বুধবার ৩ জুলাই, ২০২৪


সিদ্ধনাথ শিব টেরাকোটা মন্দির। পাশে সর্পশোভিত গৌরিপট্ট-সহ সিদ্ধনাথ শিবলিঙ্গ।

কোচবিহারের আরেকটি বিখ্যাত টেরাকোটার শিবমন্দির হল সিদ্ধনাথ শিব মন্দির। এটি কোচবিহার শহর থেকে মাত্র ৬.৫ কিলোমিটার দূরে কোচবিহার-দিনহাটা প্রধান সড়কের মধ্যবর্তী ধলুয়াবাড়িতে অবস্থিত। ধলুয়াবাড়ি ছিল কোচ রাজাদের পূর্বেকার রাজধানী। এই সৌধটি কোচ রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মীত হয়। কিন্তু মূল বিতর্কিত বিষয় হল, কার সময়কালে এই অনুপম স্থাপত্যের নির্মাণ হয়।

এমএস বৎস (এএসআই অধিকর্তা ১৯৫০-১৯৫৪)-এর মতে, এই দেবায়তনটি কোচ মহারাজা উপেন্দ্রনারায়ণের আমলে (১৭১৪-১৭৬৩ সালে) নির্মীত হয়েছিল। যদিও হরেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর মত আবার, এটির নির্মাণ সর্বপ্রথম শুরু হয়েছিল কোচ মহারাজা হরেন্দ্রনারায়ণের আমলে (১৭৮৩-১৮৩৯ সালে)। অবশ্য সমগ্র প্রক্রিয়াটি পূর্ণতা পায় তাঁর পুত্র শিবেন্দ্রনারায়ণের সময়ে (১৮৩৯-১৮৪৭ সালে)। মন্দিরের নির্মাণকর্ম সমাপ্ত হওয়ার পর এক রাজকীয় যাগযজ্ঞাদি পর্ব অন্তে সিদ্ধনাথ শিবলিঙ্গ মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। জয়নাথ মুন্সীর সুবিখ্যাত রাজোপাখ্যান গ্রন্থেও মন্দর প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত একই বিবরণ পাওয়া যায়।
মন্দির সম্পর্কিত আরেকটি বিতর্কিত বিষয় হল, এর গঠনশৈলীকেন্দ্রীক। বিশেষজ্ঞ তথা গবেষকমহলে এ নিয়ে প্রচুর মতভেদ রয়েছে। এমএস বৎসের মতে, মন্দিরস্থাপত্যটি দক্ষিণবঙ্গের বরাকরের বেগুনিয়া মন্দিরশৈলীর অনুরূপ। অবশ্য অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে, এটি কোচ স্থাপত্যের পঞ্চরত্ন শৈলীর মন্দিরের এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। যদিও এর মূল রত্ন অনুপস্থিত। বুকানন হ্যামিল্টনও নিজ সমীক্ষা চলাকালীন ১৮০৯ সালে নাগাদ তা অনুপস্থিত বলেই মন্তব্য করেছেন। আবার কিছু গবেষকের মতানুযায়ী, সৌধটি চতুর্ভুজাকার স্থাপত্যের এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ, যা শীর্ষদেশের চার কোণে চার রত্ন দ্বারা শোভিত বাস্তুশাস্ত্রে উল্লেখিত সর্বতোভদ্র মন্দিরশৈলীর এক গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ।
আরও পড়ুন:

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-৭: ফলনাপুর মদনমোহন মন্দির কোচ স্থাপত্যের দ্বিতল পঞ্চরত্ন মন্দিরের একমাত্র নিদর্শন

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৫: সুন্দরবনের বিসূচিকা রোগের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ওলাবিবি

প্রায় একই ধরনের শৈলী অসমের সুবিখ্যাত কামাক্ষ্যা মন্দিরপ্রাঙ্গণে অবস্থিত একটি কালী মন্দিরেও লক্ষিত হয়। আমার সংগৃহীত তথ্য ও পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সৌধটি এই অঞ্চলে বাংলার মন্দির স্থাপত্যের পুনরুজ্জীবন পর্বে উদ্ভূত দুই বিখ্যাত শৈলীর (চালা ও রত্ন) এক অপূর্ব মেলবন্ধনের প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্তরূপে বিবেচিত। এখানে বাংলার চিরায়ত চারচালা শৈলী শীর্ষে একাধিক রত্নদ্বারা শোভিত, যা কোচ স্থাপত্যের বিমিশ্র শৈলীগত রূপটিকে প্রকটিত করে। নিঃসন্দেহে এই দেবায়তনটি ইন্দো-ইসলামিক স্থাপত্যশৈলীর এক গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ, যা প্রতিফলিত হয়েছে আরেকটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য স্থাপত্যবৈশিষ্ট্যের মিহরাব-এর উপস্থিতির (প্রায় ৭.৫ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট) মাধ্যমে, যা ফলনাপুর মদনমোহন মন্দিরের ন্যায় গর্ভগৃহের উত্তরমুখী দেওয়ালগাত্রে লক্ষিত হয়।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৮: চল্লিশ পার হলেই নিরামিষ?

