দূরে দিগন্তের কিছুটা ওপরে দেখা যাচ্ছে একটা বিরাট বড় চাঁদ। ছবি: অঙ্কনা চৌধুরী
আলাস্কান উপজাতিদের সম্পর্কে না হয় পরের পর্বে বলা যাবে, এখন ফিরে আসি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে। পাহাড়ের একদম নিচে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষনের দপ্তর। সেখান থেকে উঠে পাহাড়ের মাঝামাঝি গেলে সমস্ত প্রকৌশল (এঞ্জিনিয়ারিং) এবং প্রযুক্তিগত পড়াশোনার বিভাগ। আমি কম্পিউটার সায়েন্স-এর অধ্যাপক। আমার দপ্তরটি এই বিভাগেই। তার সঙ্গে লাগোয়া পূর্ত (পাবলিক অ্যাফেয়ার্স)-বিভাগ, ব্যবসায়িক-বিভাগ (বিজনেস ডিপার্টমেন্ট), এবং কলা-বিভাগ (আর্টস ডিপার্টমেন্ট)।
সব কিছু ছাড়িয়ে আরও ওপরে চলে গেলে একদম পাহাড়ের চূড়ায় প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বিভাগ। তাকে ছাড়িয়ে আরও উপরে উঠে গেলে সবার উপরে ভূ-তাত্ত্বিক (জিওসায়েন্স) বিভাগ। প্রত্যেক বিভাগের আলাদা আলাদা ভবন। প্রত্যেক বিভাগের অধ্যাপক-সহ অন্যান্য কর্মচারীদের নির্দিষ্ট ভবনে ঢোকার জন্য একসেস কার্ড আছে। বিকেল পাঁচটার পরে যখন সমস্ত ভবন বন্ধ হয়ে যায় তখন ঢুকতে গেলে ওই একসেস কার্ড ব্যবহার করে ঢুকতে হবে। এই সমস্ত বিভাগে আমাদের গবেষণার কথা পরবর্তী পর্বে আলোচনা করা যাবে। তবে এখন অবস্থানের খাতিরে যেটা বলে নেওয়া দরকার সেটা হল, আমার প্রযুক্তি বিভাগ থেকে বিজ্ঞান বিভাগ প্রায় এক মাইল মতো চড়াই রাস্তা। আর বিজ্ঞান বিভাগ ছাড়িয়ে পাহাড়ের ওই চূড়া থেকে পাহাড়ে উল্টো দিকে নেমে গিয়েছে বেশ কয়েকটা স্কি করার ট্রেইল।
আরও পড়ুন:
রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-১৬: আলাস্কায় শীতকাল মানেই ‘এই রাত তোমার আমার…শুধু দু’ জনে’
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’
ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে জানতে পেরেছি যে, ওই ট্রেইলগুলোতে বেশ অন্ধকার থাকে এবং তাই ওখানে গেলে মেরুজ্যোতি দেখা যেতে পারে। তো, সেদিন রাতে আকাশ পরিষ্কার এবং মেরুজ্যোতি দেখার সম্ভাবনার কথা জেনে বিশ্ববিদ্যালয়েই থাকবো ঠিক করলাম। আমার ঘরে বিছানা বালিশ সবই রাখা থাকে। তাই সেটা কোনও অসুবিধা নয়। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা খাবার জায়গা থেকে সন্ধের আগেই কিছু খাবার দাবার কিনে রেখে দিলাম। কাজেই কোনও সমস্যা নেই।
কিন্তু সমস্যা কি আর কাউকে জানিয়ে আসে। আমি, রাতের খাওয়া সেরে দপ্তরেই বসে বসে কিছু কাজকর্ম সেরে নিলাম। তারপর খাওয়া-দাওয়া সেরে সাড়ে দশটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম মেরুজ্যোতি দেখতে। আমার বিভাগ থেকে চড়াই-উতরাই পথ বিজ্ঞান বিভাগ পেরিয়ে ওই ট্রেইলে যেতে সময় লাগলো পঁচিশ মিনিট মতো। বলাই বাহুল্য, রাস্তা পুরো শক্ত বরফে ঢাকা। তাই বেশ পিচ্ছিল, আর তাই হাঁটতে সময় আরও বেশি লাগছে।
কিন্তু সমস্যা কি আর কাউকে জানিয়ে আসে। আমি, রাতের খাওয়া সেরে দপ্তরেই বসে বসে কিছু কাজকর্ম সেরে নিলাম। তারপর খাওয়া-দাওয়া সেরে সাড়ে দশটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম মেরুজ্যোতি দেখতে। আমার বিভাগ থেকে চড়াই-উতরাই পথ বিজ্ঞান বিভাগ পেরিয়ে ওই ট্রেইলে যেতে সময় লাগলো পঁচিশ মিনিট মতো। বলাই বাহুল্য, রাস্তা পুরো শক্ত বরফে ঢাকা। তাই বেশ পিচ্ছিল, আর তাই হাঁটতে সময় আরও বেশি লাগছে।
আরও পড়ুন:
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২৭: কী করে তোকে বলব!
