মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


যে দিকে দু' চোখ যায় শুধুই বরফ।

সব রাস্তা ছাড়িয়ে গাড়ি ইতিমধ্যে এসে পৌঁছল একটি ছোট কনিফারের জঙ্গলে। তার মধ্যে দিয়ে রাস্তা করা আছে বটে কিন্তু বেশ সরু। অতএব এখানে গাড়ি পিছলে গেলেই আটকে যাবে। আর যে কারণে সবথেকে ভয় লাগে বা আশংকা হয়, জীবনে ঠিক সেটাই হয়। আমিও এর ব্যতিক্রম নই। ওই কনিফারের জঙ্গলে একটি বাঁক নিতে গিয়ে রাস্তা না বুঝে একটু বেশি ডানদিকে চলে গেলাম। গাড়ি পিছলে রাস্তা থেকে নেমে গিয়ে আটকে গেলাম রাস্তার ধারের বরফে। দু’ বার চেষ্টা করলাম একটু জোরে এক্সেলারেটর চেপে গাড়ি বের করার। কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ হল। এবার আমার অবস্থা ভয় পেতে পেতে দেওয়ালে পিঠ থেকে যাওয়ার মতো। তবে আর ভয় পেয়ে লাভ নেই। এবার কী করে এর থেকে বাঁচা যায় সেই ব্যবস্থা দেখতে হবে।
প্রথমত সমস্যাগুলো একটু ঝালিয়ে নিলাম। এক, গাড়ি বন্ধ করতে পারব না। কারণ এর আগে পনেরো মিনিট মতো গাড়ি বন্ধ করে রাখতেই ব্যাটারি বসে গিয়েছিল। দুই, ৯১১ ডাকতে পারব না। কারণ এই গাড়ির বিমায় আমার নাম নেই। তিন, মুঠোফোনে দেখলাম বাইরে এই অঞ্চলে তখন -৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তারপাত্রা। অর্থাৎ আর যাই করি, বাইরে ১০-১৫ মিনিটের বেশি একটানা থাকা যাবে না, না হলে ফ্রস্টবাইটের সম্ভাবনা। আর চার, আশেপাশে কোনও গাড়িও আসছে না যে তার থেকে সাহায্য পাওয়া যাবে।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৮: যেখানে বাঘের ভয় সন্ধে ঠিক সেখানেই হয়, আমারও ঠিক তাই হল

জ্যোতির্লিঙ্গ যাত্রাপথে, পর্ব-৪: কাশীর পথে-ঘাটে

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-৯: মন্দির হয়ে বৌদ্ধবিহার

অন্যদিকে আশার কথা হল, গাড়িতে তেল পুরো ভরানো আছে। অতএব বেশ খানিক্ষণ একে চালিয়ে রাখা যাবে। আর আছে গাড়ির পেছনে বেলচা। সেটাই আমার বাঁচার একমাত্র উপায় আপাতত। অতএব আর বিন্দু মাত্র সময় নষ্ট না করে নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে।

ওই গাড়ির আলোতেই যেটুকু দেখলাম তাতে মনে পড়লো রবার্ট ফ্রস্টের ওই কবিতাটি, যা দিয়ে এই লেখাটি শুরু করেছিলাম। তবে বলা বাহুল্য যে, এটা কবিতার সময় নয়। বরং আমি মনে প্রাণে চাই কবিতার উল্টোটাই হোক। অর্থাৎ কেউ যেন দেখতে পায় যে আমি এখানে আটকে রয়েছে।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৪: ঠাকুরবাড়িতে দোলে আসত নাচিয়ে, নাচের তালে তালে হত আবিরের আলপনা

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৫: সুন্দরবনের মাছ বৈচিত্র্যের ক্ষতিকারক প্রজাতি হল ক্রোকোডাইল ফিশ

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-১০: সাধনা যে সত্যের আশ্রয় পাওয়ার তরে…