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৮: আমি শুনি গো শুনি তোমারে…

গর্ভগৃহে প্রতিষ্ঠিত প্রায় ৪.৫ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট সর্পশোভিত গৌরিপট্ট-সহ শিবলিঙ্গটিই প্রচলিতভাবে সিদ্ধনাথ শিব নামে নামে খ্যাত ও পূজিত। দক্ষিণমুখী এই দেবায়তনটি প্রায় ২৫ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট ও দেওয়ালের পুরূত্ব প্রায় ২ফুট। মন্দিরের দুটি প্রবেশদ্বার, যার মধ্যে দক্ষিণমুখী দ্বারটিই প্রধানদ্বাররূপে বিবেচিত। দুটি প্রবেশদ্বারের উপরের অংশটি অনন্যতায় দৃষ্টিআকর্ষণকারী। কারণ এটি বাংলার সুবিখ্যাত চালাঘরের অলঙ্করণযুক্ত। সৌধটির নির্মাণে ক্ষুদ্রাকারে সংগঠিত পুরনো ইষ্টকগুলি মূল উপাদানরূপে ব্যবহৃত হয়েছে।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৩০: আ দেখে জারা কিসমে কিতনা হ্যায় দম… এই গানে পঞ্চমের বাজি ছিলেন কিশোর ও আশা

পরিযায়ী মন, পর্ব-৭: ভিস্তা ডোমে তিস্তার দেশে

দেবায়তনটির অনন্যতার অন্যতম পরিচায়ক হল এর অসম্ভব সুন্দর টেরাকোটা ফলক, যা এই অঞ্চলের তথা কোচ স্থাপত্যে অতিবিরল দৃষ্টান্তরূপে পরিগণিত। মূলত মন্দিরের দক্ষিণমুখী বহির্দেওয়ালের বিভিন্ন অংশে টেরাকোটা ফলকগুলি যথার্থ অনুভূমিক ও উল্লম্ব মানদণ্ডে খোদিত রয়েছে। সর্বমোট ৭৩টি চতুর্ভুজাকার টেরাকোটার ফলক রয়েছে, যার বিষয়বস্তুর মাধ্যমে এই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক দিকগুলি খুব সুন্দরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফলক যেগুলিতে রয়েছে—গণেশমূর্তি, জয়দূর্গামূর্তি, ফুলেল অলঙ্করণ, নৃত্যরত পুরুষ মূর্তি, বন্দুক শোভিত ব্রিটিশ সৈন্য, বন্দুক শোভিত কোচ সৈন্য ইত্যাদি, যা নিঃসন্দেহে স্থাপত্যপ্রেমী পর্যটকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

কিছু গুরুত্বপূর্ণ টেরাকোটার ফলক যেগুলিতে রয়েছে—গণেশমূর্তি, জয়দূর্গামূর্তি, ফুলেল অলঙ্করণ, নৃত্যরত পুরুষ মূর্তি, বন্দুক শোভিত ব্রিটিশ সৈন্য, বন্দুক শোভিত কোচ সৈন্য ইত্যাদি।

সিদ্ধনাথ শিব টেরাকোটা মন্দিরের টেরাকোটা ফলকগুলির বিষয়বস্তুসমূহ সামগ্রিকভাবে এক বিস্তৃত বৈচিত্র্যকে নির্দেশিত করে যার মধ্যে পুরাকথা ও লোকসংস্কৃতি উল্লেখযোগ্য। অধ্যাপিকা তথা মন্দির বিশেষজ্ঞ অনিতা বাগচীর মতে, এই মন্দিরে টেরাকোটার ফলক নির্মাণের সূত্রপাত যদিও পরীক্ষামলকভাবে হয়েছিল, কিন্তু তার সামগ্রিক রূপায়ণ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।

কোচবিহার দেবত্র ট্রাস্ট বোর্ডের পরিচালনাধীন এই অনুপম স্থাপত্যের নয়নাভিরাম মন্দিরের বাস্তুশাস্ত্র আলাদা আকর্ষণের দাবি রাখে। কোচবিহারের অন্যান্য শৈবমন্দিরের ন্যায় এই দেবায়তনেও শিবরাত্রি পর্বকে উপলক্ষ্য করে এখানে প্রচুর ভক্ত সমাগম ঘটে। একটি ছোটখাট মিলনমেলাও বসে যায়। কোচবিহারের বহুমন্দিরের ন্যায় এখানেও নিত্যপূজার দায়িত্বে রয়েছেন কামরূপী পুরোহিতগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত দেবশর্মা উপাধিধারী পুরোহিত।

এই মন্দির নিয়ে আমার মত হল, সৌধটি অপরাপর গুরুত্বপূর্ণ কোচ স্থাপত্যের (বাণেশ্বর শিব মন্দির, গোসানিমারির কামতেশ্বরী দেবীর মন্দির) পাশাপাশি নবউদ্ভাবিত গঠনশৈলীসমন্বিত কোচস্থাপত্যের অগ্রগমনকে সূচিত করে, যা শৈলীগত দিক থেকে বিমিশ্র শৈলীর অন্তর্ভুক্ত কিন্ত স্থাপত্য পরিলেখে নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধশালী।—চলবে।

ছবি: লেখক।
* মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ (Temples in North Bengal): অর্ক আচার্য (Arka Acharjee), অধ্যাপক ও গবেষক, ইতিহাস বিভাগ, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়, কোচবিহার। লেখকের গবেষণার বিষয়: ‘Origin and Development of Unique and Composite type of Temple Architecture from 16th to 19th Century in the Northern Region of Bengal.’

Skip to content