তবে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল তখন। প্রকৃতির ওপরে ঈশ্বরের হাত না থাকলেও মানুষের ওপর যে তাঁর হাত সর্বদাই থাকে তার প্রমাণ পাওয়া গেলো। এ ভাবে পনেরো কুড়ি মিনিট বসে থাকার পর হঠাৎ গাড়ির আয়নায় দেখি পেছন থেকে আরেকটি গাড়ি আসছে। তার আলোতেই আমি আবার আশার আলো দেখলাম। কোনওরকমে জুতো আর টুপিটা আধখানা গলিয়ে দস্তানাটা হাতে পরতে পরতেই নিচে এসে দাঁড়িয়ে তাকে হাত দেখাতে লাগলাম সাহায্যের জন্য। অবশ্য দাঁড়ানোর পরে সে বলল যে সে নিজে থেকেই থামার উপক্রম করছিল আমার গাড়িটি দেখে। কারণ এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন কম বেশি সবাইকেই এখানে কখনও না কখনও হতে হয় আর সেই সময় সবাই সবাইকে সাহায্য করেই থাকে।
মনে মনে ভাবলাম যে তুমি আমার ঈশ্বরের দূত। তার নাম ডেল। সে বিমানবন্দরে কাজ করে। এই পথে বাড়ি ফেরে। সে এসে আমার চাকার চারিদিক দেখে বলল যে, আর পরিষ্কার করার কিছু নেই। যেহেতু আমার স্নো টায়ার নয় তাই মুশকিল হচ্ছে। সে সব দিক দেখে আমাকে বলল যে, যেহেতু সামনের দিকের চাকাটি একটু বেশি বরফের তলায় চলে গিয়েছে কাজেই গাড়িটা পিছন দিকেই নিয়ে যেতে হবে বের করার জন্য। আমি বললাম যে, সে চেষ্টা করেছি আগেই কিন্তু কিছু হচ্ছে না। তখন সে আমাকে বলল যে, সে সামনে দিক থেকে গাড়িটাকে ঠেলবে আর আমি যেন গাড়িটাকে পেছনে বাঁ-দিক করে মানে রাস্তার দিকে করে বের করি। সোজা করে পিছিয়ে গেলে আবার ওই রাস্তার ধার বরাবর পিছিয়ে গিয়ে বেশি বরফে ঢুকে আগের মতোই পরিস্থিতি হয়ে যাবে।
আরও পড়ুন:
পর্ব-৯: আগে তো প্রাণে বাঁচি, তার পরে না হয় বিমার নিয়ম কানুনের কথা ভাবা যাবে
জ্যোতির্লিঙ্গ যাত্রাপথে, পর্ব-৪: কাশীর পথে-ঘাটে
চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১০: স্থাপত্য ছাড়িয়ে অভয়ারণ্য
ঠেলাঠেলি করে যদি কিছু না হয় তাহলে সে তার গাড়ির সঙ্গে আমার গাড়ি বেঁধে টেনে তুলবে। সেই ঠিক হল। ডেল সামনের দিকে গিয়ে নিজের সর্ব শক্তি দিয়ে গাড়িটা ঠেললো ওই বরফের ওপর দাঁড়িয়েই। আর আমি একটু বাঁ দিকে কাটিয়ে কোনও রকমে রাস্তার ওপরে চাকাটি তুলতে পারলাম। একবার পেছনের চাকাটা রাস্তায় একটু উঠতে সামনের চাকাটিও বেরিয়ে এলো। আমি গাড়িটাকে সোজা রাস্তায় উঠিয়ে ডেলকে ধন্যবাদ জানানোর উদ্যেশ্যে একবার গাড়িটি আস্তে করে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু সে দেখি তখন চেঁচাচ্ছে আর বলছে যে যেন আর না দাঁড়াই তাহলে আবার পিছলে ঢুকে যেতে পারে। আমার ও সঙ্গে সঙ্গেই মনে হল যে।
আরও পড়ুন:
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩৮: ভরত কি ফিরবে শূন্য হাতে?