যাই হোক, বেলচা নিয়ে বরফ পরিষ্কার করা শুরু করলাম। দশ পনের মিনিট করে চাকার চারপাশ থেকে বরফ সরাচ্ছি। আবার হাত-পা জমতে শুরু করলেই আবার গাড়ির মধ্যে এসে বসছি কিছুক্ষণের জন্য। এই বরফ পরিষ্কার করার সময় আরও আর যেটা মাথায় রাখতে সমস্যা হচ্ছিল, জুতো বা দস্তানার মধ্যে যাতে বরফ না ঢুকে যায়। কারণ, তাহলেও ওই ফ্রস্টবাইটের সম্ভাবনা থাকবে। এই পরিশ্রমসাধ্য কাজ করতে থাকলে একটু আধটু বরফ ঢুকে গেলে সেটা বোঝা যায় না। অথচ বেশিক্ষণ ওরকম ভাবে থাকলে ফ্রস্টবাইটের সম্ভাবনা থাকতে পারে। এটা আমি দেখেছিলাম সেই আমার ছেলেবেলায় মেরু-অভিযাত্রীদের উপস্থাপনায়, যেখান থেকে আমার এই মেরু দেশে এসে কাজ করে বেড়ানোর ইচ্ছার সূত্রপাত।
আরও পড়ুন:

অজানার সন্ধানে: রং যেন মোর মর্মে লাগে, আমার সকল কর্মে লাগে…

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১: শচীন ও মীরা দেব বর্মনের ঘর আলো করে এল এক ‘দেব শিশু’

হেলদি ডায়েট: গাল জুড়ে এক রাশ ব্রণ? সমাধান লুকিয়ে আছে এ সবের মধ্যে, কী ভাবে কাজে লাগাবেন ঘরোয়া টোটকা?

ওই যে দশ মিনিট করে গাড়ির মধ্যে থাকছিলাম সেই সময়টায় বাধ্যতামূলক ভাবে খুলে ফেলছিলাম জুতো দস্তানা টুপি সবকিছু। আবার গাড়ির হিটারে হাত পা কান সব একটু গরম হলে আবার নামছিলাম পরিষ্কার করতে। তো এই ভাবে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট মতো বরফ সরিয়ে পেছনের আর সামনের চাকার পাশাপাশি জায়গা পরিষ্কার করা গেল। তার পরে গাড়িতে বসে ইষ্টনাম জপে দিলাম এক্সেলেরেটরে চাপ। কিন্তু প্রকৃতির ক্রিয়া কলাপে ইষ্টেরও হাত থাকে না। এতো খাটাখাটনির পরেও যে কে সেই। অর্থাৎ চাকা বনবন করে ঘুরে যাচ্ছে আর এগোনো বা পিছন যাচ্ছে না এতটুকুও। আবার বেশি যদি এমন ভাবে এক্সেলেরেটর চেপে গাড়ি বের করার চেষ্টা করি তাতে বিপদ আরও বাড়বে। তার কারণ ওই ঘর্ষণে বা চাপে গাড়ির তলার বরফ জল হয়ে যাবে, উঠে আসবে ওপরের দিকে আর তারপরেই এই প্রচণ্ড ঠান্ডায় আরও শক্ত হয়ে জমে যাবে চাকার সামনে পিছনে।

সস্ত্রীক লেখক।

এরকম হলে তাকে আর বেলচা দিয়ে ভাঙাও যাবে না। অতএব আমি প্রায় সমস্ত আশা আকাঙ্খায় জলাঞ্জলি দিয়ে বসে রইলাম। প্রায় পনেরো কুড়ি মিনিট গাড়ির ভেতর শুধু বসে চিন্তা করছি যে, এবার চাকার তলার জমা মাটি তোলা শুরু করবো, নাকি ফোন করে ৯১১ কেই ডাকবো ওসব বিমার কথা না ভেবে। প্রাণে তো বাঁচি আগে, বিমার নিয়ম কানুন সব পরে দেখা যাবে।

ছবি: লেখক
* রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা (Mysterious Alaska) : ড. অর্ঘ্যকুসুম দাস (Arghya Kusum Das) অধ্যাপক ও গবেষক, কম্পিউটার সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস।
 

বাইরে দূরে

লেখা পাঠানোর নিয়ম: এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। লেখার সঙ্গে বেশ কিছু ছবি পাঠাতে হবে। চাইলে ভিডিও ক্লিপও পাঠাতে পারেন। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content