মা সারদা।
সময়টা ছিল স্বাধীনতাসংগ্রামের যুগ। বিট্রিশ সরকার বিপ্লবীদের দমনের জন্য অকথ্য অত্যাচার শুরু করে যাতে লোকের মনে ভীতির সঞ্চার হয়। তখন চারদিকে কড়া নজর রাখা হচ্ছে। এমনকি, রামকৃষ্ণমঠ মিশনের সন্ন্যাসীদেরও সন্দেহভাজন বলে মনে করা হচ্ছে। আর যুবক বিপ্লবীরা অনেকেই শ্রীমার কাছে দীক্ষিত। তাই জয়রামবাটি, কোয়ালপাড়ায় পুলিশের সদা সতর্ক দৃষ্টি ছিল। এই অঞ্চল তখন ম্যালেরিয়াপ্রবণ এবং অশিক্ষিত গরীব মানুষের বাসভূমি ছিল। সেই কারণে সুস্থসবল বিপ্লবী যুবকদের এখানে এনে আটকে রেখে সরকার তাদের শায়েস্তা করার ব্যবস্থা করে। তাই এই জায়গার প্রায় প্রতি থানাতেই এরকম অন্তরীণ যুবকদের দেখা যেত। এদের মধ্যে শ্রীমার অনেক দীক্ষিত সন্তানও ছিল। মা সারদার মন তাই সদা উৎকণ্ঠিত থাকত।
শ্রীমার সন্তানদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁকে চিঠি লিখতেন। সেসব চিঠিতে পুলিশের ছাপ দেখে তিনি চিনেছিলেন। এইরকম চিঠি পেলেই শ্রীমা সজল চোখে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতেন সেই পুলিশছাপের দিকে। কখনও কখনও দু’একটি বাক্যে তাঁর মনের ব্যথা বেরিয়ে পড়ত। কখনও ভক্তদের চিঠিতে মা সারদার কাছে সমাধানের আশায় সমস্যার কথাও লেখা থাকত। যেমন শ্রীমার একজন মহিলা ভক্ত তাঁকে লিখেছেন যে, তার স্বামীর আর সংসার করতে ভাল লাগছে না। তাই ছোট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তাকে বাপের বাড়ি পাঠাতে চান। কারণ, তিনি সংসার ছেড়ে সাধু হবেন বলে স্থির করেছেন।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭২: উদ্বোধনে মা সারদার ভক্তদের কথা
অভিজ্ঞান-শকুন্তলের নাট্যকার কালিদাস/১
চিঠি পেয়ে শ্রীমা দুঃখে অধীর হয়ে উঠলেন। বললেন, ‘দেখ, দিকিন, কি অন্যায়, সে বেচারি অল্পবয়সের মেয়ে, এই কাচ্চা-বাচ্চা নিয়ে এখন কোথায় যায়, কি করে?’ তারপর দৃঢ়ভাবে বলে লেখালেন,’ লিখে দাও তাকে এখন সংসার ছাড়তে নিষেধ করে। আগে ছেলেপিলেদের মানুষ করুক। টাকা পয়সা রোজগার করে তাদের খাওয়া থাকার সুব্যবস্থা করুক। তারপরে তখন দেখা যাবে’। এইভাবে তিনি ভক্তের সমস্যার সমাধান করে দিতেন। তাঁর আর একজন ভক্ত লিখেছেন যে, তিনি যে চাকরি করেন, তাতে তাকে সময় সময় মিথ্যা বলতে হয়। তাই তিনি চাকরি ছেড়ে দিতে চাইছেন, তবে সংসারে আর্থিক অসচ্ছলতার জন্য পারছেন না। ভরণপোষণের আর কোন উপায় না দেখে সে কি করবে বুঝে উঠতে না পেরে শ্রীমাকে লিখে পাঠিয়েছে।
মা সারদা চিঠির কথা শুনে একটু চিন্তিত হয়ে ভাবলেন। তারপর লেখালেন, ‘তাকে লিখে দাও চাকরি না ছাড়তে’। অল্পবয়সী লেখক ভাবছে যে মা সারদা এমন কেন লেখালেন, ভক্ত তো ভাল পথেই চলতে চায়। সে লিখতে ইতস্তত করছে দেখে শ্রীমা তাকে বুঝিয়ে বললেন, ‘আজ একটু সামান্য মিথ্যা কথা বলতে ভয় পাচ্ছে, কিন্তু চাকরি ছেড়ে অভাবে পড়ে যখন স্বভাব নষ্ট হবে, তখন চুরি, ডাকাতি পর্যন্ত করতে ভয় পাবে না’।
মা সারদা চিঠির কথা শুনে একটু চিন্তিত হয়ে ভাবলেন। তারপর লেখালেন, ‘তাকে লিখে দাও চাকরি না ছাড়তে’। অল্পবয়সী লেখক ভাবছে যে মা সারদা এমন কেন লেখালেন, ভক্ত তো ভাল পথেই চলতে চায়। সে লিখতে ইতস্তত করছে দেখে শ্রীমা তাকে বুঝিয়ে বললেন, ‘আজ একটু সামান্য মিথ্যা কথা বলতে ভয় পাচ্ছে, কিন্তু চাকরি ছেড়ে অভাবে পড়ে যখন স্বভাব নষ্ট হবে, তখন চুরি, ডাকাতি পর্যন্ত করতে ভয় পাবে না’।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৯: ভ্রমণে বেরিয়ে মহর্ষি পেয়েছিলেন পুত্রের মৃত্যু-সংবাদ
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৪ : অকারণে কেউ অন্যের ভালো করতে যায় না
