ও রজনীগন্ধা তোমার গন্ধসুধা ঢালো।।
পাগল হাওয়া বুঝতে নারে, ডাক পড়েছে কোথায় তারে,
ফুলের বনে যার পাশে যায় তারেই লাগে ভালো।।
সাদা রজনীগন্ধা এই চরম শীতের দেশে বাড়ন্ত; তবে কবিগুরু, যিনি ছোটবেলা থেকেই দুপুর বেলায় রাত্রি কল্পনা করতে শিখিয়েছেন তাঁর কবিতায়; তাঁর ভক্ত হিসাবে সাদা বরফে সাদা রজনীগন্ধা কল্পনা করতে আমার বিশেষ অসুবিধা হয় না। আর চাঁদের আলো এখানে সত্যিই বাঁধ ভেঙে যায়। উচ্চ অক্ষাংশে (Higher latitude) চাঁদ এখানে ওঠে একদম দিগন্তের পার থেকে; ক্রান্তীয় অঞ্চলের চাইতে অনেএএএকটা বড় হয়ে।
আর পূর্ণিমার রাতে সাদা বরফে মাখামাখি হয়ে সেই হাসি ঝরে পড়ে সারা রাজ্যে। চিরহরিৎ হেমলকের গহন বনাঞ্চল, পাতাঝরা এস্পেনের পাঁজর ফাটানো হাসি, বরফে ঢেকে যাওয়া ছোট্ট শহর, জমে যাওয়া ছোট নদী, পাহাড়, পর্বত, সবকিছু অতিক্রম করে পাগল হাওয়ার সঙ্গে সে পাড়ি জমায় দুউউউর থেকে দুউউউউউরে।
আরও পড়ুন:
রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-১৩: এখানকার একমাত্র ভারতীয় রেস্তরাঁর মালিকও বাঙালি
চলো যাই ঘুরে আসি, অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পের পথে, পর্ব-২: দু’ চোখ ভরে স্বপ্ন পূরণের আনন্দাশ্রু, অদূরেই যে অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প!
তবে বছরের প্রায় ৪-৫ মাস সারাদিনের প্রায় ২৪ ঘণ্টা ধরে এহেন চাঁদের হাসি দেখলে কিরকম লাগবে তার ঠাহর করা কবিগুরুর পক্ষেও একটু কষ্টসাধ্য। কিছু ক্ষেত্রে সেই পরিস্থিতি বেশ কঠিন, অন্তত যারা সদ্য সদ্য সাধারণ সমান-সমান দিন-রাত অর্থাৎ ১২ ঘণ্টা দিন ১২ ঘণ্টা রাতের একটা গোটা পৃথিবী ছেড়ে এখানে বসবাস করতে এসেছে।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৫: উদ্যানবাটিতে সারদা মায়ের ঠাকুরের শুশ্রূষা
শ্রীরামকৃষ্ণের প্রিয় শিষ্যের দর্শন তো রোজ পাওয়া যাবে না/২
এই পর্বে শীতকালের সেই প্রতিরাতের কথাই বলবো। তীব্র শীত, মাসের পর মাস শুধু অন্ধকার, তার মধ্যে কেমন ভাবে চলে এখানকার আমাদের জীবন সেসব কথাই বলবো এই পর্বে। সঙ্গে অবশ্যই থাকবে আমার কিছু সুস্থ শরীরকে ব্যস্ত করার কিছু উটকো অভিজ্ঞতার কথা যা কিনা সকলের না করলেও চলে।
তবে শীতের গল্প শুরু করি আমার স্ত্রী এর আলাস্কায় এসে পৌঁছনো দিয়ে। কারণ সে সরাসরি কলকাতা থেকে আলাস্কায় এসে পৌঁছেছে একদম ধনাত্মক (+) ৩০ থেকে ঋণাত্মক (-) ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে শীতকালের ঠিক শুরুর দিকে। অতয়েব তার অভিজ্ঞতার সঙ্গে সকলের নিজেকে মেলাতে সুবিধা হবে।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৬: ভয়ের না ‘অভয়ের বিয়ে’
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৬: স্বপ্নে আমার মনে হল
এরই মাঝে আমার কথা একটু বলে নিই। আমি ইতিমধ্যেই আলাস্কায় প্রায় একবছর পূর্ণ করার দোরগোড়ায়। মাঝে গ্রীষ্ম কালে মে-জুন-জুলাই মাসে একবার দেশে গিয়ে বিয়ে করে এসেছি। কোভিড-পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্রীয় অভিবাসনের স্থগিতাবস্থা এবং সমস্ত প্রক্রিয়াগত বিলম্বের কারণে আমার স্ত্রীয়ের সব কিছু সারতে সারতে হয়ে গেলো অক্টোবরের মাঝামাঝি। তারপর সকলের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ সারতে লাগলো আরো একমাস। সব সেরে যখন সে এখানে এসে পৌঁছলো সেদিন নভেম্বরের ৩০। বাইরে তাপমাত্রাও তখন প্রায় ঋণাত্মক মাত্রায় প্রায় ওই রকমই অর্থাৎ -৩০।
সস্ত্রীক লেখক।
আমি গিয়েছি গাড়ি নিয়ে তাকে আনতে বিমান বন্দরে। মনে ভয়, কি না কি হয় এই তাপমাত্রার পার্থক্যে। আমার স্ত্রী আবার প্রচলিত অর্থে একটু শীতকাতুরে। তাই মনে আরও ভয়। কি না কি ভাবে সে প্রতিক্রিয়া জানায়। হয়তো প্রথমে নেমেই বলে বসলো এই ঠান্ডায় থাকা যাবে না। কিন্তু মুশকিল আসান হয়েছিল আগে থেকেই। প্রথম দিন থেকেই তাকে আমি সবচাইতে খারাপ অভিজ্ঞতাগুলো বলে রেখেছিলাম। এখানে একটা মজার ব্যাপার হয়েছিল। একদিন আমার নতুন বিয়ে নিয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালরের ডিন-মহাশয়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। স্ত্রী শীতকালে আসছে শুনে ডিন আমাকে বলেছিলেন যে স্ত্রীকে বলো না যে ফেয়ারব্যাঙ্কস কোনও সিটি বা বড় শহর; বরং তাকে বলো যে এটা একটা কম্যুনিটি। আমি মনে মনে ভাবলাম, সে আর বলতে। আমি প্রথম থেকে তাই বলে রেখেছি। যাতে প্রত্যাশা একদম বেশি না থাকে।—চলবে।
ছবি: লেখক
ছবি: লেখক
* রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা (Mysterious Alaska) : ড. অর্ঘ্যকুসুম দাস (Arghya Kusum Das) অধ্যাপক ও গবেষক, কম্পিউটার সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস।