শনিবার ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


মাইনাস ৪৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় খালি গায়ে আমার চ্যালেঞ্জ।

এতক্ষণ পর্যন্ত আমরা শহরের মধ্যেকার রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছিলাম। গাড়ি চলে খুব কাছাকাছি এবং অনেক ধীরে। তাই সামনের গাড়ি বা রাস্তা মোটামুটি দেখা যাচ্ছিল ভালো ভাবেই। কাজেই ওই টলমল করে চলা ছাড়া আর কিছু অসুবিধা হচ্ছিল না। সমস্যাটা হল যখন হাইওয়ে তে উঠলাম। পাঁচ মাইল রাস্তার মধ্যে আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এক মাইল আর ওই প্রাথমিক বিদ্যালয়টিতে পৌঁছনোর আগের এক মাইল মতো বাদ দিলে বাকি তিন মাইলই হাইওয়ের ওপর দিয়ে। সেই রাস্তায় উঠতে না উঠতেই দেখি সামনেটা পুরো কুয়াশা। সবে সবে ঝড়টা এসেছে তো। তাই ছোটছোট বরফের কণা উড়ে বেড়াচ্ছে চারিদিকে। সে কুয়াশার পরিমাণ ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।
মাত্র দুই থেকে তিনফুট মতো দেখা যাচ্ছে সামনে। পিছনের কাঁচ দিয়ে তো কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কাজেই গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছি পুরো আন্দাজে। আর সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হল সবাই ওভাবেই চালাচ্ছে। অর্থাৎ সামনে পাশে কোন গাড়ি যাচ্ছে কেউ কিছু দেখতে পাচ্ছে না। অতএব যেকোনও সময় কোন গাড়ি এসে ধাক্কা মেরে দিতে পারে। তার ওপরে আমার বাড়ির রাস্তায় ওই হাইওয়ের ওপরে দু’ একটা চৌমাথার মোড় আছে। অর্থাৎ আসে পাশে থেকে আরও কয়েকটা রাস্তা এসে ওই হাইওয়েটা লম্বালম্বি পেরিয়ে ছেলে গিয়েছে ওদিকে। সেগুলোও বোঝা যাচ্ছে না, কারণ ওই এলাকার ট্রাফিকের আলোগুলো দেখাই যাচ্ছে না। কাজেই পাশ থেকে এসে অন্য একটি গাড়ি যদি এসে ধাক্কা মেরে দেয় কিচ্ছু করার নেই।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-২১: ঘণ্টাখানেকের মধ্যে গাড়ির উপর প্রায় এক-দেড় ফুট বরফ জমে গেল

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১১: স্বর্ণকুমারী দেবী— ঠাকুরবাড়ির সরস্বতী

সবচেয়ে বড় কথা এরকম দুর্ঘটনার আমরা হামেশাই শুনে থাকি এই অঞ্চলে। কাজেই ইষ্টনাম জপতে জপতে চলেছি। আমার পত্নী-মহাশয়া তো আরও ভয় পেয়ে গিয়েছে। সে পুরো সোজা হয়ে হাত দুটোকে শক্ত করে মুঠো করে পাথরের মতো বসে আছে। চোখের পলক পড়ছেনা আমাদের দু’ জনের কারোরই। কোনওরকমে চলেছি।

আধ মাইলও হয়তো যায়নি ওই ভাবে আমার গাড়ির পাশ দিয়ে একটা উঁচু ট্রাক আমাকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। সেও কিছু দেখতে পাচ্ছে না। আমিও কিছু দেখতে পাচ্ছি না। সে মানে একদম এইটুকু পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। কোনও রকমে ধাক্কা লাগতে লাগতে বেঁচেছি। কিন্তু সেটা যেই পাশ দিয়ে বেরোলো তার চাকার থেকে বরফ ছিটকে এসে পড়লো আমার নিচু সেডান গাড়ির সামনের কাঁচে অর্থাৎ উইন্ডশিল্ডে। পুরো সামনেটা ঢেকে গেল বরফে মুহূর্তের মধ্যে। আমার সহধর্মিনী তো চিৎকার করে উঠেছে। চারিদিকে কিছু দেখা যাচ্ছে না। অথচ গাড়ি চলেছে হাইওয়ে দিয়ে।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৩: সারদা মায়ের দার্শনিক দৃষ্টি