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩০: সুন্দরবনে লৌকিক দেবতা ছাওয়াল পীর ও রাখাল ঠাকুর
ট্রেইলের মুখে পৌঁছে দেখি সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। ট্রেইলেরর দু’ পাশ জুড়ে চিরহরিৎ হেমলকের সারি। এই রাতে দেখে তাদের কালো-কালো দৈত্যের মতো মনে হচ্ছে। মাঝখান দিয়ে সাদা রাস্তা চলে গিয়েছে নিচে। আর দূরে দিগন্তের কিছুটা ওপরে দেখা যাচ্ছে একটা বিরাট বড় চাঁদ। তার জ্যোৎস্নায় সাদা বরফ যেন আরও সাদা হয়ে গিয়েছে। মুক্তোর মতো স্নিগ্ধ আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে চারিদিকে। পাশের উঁচু উঁচু কালো কালো হেমলকের পাতাতেও জমাট বাঁধা বরফ। তাদের থেকেও ঠিকরে বেরোচ্ছে ওই স্নিগ্ধ আলো। সে যে কি অপূর্ব দৃশ্য তাকে ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। আমি প্রাণ ভরে গায়ে মাথায় মেখে নিতে চাইছি সেই স্নিগ্ধতা। মন্ত্রমুগ্ধের মতো হাঁটতে লাগলাম ট্রেইল ধরে নিচের দিকে। কিছুতেই যেন ফিরে যেতে ইচ্ছা করছেন।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৮: শুরু হল কঠিন জীবনচর্যা
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৫: প্রতিযোগিতা সর্বদা স্বাস্থ্যকর নয়, কদ্রুবিনতার শত্রুতায় কি তারই ইঙ্গিত?
তার মধ্যে মেরুজ্যোতিও দেখা যাচ্ছে না কিছুতেই। শুধু মনে হচ্ছে আর একটু গেলেই হয়তো দেখা যাবে। আমি যেন মরীচিকার উদ্দেশ্যে হেঁটে চলেছি, বা একেই হয়তো বলে নিশির ডাক। ইতিমধ্যে মুঠো ফোন ঠান্ডায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। চশমা খুলে রাখতে হয়েছে কারণ কাঁচে পুরো বরফ জমে যাচ্ছে। মুখের শীতের মাস্কটা একটু ভালো করে নিঃশাস নেওয়ার জন্য এক মিনিটের জন্য খুলে রেখেছি। তার পরে সেটা পরতে গিয়ে দেখি সেটাও পুরো জমে কাঠ। মুখের নিঃশ্বাসে যে ভাপ বেরোচ্ছে সেটা ওই মাস্কের একদিকে জমে বরফ হয়ে গিয়েছে। তাকে আবার হাতের গ্লাভস দিয়ে ঘষে ঘষে গলানো গেলো। আবার সেটা পরে হাঁটছি। এই মরীচিকার উদ্যেশ্যে যে কতক্ষণ হেঁটেছি তার ঠিক নেই। আনুমানিক ৫০ থেকে ৫৫মিনিট মতো আমি বাইরে। আর তাপমাত্রা তখন মাইনাস ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অন্তত পক্ষে যখন বেরিয়েছিলাম আমার ঘর থেকে, তখন তাই ছিল। ফ্রস্টবাইটের সম্ভাবনা প্রবল। আমি তবুও হেঁটে চলেছি মেরুজ্যোতি দেখার উদ্যেশ্যে। নিজের মনকে শুধু সান্তনা দিয়ে চলেছি যে, সব জায়গা ঢাকা থাকলে ফ্রস্টবাইট হয় না।—চলবে।
ছবি: অঙ্কনা চৌধুরী
ছবি: অঙ্কনা চৌধুরী
* রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা (Mysterious Alaska) : ড. অর্ঘ্যকুসুম দাস (Arghya Kusum Das) অধ্যাপক ও গবেষক, কম্পিউটার সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস।