রবিবার ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫


খাল্লিকোটের রাজাদের জগন্নাথ মন্দির।

করোনার আবহে ভ্রমণপ্রিয় মানুষদের প্রত্যেককেই অনেক ভাবনাচিন্তা করে বেরোতে হয়। ডিসেম্বর মাসের শেষ দিনটাতে অনেক পরিকল্পনা করে শেষপর্যন্ত বেরিয়েই পড়লাম। বছরের এই সময়টা সকলেই আনন্দ উৎসবে মেতে উঠেছে। উৎসবের আমেজটা দিব্যি টের পাওয়া গেল যখন, আমাদের গাড়িটা ছুটে চলেছে হাওড়া স্টেশনের দিকে।

ঘড়িতে তখন রাত্রি সাড়ে নটা৷ চারপাশ আলো ঝলমলে৷ আমাদের ট্রেন রাত সাড়ে দশটায়৷ আমরা যাব ওড়িশা রাজ্যের রম্ভা৷ হাওড়া থেকে দক্ষিণভারতগামী যেকোনও ট্রেনে চেপে বালুগাঁও স্টেশনে নেমে রম্ভা যেতে হয়৷ পরদিন ভোরে যখন বালুগাঁও স্টেশনে নামলাম, তখন স্টেশনে হাতে গুনে বলা যায়, কটা লোক৷ যাইহোক, বছরের প্রথম দিন আর চারদিকে ঝলমলে রোদ দেখে আমাদেরও খুশিতে ঝলমলে মন৷ স্টেশনের বাইরে এসে একটা অটো ঠিক করলাম৷ এবার গন্তব্য ৩৫ কিমি দূরের রম্ভার ওটিডিসি-র পান্থনিবাস৷ রম্ভায় চিল্কা হ্রদের ধারে এই পান্থনিবাস এখানে থাকার জন্য আদর্শ৷ ওডিশার এদিকটায় এর আগে কখনও আসিনি৷ ট্যুরিস্টদের ভিড় নেই৷ আধাশহুরে বালুগাঁও সবে জেগে উঠছে আর আমাদের অটো চলেছে হু হু করে মসৃণ পথ ধরে৷ এই যাত্রাপথটিও ভারি সুন্দর৷ দূরে নাতিউচ্চ পাহাড়৷ চারপাশটা সবুজ৷ বাড়িগুলোর সামনের উঠোনে এই সকালেই সুন্দর আলপনা আঁকা রয়েছে৷ খুব একটা শহুরে ঝাঁ-চকচকে নয় কিন্তু ভারি সুন্দর মোলায়েম শ্রী রয়েছে চারপাশে৷

চিল্কা হ্রদের দক্ষিণতটে অবস্থিত এই রম্ভা৷ আর পান্থনিবাসটি একেবারে চিল্কা হ্রদের কাছেই অবস্থিত৷ পান্থনিবাসের পথে অটোর ড্রাইভারদার কাছ থেকে জেনে নিচ্ছিলাম, কাছাকাছি কোন জায়গার প্রতি পর্যটকদের আকর্ষণ বেশি। আপাত-শান্ত নিরিবিলি এই আধা শহরে এলাকাটি ওড়িশা রাজ্যের গঞ্জাম জেলায় অবস্থিত৷ ড্রাইভারদা বলছিলেন যে পাখিপ্রেমীদের স্বর্গরাজ্য মঙ্গলাজোড়ি বালুগাঁও থেকে মাত্র ৩৫ কিমি দূরের পথ৷ আমাদের এবারের গন্তব্য যদিও মঙ্গলাজোড়ি নয়৷
রম্ভা ছিল এককালে খাল্লিকোটের সামন্তরাজাদের বাসভূমি৷ এখনও সপ্তদশ শতকে সেই রাজাদের তৈরি জগন্নাথ মন্দির সগৌরবে দণ্ডায়মান৷ মন্দিরের অপূর্ব স্থাপত্য নজর কাড়ে৷