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫০: লক্ষ্মণ—ভ্রাতৃত্বের এক অনন্য দৃষ্টান্ত

সে এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। আমি ওয়াইপার অর্থাৎ যেটা দিয়ে বৃষ্টির সময় কাঁচের জল পরিষ্কার করে, সেটা চালালাম। কিন্তু ওই ভারী বরফ সেটা সরাতেই পারল না। শুধুমাত্র সামনের কাঁচের একদম কোণাটায় একটুখানি জায়গায় বরফ ঢাকা পড়েনি। আমি কোনও রকমে নিচু হয়ে ওইটুকু জায়গা দিয়ে দেখে দেখে এগোচ্ছি। কিছু দু’ তিন মিনিটের বেশি এগোনো গেল না। কাঁচের ওপরের বরফ গুলো নিচে গড়িয়ে এসে ওইটুকু জায়গাও ঢেকে দিল। অগত্যা। প্রাণ হাতে করে নিয়ে ওই হাইওয়ের মধ্যেই দাঁড়িয়ে গেলাম। মানে দাঁড়াতে বাধ্য হলাম। একদম না দেখে কিকরে গাড়ি চালাবো। গাড়ি থেকে নেমে তাড়াহুড়ো করে বরফ পরিষ্কার করার ঝাড়নটা দিয়ে কাঁচটা কোনোরকমে পরিষ্কার করে আবার ঢুকতে যাবো। ইতিমধ্যে দেখি সামনে থেকে একজন বয়স্ক লোক ছুটে ছুটে আসছে। আসছে তো আর বুঝতে পারিনি।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৯: কবির ভালোবাসার পশুপাখি

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩১: বীণাপাণির চরণ ছুঁয়ে…

হঠাৎ করে মনে হল, ওই কুশার মধ্যে থেকে প্রকট হল। কেউ একজন। সে এসেই হাঁপাতে হাঁপাতে আমাকে জানাল, যে তারা এই মাত্র একটা গাড়িকে বা অন্যকিছুকে ধাক্কা মেরেছে। আর জিজ্ঞাসা করছে সেটা কি আমাদের গাড়িটাই? আমরা কি সেই জন্যই দাঁড়িয়েছি? আমি তাড়াহুড়ো করে কোনও রকমে তাকে জানালাম যে না সেটা আমাদের গাড়ি নয়। বলেই অনেক কষ্টে সামনে নজর করতে দেখি তাদের গাড়িটাও সামনে দাঁড় করানো। সেসব সেরেই গাড়িতে বসলাম এসে। কিন্তু বসেই পরিস্থিতিটা বিচার করলাম মনে মনে। মানে আমি দেখিও নি যে সামনে ওই রকম একটা গাড়ি দাঁড় করানো আছে। আবার এটাও ভাবলাম যে ওই লোকটা যে অন্য আরেকটা গাড়িকে ধাক্কা মেরেছে সেটাও হয়তো এখানে সামনেই কোথাও উল্টে পরে আছে। আবার এটাও ভাবছি যে নিশ্চই এরকম দুর্ঘটনা একটাই মাত্র ঘটেনি।

সর্বত্র বরফে ঢাকা।

এ পাশে ওপাশে হয়তো আরও দু’ একটা গাড়ি একে অন্যকে ধাক্কা মেরে দাঁড়িয়ে আছে হয়তো। কুয়াশায় তো কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আমার ভেবেই বেশ হাড় হিম হয়ে গেল। কোনও রকমে একদম ধীরে ধীরে গাড়ি চালাতে লাগলাম প্রচণ্ড সতর্ক ভাবে। দু’ জনেই মনে মনে ভগবানকে ডাকছি যাতে অক্ষত শরীরে বাড়ি পৌঁছে যাই। তো, সেই প্রার্থনাটিও ভগবান শুনেছিলেন। প্রায় এক থেকে দেড় ঘণ্টার প্রচেষ্টায় শেষে বাড়ি পৌঁছলাম। আর গাড়ি দাঁড় করিয়ে যে দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছিলাম, সেটার শব্দ আর তার অনুভূতি আমাদের আজও মনে আছে, আর থাকবেও চিরকাল। —চলবে।
* রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা (Mysterious Alaska) : ড. অর্ঘ্যকুসুম দাস (Arghya Kusum Das) অধ্যাপক ও গবেষক, কম্পিউটার সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস।

Skip to content