মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪


ছবি: অঙ্কনা চৌধুরী।

পার্মাফ্রস্টের ঝামেলাও কম নয়। আলাস্কার বেশকিছু জায়গায় রাস্তা চলে গিয়েছে পার্মাফ্রস্টের ওপর দিয়ে। অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠের তলায় স্তরে স্তরে মাটি এবং শক্ত বরফ। রেইনবো-কেক যেরকম দেখতে হয়; সেইরম অনেকটা। ওই ক্রিমের স্তরগুলোর জায়গায় মাটি আর বরফ ক্রমান্বয়ে চলে গিয়েছে অনেক নিচে অব্দি। এখন এই বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর জন্য ভূপৃষ্ঠের ঠিক অব্যবহিত পরেই যে বরফের স্তরটি থাকে সেটা গরমকালে গলে যায়। আর সেটা গলে গেলেই রাস্তা ধসে যায়। এ বার শীতকালে প্রচণ্ড ঠান্ডায় ওই স্তরটি আবার উল্টোপাল্টা ভাবে জমে যায়। আর জল জমে গেলে যেহেতু বরফের আয়তন বেড়ে যায়, সেহেতু ওই পার্মাফ্রস্টের বরফ রাস্তা পুরো ফাটিয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসে। যাতায়াতের নিরিখে সে ভয়ানক দুর্যোগ। শীতকালে কী রকম হয় বলি, তাহলেই বোঝা যাবে দুর্যোগটা ঠিক কতটা ভয়ানক।
এই ফেটেফুটে যাওয়া রাস্তার ওপরে আবার শীতকালের বরফ পড়ে জমে যায়। কখনও এই বরফ গুঁড়ো গুঁড়ো বরফ, যার মধ্যে পড়লেই গাড়ি সটান গিয়ে ধাক্কা পার্মাফ্রস্টের শক্ত বরফে। আবার কখনও সেই বরফ জমে শক্ত হয়ে পিচ্ছিল, যাতে গাড়ি পিছলে চলে যাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। মুশকিল হল, দূর থেকে দেখে রাস্তার মধ্যে এই মরনফাঁদ বোঝা যায় না। কারণ শীতের বরফ পড়ে সমস্ত জায়গাটা একই রকম লাগে। তার ওপরে শীতকালে বেশিরভাগটাই রাত। শহর থেকে একটু বেরোলেই এখানে রাস্তাতেও কোনও আলো দেওয়া থাকে না। অতয়েব গাড়ি চালাতে হয় পুরোপুরি হেডলাইটের আলোয়। কাজেই বোঝা যাচ্ছে যে বিপদ ঠিক কতটা ভয়াবহ হতে পারে।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-১৯: আলাস্কায় শীতকালের রাস্তায় গাড়ি চালানো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬১: ‘বন্ধু’ তোমার পথের সাথী

এই রকমই একদিন ওরা গিয়েছে। ২০২২ এর ডিসেম্বর মাস। হঠাৎ খবর এল যে তাদের গাড়ি উল্টে গিয়েছে। উল্টে যাওয়ার মানে কিন্তু ঘুরে যাওয়া বলছি না বা একটু আধটু কাত হয়ে রাস্তার ধরে বরফে ঢুকে যাওয়া নয়। পুরোপুরি ছাদ নিচের দিকে হয়ে উল্টে গিয়েছে। আমি তো শুনেই থ। আমি এর আগে আমার কোনও পরিচিতের এমন ঘটনার কথা শুনিনি। তবে ঈশ্বরের অসীম কৃপা আর এখনকার গাড়ির নিরাপত্তা জনিত বন্দোবস্তের জন্য তাদের কোনও ক্ষতি হয়নি।
পরে সে আসার পরে বিশদে শুনলাম কি হয়েছিল।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১০: লীলা মজুমদার— নতুন রূপকথার হলদে পাখি

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩১: শ্রীমার পঞ্চতপা ব্রতানুষ্ঠান

সেই দলে একজন আফ্রিকার ছাত্র ছিল। তারা দু’ জনেই গিয়েছিল ওই খনিতে। ফেরার রাস্তাতেই ওই বিপদ ঘটে। ফেরার সময় ওই আফ্রিকার ছাত্রটিই তাদের গাড়িটা চালাচ্ছিল। মোটামুটি ৩০-৪০ মাইল প্রতি ঘণ্টার বেগেই চালাচ্ছিল সে। শীতকালে ওই সব রাস্তায় সেটাই স্বাভাবিক গতিবেগ। এ বার হঠাৎ করে রাস্তার উল্টো দিক থেকে একটা গাড়ি পিছলে এসে একদম তাদের সামনে চলে আসে। তখন সে স্বভাবতই বেশ জোরে স্টিয়ারিংটা ঘোরায় মুখোমুখি সংঘর্ষ আটকানোর জন্য।
অন্য কোনও জায়গা হলে কোনও সমস্যা ছিল না। কিন্তু এখানে বিপদ সব দিকেই। ওই জোরে স্টিয়ারিং ঘোরানোর ফলে গাড়ি বেঁকে গিয়ে সোজা উঠে যায় রাস্তার পাশের স্তূপাকৃতি বরফের ওপরে। আর তারপর সেই স্তুপের গা বেয়ে গড়িয়ে সেখান থেকে একদম উল্টে এসে পড়ে রাস্তার মধ্যে। তবে গাড়িতে বেল্ট বেঁধে রাখার জন্য আর ওই নিরাপত্তার জন্য রাখা এয়ারব্যাগ খুলে বেরিয়ে আসার জন্য তাদের দু’ জনেরই শরীর অক্ষত ছিল। তবে গাড়িটা আর অক্ষত ছিল না। পুরোপুরি ভেঙে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
আরও পড়ুন:

রকম-রকম, হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২৮: দুরন্ত ঘূর্ণি

ডায়েট টিপস, ডায়েট ফটাফট: গ্রিন টি খেলেও কোনও সুফল মিলছে না? ভুল সময়ে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন না তো?

এর ওপরে আছে হঠাৎ হঠাৎ তুষারঝড়ের ঝামেলা। এর আগেই আমার প্রথম দিনের অভিজ্ঞতার কথা বলেছি। তবে সেটা ছিল খুবই অদ্ভুত, দীর্ঘ মাসাধিক কালব্যাপী একটা ঝড়। সেরকম হয়তো সাধারণত হয় না। কিন্তু, হঠাৎ হঠাৎ করে ছোট খাটো তুষারঝড় চলেই আসে। তাই শীত কালে প্রতিদিন কোথাও বেরোনোর আগে একবার করে ন্যাশনাল ওশিয়ানিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-এর (এনওএএ বা নোয়া) ওয়েবসাইটে আবহাওয়ার বিবরণ এবং অনুমানগুলো দেখে নিয়ে বেরোনো খুব খুব জরুরি। —চলবে।

ছবি: অঙ্কনা চৌধুরী।

* রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা (Mysterious Alaska) : ড. অর্ঘ্যকুসুম দাস (Arghya Kusum Das) অধ্যাপক ও গবেষক, কম্পিউটার সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস।

Skip to content