শুক্রবার ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


আগেই বলেছি, গোটা ফেয়ারব্যাঙ্কস শহরের জনঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে মাত্র ৩২০ যেখানে কলকাতায় প্রতি বর্গ কিলোমিটারে চব্বিশহাজারেরও বেশি লোক বসবাস করে। অর্থাৎ ফেয়ারব্যাঙ্কসের তুলনাল কলকাতার জনঘনত্ব প্রায় ৮০ গুন বেশি। আলাস্কার সবচাইতে বেশি জনপূর্ণ শহরগুলির মধ্যে একটি ফেয়ারব্যাঙ্কস। জনসংখ্যার ভিত্তিতে এর স্থান অ্যাঙ্করেজ-এর পরেই। তাই আরেকটা উদাহরণ দিলে সামগ্রিক ভাবে আলাস্কার চরমভাবাপন্ন অবস্থাটা আরও পরিষ্কার হবে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রফল ৩৪ হাজার বর্গমাইল, যেখানে আলাস্কার ক্ষেত্ৰফল প্রায় ৬.৫ লক্ষ বর্গমাইল। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা প্রায় ১০.৫ কোটি, যেখানে আলাস্কার জনসংখ্যা মাত্র ৭.৫ লক্ষ। অর্থাৎ আলাস্কা পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় পরিমাপের নিরিখে প্রায় ৫ গুণ বড় অন্যদিকে আলাস্কার জনসংখ্যা পশ্চিমবঙ্গের ১৪২ ভাগের চেয়েও কম।
মানে, মোটের ওপর শীতকাল মানে শুধুই ‘এই রাত তোমার আমার’, ‘ওই চাঁদ তোমার আমার’, আর আক্ষরিক অর্থেই ‘শুধু দু’ জনে’। তার ওপরে শহরের বাইরে বেশি যাওয়া যায় না গাড়ির রাস্তা খারাপ থাকার কারণে। অর্থাৎ ঘরে থাকার মধ্যেই নিজেকে অভ্যস্থ করে তুলতে হবে।

ওরই মধ্যে আছে আরও কয়েক ঘর ভারতীয় আর বাংলাদেশী একে ওপরের সুখ দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার জন্য। সবাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেই যুক্ত। কেউ এখানে স্নাতকোত্তর গবেষণারত, আর কেউবা আমারই মতো অধ্যাপক। সবারই মানসিকতা প্রায় একই রকম। সবাই দেশ স্বজন পরিজন ছেড়ে এসে আছে, মন খারাপ হয় মাঝে মাঝেই। কিন্তু তবুও কোনও এক অদ্ভুত আকর্ষণে সবাই পড়ে আছে এখানে। অ্যাডভেঞ্চারের নেশা।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-১৫: ফেয়ারব্যাঙ্কসের তুলনাল কলকাতার জনঘনত্ব প্রায় ৮০ গুণ বেশি!

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৮: কোন অজানায় ‘পথে হল দেরী’

সেই আদি কালের রেডইন্ডিয়ানদের অভিপ্রয়াণ (মাইগ্রেশন) থেকে শুরু করে সত্তরের দশকে মার্কিন অভিযাত্রী ক্রিস্টোফার ম্যাকক্যান্ডেলসের মৃত্যু পেরিয়ে এর মাদকতা এসে কিছুটা হলেও ঢুকে পড়েছে আমাদের মধ্যেও। এত প্রতিকূলতা, এত বিপদ, মানসিক অবসাদের আশঙ্কা, ক্ষেত্রবিশেষে প্রাণহানিরও আশঙ্কা, তবুও কেন জানি না এর প্রতি এতো মোহো। মাঝেমাঝে নিজেকে মনে হয় মর্ষকামী (ম্যাসোচিস্ট) বা আত্মনিগ্রহকারী, যে কিনা নিজেকে দুঃখ দিয়ে খুশি থাকে। আবার পরমুহূর্তেই মনে হয় এই তো জীবন। দুঃখ-বিপদ তুচ্ছ করে বেরিয়ে পড়ার মতো আনন্দ কি আর কিছুতে আছে।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৯: সুন্দরবনের জনপ্রিয়তম পীর—পীর গোরাচাঁদ

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪১: চোখ ঠিক রাখতে মাছের মুড়ো?

সে যাই হোক, এমনই একদিন দুঃখ-বিপদ তুচ্ছ করে বেরোতে গিয়ে সে এক ভয়ঙ্কর অবস্থা। কোনও রকমে প্রাণে বেঁচে ফিরেছি। তখন সবে সবে এসেছি। মাস খানেক হয়েছে। এসে দিন থেকে তুষার ঝড়ের কারণে মেরুজ্যোতি তো দূর অস্ত আকাশে কোনও জ্যোতিই দেখা যাচ্ছে না। ওরই মধ্যে একদিন দেখলাম পরিষ্কার আকাশ। আর সেদিন অরোরা বা মেরুজ্যোতি দেখা যাবে। মনে মনে ভাবলাম, আজ দেখতেই হবে। ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে খবর পেলাম যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ প্রান্তে বেশ কয়েকটা স্কি-করার ট্রেইল আছে। সেখান থেকে দেখা যায় অরোরা।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৭: তীর্থদর্শন

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫২: বইয়ের সব কপি কবির নির্দেশে বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল

এ বার আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান সম্পর্কে একটু বলে নিই। আমার বাড়ি থেকে ৩-মাইল মতো পশ্চিমে ইউনিভার্সিটি অফ আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস। বিশ্ববিদ্যালয়টি একটি ছোট পাহাড়ের ঢাল বরাবর উঠে গিয়েছে নিচ থেকে ওপরে। ভূগোলের পরিভাষায় এইরকম সরু ছোট পাহাড়কে বলা হয় ‘রিজ’। আর এই রিজটির নাম ‘ট্রথইয়েদ্ধা’। আর সেই সূত্রে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এই পরিসরটিকে বলা হয় ইউনিভার্সিটি অফ আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস (বা সংক্ষেপে ইউএএফ), ট্রথইয়েদ্ধা ক্যাম্পাস।
আথাবাস্কান এস্কিমো বা ইন্টেরিয়র আলাস্কা নেটিভ অর্থাৎ আলাস্কান প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চল থেকে অনেকটা ভিতরের দিকে আর্কটিক বৃত্তের কাছাকাছি (ফেয়ারব্যাঙ্কস এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকায়) যে সমস্ত আলাস্কান উপজাতিরা থাকতো, তাদের ভাষায় ‘ট্রথ’ শব্দের অর্থ ‘পটেটো’ বা ‘আলু’ আর ‘ইয়েদ্ধা’ শব্দের অর্থ ‘রিজ’ বা ‘খাঁজ’। অর্থাৎ কিনা ‘পটেটো-রিজ’। সম্ভবত আদিকালে কখনও হয়তো এখানে আলুর চাষ হতো। এবং সেই থেকেই এই নাম হয়েছে।—চলবে।

ছবি: অঙ্কনা চৌধুরী
* রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা (Mysterious Alaska) : ড. অর্ঘ্যকুসুম দাস (Arghya Kusum Das) অধ্যাপক ও গবেষক, কম্পিউটার সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস।

Skip to content