রম্ভার প্রধান আকর্ষণ হল চিল্কা হ্রদ৷ করোনার বাড়বাড়ন্ত যখন চারদিকে, ওড়িশা সরকার ছুটির দিনগুলোতে নৌকোভ্রমণ বন্ধ রেখেছিলেন৷ তাই আশপাশের পর্যটনস্থানগুলো থেকে আসা পর্যটকের দল কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে ফিরে যাচ্ছিল৷ আমরাও ধরে নিয়েছিলাম যে এ যাত্রায় আর বহুশ্রুত সেই অপূর্ব নৌকোভ্রমণ হল না৷ অবশেষে ২ জানুয়ারি সকালে আমরা বেশ কটাদিন বন্ধ থাকার পর প্রথম নৌকোযাত্রায় সওয়ার হলাম৷ আমাদের সঙ্গে নৌকোতে ছিল আর একটি পরিবার৷ এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, ওটিডিসির বেশ কয়েকটা প্যাকেজ ট্যুর হয়৷ এই সময়ে আমরা তিনটে দ্বীপে যাব বলে স্থির করি৷ প্রথমেই ব্রেকফাস্ট আইল্যান্ড, এরপর বার্ডস আইল্যান্ড আর ঘণ্টাশিলা পাহাড়৷ শীতের সকাল৷ কিছু আগেই ভোরে একটা চমৎকার সূর্যোদয় দেখেছি চিল্কা হ্রদে৷ ঝকঝকে রোদ আর ঠান্ডা হাওয়ার আমেজ গায়ে মেখে রওনা দিলাম৷ হয়তো সেদিন জোয়ার ছিল৷ চিল্কার এই অংশটায় নৌকোভ্রমণ বেশ রোমাঞ্চকর৷ বড় বড় ঢেউ এসে মাঝেমাঝেই আমাদের ভিজিয়ে দিতে লাগল৷ বেশ কিছু সময় পর আমরা পৌঁছে গেলাম ব্রেকফাস্ট আইল্যান্ড৷ খাল্লিকোটের রাজার কাছে অনুমতি নিয়ে প্রায় ১৩-১৪ ফুট গভীর হ্রদে জেগে থাকা একখণ্ড পাথরের ওপর একখানি ঘর তৈরি করেন গঞ্জাম প্রদেশের কালেক্টর থমাস স্নডগ্রাস৷ এই হল ব্রেকফাস্ট আইল্যান্ড। চিল্কা লেকে ঢেউয়ে দুলতে দুলতে সাতসকালে যখন এখানে পৌঁছলাম, মাঝির কাছে আমাদের আবদার এখানে নামব। যদিও ব্রেকফাস্ট ততক্ষণে সারা। পিছল ছোট সিঁড়িতে পা কোনও মতে ফেলে নেমে পড়লাম। রাজা রানি যেমন আসতেন এখানে তেমনি থমাস সাহেবও নাকি আসতেন ব্রেকফাস্ট সারতে। সাহেব আবার কখনও সখনও জরুরি মিটিও সারতেন এখানে৷ ফেরার পথে বার্ডস আইল্যান্ডে কিছুক্ষণ কাটিয়ে ঘণ্টাশিলা পাহাড়ের পাশ দিয়ে ফেরা৷ ততক্ষণে সকলের মন ভরে গিয়েছে এক অপূর্ব নৌকোযাত্রায়৷

রম্ভা থেকে আশপাশে দেখে নেওয়া যায় বেশকিছু উল্লেখযোগ্য জায়গা৷ কাছেই চিকিলি গ্রামে আশপাশের পাহাড় থেকে খেতে খাবারের সন্ধানে নেমে আসে কৃষ্ণসার হরিণের দল৷ তাই সন্ধে নামার আগে সেখানে গেলে গোরু মোষের পালের সঙ্গে সঙ্গে হরিণের দলেরও দেখা মেলে৷

চিল্কা হ্রদে সূর্যোদয়।

আর একটি উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান হল অথগড় পত্তন৷ এই অঞ্চলটির বিশেষ ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে৷ এই এলাকাটি পূর্বে জঞ্জালাকীর্ণ ছিল৷ আনুমানিক খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে বোঘলে রাজপরিবারের সন্তান পাণ্ডু দেব এই অঞ্চল মনুষ্য বসবাসের যোগ্য করে তোলেন এবং দীর্ঘ বহু বছর রাজত্ব করেন৷ তিনি মহালিঙ্গেশ্বরের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন৷ তাই তাকে পাণ্ডু তপস্বী বলা হত৷ তাঁর পুত্র ছিলেন ব্যাঘ্র তপস্বী৷ রাজা ব্যাঘ্র তপস্বীর আট সন্তান ছিল৷ সেই থেকেই এই রাজ্য অথগড় রাজ্য নামে পরিচিত হয়৷ এই সমস্ত রাজ্য ছিল সামন্ত রাজ্য৷ পরবর্তীকালে ১৪১০ খ্রিস্টাব্দে কুলমণি নিশঙ্ক মঙ্গরাজদেব তাঁর পূর্বপুরুষদের হৃতরাজ্য ওড়িশার রাজার সাহায্যে উদ্ধার করেন৷ নিজের কন্যার সঙ্গে কলিঙ্গরাজের পুত্রের বিবাহ দেন৷ সেই কন্যা রত্নমণি দেবী লিখিত বেশ কিছু শিলালেখ পাওয়া যায়৷ তার পরবর্তীকালেও এমন বেশ কিছু শিলালেখ পাওয়া যায় যা সেই সময়কার ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে৷ সুতরাং ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান হিসেবে অথগড় পত্তনটির যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে৷