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১: আর্ষ মহাকাব্যের স্রষ্টাদ্বয়ের কথা
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৫: নৌকো উল্টে সত্যেন্দ্রনাথের আইসিএস পড়তে যাওয়া বানচাল হতে বসেছিল
সত্যিই তো, আমার স্নো টায়ার নেই। তাই চাকায় বলপ্রয়োগ না করলে সত্যিই পিছলে যেতে পারে আবার। আর রাস্তাটায় সামান্য ঢালও আছে। আমি আর ভয় পেয়ে দাঁড়ালাম না। শুধু ওই ধীরে ধীরে চলতে চলতেই তাকে চেঁচিয়ে দু’ বার ধন্যবাদ জানালাম। দাঁড়াতে পারলে ইচ্ছা ছিল এই লোকটির সঙ্গে একটি নিজস্বী তোলার। আমার রক্ষাকর্তা। আবার পরক্ষনেই মনে হল যে, ঈশ্বরের দূতেদের ছবি কখনও তোলা যায় না। সেই যেমন সব কাল্পনিক ছায়াছবিতে দেখা যায়। রক্তমাংসের পৃথিবীতে এটাই বোধায় তাদের উপায় ক্যামেরাবন্দী না হওয়ার। কাজেই সে নিয়ে আর বেশি আফসোস করলাম না। পথ ধরলাম ওই চাইনিজ রেস্তরাঁর।
আরও পড়ুন:
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২: ‘আও টুইস্ট করে’ গানের জন্য পঞ্চমের সঙ্গে শচীনকর্তার বাক্যালাপও বন্ধ ছিল বেশ কিছুদিন
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৭: আপন হতে আপন জন ‘রাইকমল’
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৫: কালাদেওর কিস্সা
ডেলের কথা মতো ডানদিকের রাস্তা আর বাঁ দিকের রাস্তার বিচার আর না করে চালালাম একদম মাঝ বরাবর গাড়ি। আরও এক দেড় মাইল, কেউ কোত্থাও নেই আর। রেস্তোরাঁয় যখন পৌঁছলাম তখন তাদের প্রায় বন্ধ করার সময়। খাবার বলা ছিল আগেই। তুলে নিলাম। এবার আবার ফেরার পালা। মনে মনে ভগবানকে একবার ডেকে নিয়ে আবার চালালাম। সৌভাগ্যবশত ফেরার পথে আর সেরকম কিছু হয়নি।
শুধু আসার পথে মনে মনে একবার ভাবলাম কীভাবে দিন শুরু হয়েছিল আর শেষ কীভাবে হচ্ছে। শুরু হয়েছিল শিকাগোর ব্যস্ত শহর, বিমান বন্দর থেকে, সেখান থেকে উড়ানপথে এঙ্করেজ, সেখান থেকে আবার উড়ানে চেপে ফেয়ারব্যাঙ্কস। আর আর সব শেষে তুষারাবৃত এই জঙ্গল। ব্যস্ত একটা গোটা পৃথিবী ছাড়িয়ে কীভাবে যেন চলে এলাম উত্তরমেরুর কাছে জনমানবহীন এই জঙ্গলে যেখানে এখন শুধুই রাত। নিজেকে ঠিক যেন মনে হচ্ছিল জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘গেম অফ থ্রোন্স’-এর ‘জন স্নো’-এর মতো। ড্রাগনের পিঠে চেপে ‘কিংস ল্যান্ডিং’-এর ব্যস্ত শহর থেকে শীতল উইন্টারফেল রাজ্য পেরিয়ে আরওওওও অনেএএএএক উত্তরে এসে পৌঁছলাম ‘দা ওয়াল’-এ, যার পরেই শুরু ‘নাইট কিং’-এর রাজ্যপাট।
ছবি: লেখক
ছবি: লেখক
* রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা (Mysterious Alaska) : ড. অর্ঘ্যকুসুম দাস (Arghya Kusum Das) অধ্যাপক ও গবেষক, কম্পিউটার সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস।
বাইরে দূরে
লেখা পাঠানোর নিয়ম: এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। লেখার সঙ্গে বেশ কিছু ছবি পাঠাতে হবে। চাইলে ভিডিও ক্লিপও পাঠাতে পারেন। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com