একথা বলে ‘অভাবে পড়লে’ কথাটা তিনি দু-তিনবার খেদ করে বললেন। তখন লেখক শ্রীমার দূরদৃষ্টি আর সন্তানকে রক্ষা করার আগ্রহ দেখে অবাক হল। শ্রীমার অন্য এক ভক্ত তাঁকে লিখেছেন যে, তাদের বাড়িতে শ্রীশ্রীঠাকুর ও মা সারদার একটি ছবি আসনে ছিল। তাতে ছেলেমেয়েরা নিত্যপূজা, ভোগ ও আরতি করে।
একদিন সন্ধ্যার সময় ছোটমেয়ে আরতি করে অসাবধানে কাঠের সিংহাসনের নিচে ধুনুচি রেখেছিল। তার ফলে কাপড়ে আগুন লেগে আসনসহ ছবিখানি ভস্মীভূত হয়ে যায়। তারা অতিশয় ভয় পেয়ে শ্রীমাকে চিঠিতে তাঁর কৃপাশীর্বাদ প্রার্থনা করেন। এই ঘটনা জেনে মা সারদা খুব চিন্তিত ও দুঃখিত হলেন। তারপর বললেন, ‘এসব পুজো, আরতি বড় কঠিন ব্যাপার, খুব সাবধানে করতে হয়। এ সকল ব্যাপার মঠে, আশ্রমেই সাজে, না হলে আমি কি আর পারি না সন্ধ্যেবেলা একটু ধূপধুনো ঘুরিয়ে দিতে’। বারবার তিনি এই দুর্ঘটনার জন্য আপশোস করে তাদের অভয়দান ও আশীর্বাদ জানিয়ে ভবিষ্যতে সাবধান থাকার জন্য লিখে দিতে বলেন।
একদিন সন্ধ্যার সময় ছোটমেয়ে আরতি করে অসাবধানে কাঠের সিংহাসনের নিচে ধুনুচি রেখেছিল। তার ফলে কাপড়ে আগুন লেগে আসনসহ ছবিখানি ভস্মীভূত হয়ে যায়। তারা অতিশয় ভয় পেয়ে শ্রীমাকে চিঠিতে তাঁর কৃপাশীর্বাদ প্রার্থনা করেন। এই ঘটনা জেনে মা সারদা খুব চিন্তিত ও দুঃখিত হলেন। তারপর বললেন, ‘এসব পুজো, আরতি বড় কঠিন ব্যাপার, খুব সাবধানে করতে হয়। এ সকল ব্যাপার মঠে, আশ্রমেই সাজে, না হলে আমি কি আর পারি না সন্ধ্যেবেলা একটু ধূপধুনো ঘুরিয়ে দিতে’। বারবার তিনি এই দুর্ঘটনার জন্য আপশোস করে তাদের অভয়দান ও আশীর্বাদ জানিয়ে ভবিষ্যতে সাবধান থাকার জন্য লিখে দিতে বলেন।
আরও পড়ুন:
ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৩৮: পুত্র বীরেন্দ্রর বিয়েতে রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ জানান মহারাজ রাধাকিশোর
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’
গৃহী ভক্তদের সংসারে অমনোযোগ ও বিশৃঙ্খলা মা সারদা পছন্দ করতেন না। ভগবানের সংসারে আমাদের তিনি যে কাজে লাগিয়েছেন, তাঁর উপর নির্ভর করে যথাসাধ্য তা সুসম্পন্ন করার জন্য সর্বদা চেষ্টা করা দরকার। শ্রীমার সকল সন্তানকে এটাই ছিল তাঁর শিক্ষা। ভক্তদের তিনি উপদেশ দিতেন, ‘দুঃখকষ্ট হয়, ঠাকুরকে ডাকো, তিনিই সব দেখিয়ে দেবেন’। যারা নিজেদের কর্তব্য পালন করতে বিমুখ হত,তাদের বিষয়ে দুঃখ করে শ্রীমা বলতেন, ‘ঠাকুর , যাঁর পরনের কাপড় ঠিক থাকত না, সেই তাঁরই আমার জন্য কত চিন্তা ছিল’। শ্রীমার জন্য সংসারী না হয়েও ঠাকুরের খুব ভাবনা ছিল।
আরও পড়ুন:
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮৯: মাথার কান
দশভুজা, দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৪: আনন্দী—এক লড়াইয়ের নাম
মা সারদা কোথায় থাকবেন, কিভাবে তাঁর খাওয়া-পরা চলবে, এই নিয়ে চিন্তিত হয়ে ঠাকুর তাঁর বিশেষ ভক্তদের জিজ্ঞাসা করতেন, ‘হ্যাঁগা, ছ-সাতশ টাকা হলে একজন মেয়েমানুষের পাড়াগাঁয়ে থাকা চলে?’ মা সারদা বলেছেন যে, ঠাকুর সেজন্য কিছু টাকা জোগাড় করে দিয়েছিলেন। তিনি শ্রীমাকে একদিন জিজ্ঞাসা করেন, ‘হ্যাঁগা, টাকা কোথায় রেখেছ?’ শ্রীমা বলেন, ‘মশলার হাঁড়িতে’। শুনে ঠাকুর ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘টাকা, ওইভাবে রাখে?’ পরবর্তী কালে সেই টাকা বলরাম বসুর জমিদারির সেরেস্তায় জমা করা হয়। মাসে মাসে শ্রীমাকে সেই টাকার জন্য পরে ছ’টাকা করে সুদ হিসেবে দেওয়া হত। এই বিষয়ে শ্রীমার জন্য ঠাকুরের ভাবনার কথা উল্লেখ করে তিনি হেসে বলতেন, ‘এখন দেখো, তাঁর ইচ্ছায় কত টাকা আসছে আর যাচ্ছে’।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।