আর হাসি দিয়ে সামলে দেওয়ার চেষ্টা করে। আমি তো শুধু দেখি উড়ে চলা মেঘ, হলদে-সোনালি ঘাসের সমাহার আর আকাশ পানে উঠে যাওয়া লম্বা টানা পাথর, ভরা পথ। আরও ঘণ্টাদুয়েক তীব্র খাড়াই রাস্তা ধরে চলা। ব্যথাবোধের অনুভবও তখন ভোঁতা। একমাত্র লক্ষ্য সন্ধ্যের আগে পৌঁছে যেতেই হবে।
আরও পড়ুন:
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৪: মুশকিল ঘরে, মুশকিল বাইরে, মুশকিল বিশ্বময়!
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২১: শ্রীমার ঠাকুরের প্রতি যত্ন
নিঃশেষিত শক্তি নিয়ে দূরে চোখে পড়ে আমাদের টি-হাউস। আজও গোধূলি নামে পাহাড় জুড়ে। হাওয়া দেয় পাগল পাগল! জ্যাকেট শরীরে পাহাড় জড়িয়ে দেয় সোনালি আগুন। এক ব্যতিক্রমী সন্ধে শুষে নেয় সারাদিনের ক্লান্তি!
পরদিন সকালে ঘরের সামনেই দাঁড়িয়ে দেখি অপরাজিতা-নীল আকাশে মাউন্ট অন্নপূর্ণা সাউথের উষ্ণ সূর্যোদয়। সকালের পিছলে পড়া আলোয় ভেসে এবার চলা অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পের পথে।
পরদিন সকালে ঘরের সামনেই দাঁড়িয়ে দেখি অপরাজিতা-নীল আকাশে মাউন্ট অন্নপূর্ণা সাউথের উষ্ণ সূর্যোদয়। সকালের পিছলে পড়া আলোয় ভেসে এবার চলা অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পের পথে।
যত এগোই, এক প্রবল ঘোর মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে। তার এত কাছে এসে গিয়েছি! মনে হয় যেন হাত বাড়িয়ে ডাকে, আয় আয়…আরেকটু পা চালিয়ে আয়! এত দিনের লালিত স্বপ্ন পূরণের আনন্দাশ্রু নামে আমার দু’ চোখ চুঁয়ে। অদূরেই অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প!
সন্ধ্যে তখন সিঁদুররাঙা
শীতল হাওয়া দিগবিদিক
কোল পেতেছে বসুন্ধরা
চাঁদের আলো জড়িয়ে নিক… —চলবে।
ছবি: লেখিকা
সন্ধ্যে তখন সিঁদুররাঙা
শীতল হাওয়া দিগবিদিক
কোল পেতেছে বসুন্ধরা
চাঁদের আলো জড়িয়ে নিক…
ছবি: লেখিকা
* লেখিকা মৌসুমী সেনগুপ্ত শিক্ষিকা, গয়েশপুর নেতাজি বালিকা বিদ্যামন্দির (উচ্চ মাধ্যমিক)।