এ অঞ্চলে অন্যতম উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান হল, জৌগড় যা ছিল প্রাচীনকালে সমাপানগরী৷ সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে এই অঞ্চল তাঁর প্রশাসনিক দপ্তর ছিল৷ এখানে বড় পাথরে রয়েছে সম্রাট অশোকের শিলালেখ৷ জৌগড়ের দূরত্ব রম্ভা থেকে ৪৪ কিমি৷ রম্ভায় থেকে প্রাচীন এই ঐতিহাসিক দুর্গ নগরী দেখে আসা যায়৷

রম্ভা থেকে আশপাশে দেখে নেওয়া যায় বেশ কয়েকটি মন্দির৷ এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, নির্মলঝোর-এ দেবীর মন্দির, তারাতারিণী মন্দির, কান্তিয়াগড়ের বটেশ্বর শিবের মন্দির প্রভৃতি৷ রম্ভা থেকে ২২ কিমি দূরে অবস্থিত কান্তিয়াগড়ের মন্দির খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে তৈরি৷ করোনাজনিত ভয়েই কিনা জানি না, মন্দিরগুলোতে ভিড় যথেষ্ট কম৷ স্থানীয় লোকের যাতায়াতই বেশি চোখে পড়ল৷ তবে শুনলাম, বিশেষ বিশেষ তিথিতে যথেষ্ট জনসমাগম হয়৷

আমরা রম্ভা যাওয়ার জন্য শীতকালটা বেছে নিলেও সব ঋতুতেই বিশেষ করে বর্ষায় রম্ভা মোহময়ী৷ তবে শীতকালে নানান প্রজাতির প্রায় ১৫০ রকম পরিযায়ী পাখি এসে ভিড় করে রম্ভাতীরবর্তী চিল্কা হ্রদেও৷ ভোরবেলায় সূর্যোদয় দেখতে গিয়ে চোখে পড়ল জেলেদের নৌকো নিয়ে মাছ ধরতে যাবার প্রস্তুতি৷ এই হ্রদে নাকি নানান প্রজাতির জলজ প্রাণীরও আবাস৷ ম্যাকারেল, চিংড়ি বা কাঁকড়া ধরার জন্য জেলে নৌকোরা তৈরি হয় রোজ, এই ভোরের বেলায়৷ বহু অবলুপ্তপ্রায় গাছপালা, শৈবাল আর সামুদ্রিক জীবের আবাসস্থল এই চিল্কা হ্রদ ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা৷ তার মধ্যে যেমন রয়েছে ইরাবডী ডলফিন, রয়েছে নানান প্রজাতির সরীসৃপ এবং উভচর প্রাণী৷

প্রকৃতির রংবদলের সঙ্গে রং বদলায় হ্রদের জলেরও৷ সেও মোহময়ী সাজে যেন অপেক্ষা করে পর্যটকের৷ নিছক এক অলস ছুটি কাটানোর সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসের পাতায় স্থান চেনা প্রায় অচেনা জায়গাগুলো প্রত্যক্ষ করতে কিংবা তীর্থযাত্রার মানসে সদলবলে অনায়াসে বেরিয়ে আসতে পারেন ওড়িশার চিল্কা হ্রদ পার্শ্ববর্তী রম্ভায়৷

ব্রেকফাস্ট আইল্যান্ড।

● কত দিনের জন্য
যেকোনও ঋতুতে ছুটি কাটানোর জন্য রম্ভা আদর্শ৷ আশেপাশের সমস্ত দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখতে হলে ন্যুনতম দিন তিনেক জরুরি৷

● কীভাবে যাবেন
হাওড়া থেকে ফলকনামা এক্সপ্রেস, ইস্টকোস্ট এক্সপ্রেস অথবা যশবন্তপুর এক্সপ্রেসে চড়ে পৌঁছে যেতে পারেন ওড়িশার বালুগাঁও৷ সময় লাগে কমবেশি সাড়ে নয় ঘণ্টা৷ বালুগাঁও নেমে অটো অথবা গাড়িতে চেপে ৩৫ কিমি দূরবর্তী রম্ভায় ওটিডিসি পান্থনিবাসে পৌঁছাতে হবে৷

● কোথায় থাকবেন
রম্ভায় থাকবার জন্য ওড়িশা ট্যুরিজমের পান্থনিবাসই আদর্শ৷ থাকার খরচ দু’ জনের প্রতিদিন আনুমানিক ১০০০টাকা থেকে ৩২০০টাকা৷

ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখক

বাইরে দূরে

লেখা পাঠানোর নিয়ম : এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে বেশ কিছু ছবি ও ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ পাঠাতে হবে। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না। ইমেল : samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content