দেবী সিদ্ধেশ্বরী মন্দির। ছবি: লেখক
বাংলার গুরুত্বপূর্ণ শাক্তকেন্দ্রগুলির মধ্যে কোচবিহার অন্যতম। দেবী সিদ্ধেশ্বরী মন্দির কোচবিহারের এক গুরুত্বপূর্ণ শক্তিপীঠরূপে গণ্য। বাণেশ্বর শিব মন্দিরের কাছেই প্রায় ৩ কিলমিটার দক্ষিণ-পূর্বে সিদ্ধেশ্বরী গ্রামে অবস্থিত। হরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর মতানুযায়ী, এটি উত্তরবঙ্গের একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি আরাধনার পীঠস্থান। কামাক্ষ্যার পরেই দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্ররূপে বিবেচিত। আমরা কালিকাপুরাণে এই দেবী সিদ্ধেশ্বরীর উল্লেখ পাই, যেখানে দেবীকে জল্পেশ্বর মহাদেবের শক্তিরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। দেব ও দেবীর একত্রীকরণ সনাতনধর্মের সুপ্রাচীন পুরুষ-প্রকৃতি ধারণার অস্তিত্ববিষয়ক প্রয়োগকেই সুনিশ্চিতকরণ করে। হরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর বক্তব্য, সৌধটি কোচ মহারাজা প্রাণনারায়ণের উদ্যোগে নির্মীত হয় যেসময় তিনি বাণেশ্বর মন্দির সংস্কার করেছিলেন।
দেবী সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরটি প্রায় ৩২ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট এবং কামতেশ্বরী ও বাণেশ্বর মন্দিরের ন্যায় প্রায় ২.৫ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট এক নাতিউচ্চ প্ল্যাটফর্মের ওপর প্রতিস্থাপিত। স্থাপত্য শব্দকোষ অনুযায়ী যাকে জাগতি বলা হয়। এটি কোচ স্থাপত্যের একমাত্র অষ্টকোণাকৃতি শৈলীর মন্দির। মন্দিরশীর্ষ অর্ধডিম্বাকৃতি গম্বুজশোভিত এবং তার শীর্ষে প্রথাগতভাবে আমলক, কলস ও ত্রিশূল সজ্জিত। অন্যান্য অধিকাংশ কোচ স্থাপত্যের বিপরীত এটিতে বেকি-এর অস্তিত্ব নেই। কারণ মন্দিরটির অষ্টকোণাকৃতি বহির্দেওয়াল গম্বুজশীর্ষটিকে ধরে রাখতে যথেষ্ট সক্ষম।
আরও পড়ুন:
মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-১২: শতাব্দী প্রাচীন কোচবিহারের মদনমোহন ঠাকুর মহারাজাদের কূলদেবতা
কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-১১: আমার নাম, তোমার নাম— তুং নাম, তুং নাম!
সৌধটিতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যবৈশিষ্ট্যের সংমিশ্রণ ঘটেছে, যেমন অষ্টকোণাকৃতি অভিক্ষেপ, বহির্দেওয়ালের প্রতিটি কোণে বৃত্তাকার ডোরিকপিলারের অবস্থান (ভারতে ব্রিটিশ যুগীয় স্থাপত্যে যেগুলি বিবিধ অট্টালিকা ও চার্চে লক্ষিত হতো) ইত্যাদি। মন্দিরটির গর্ভগৃহ বাণেশ্বর মন্দিরসদৃশ প্রবেশদ্বার থেকে প্রায় ৫ ফুট নীচে অবস্থিত এবং অষ্টধাতুনির্মীত চতুর্ভুজা দেবী সিদ্ধেশ্বরী কালিকা গৌরিপট্টসহ এই দেবায়তনের মূল আরাধ্যারূপে পূজিত।
দেবীর উপরের ও নিম্নের দুই হস্ত যথাক্রমে কর্তরী, খড়গ, দর্পণ ও অভয়মুদ্রা শোভিত। যদিও মূল মন্দিরের দক্ষিণপার্শ্বে স্থিত অতি প্রাচীন কামরাঙ্গা বৃক্ষটিকে দেবীর প্রতীক তথা পীঠজ্ঞানেও পুজো করা হয়। আমার মতে ভিতরকুঠি টেরাকোটা শিবমন্দিরের ন্যায় আলোচ্য মন্দিরটিতেও মন্দির বাস্তুতন্ত্রের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য চৈত্য বৃক্ষ (গাছকে পবিত্রজ্ঞানে দেবস্থলরূপে কল্পনা করে উপাসনা) ধারণারও সফল প্রয়োগ ঘটতে দেখা যায়।
আরও পড়ুন:
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২১: ওঠো ওঠো রে! বিফলে প্রভাত বহে যায় যে!
অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-১২: ওই স্মৃতি ভুলতে কি আর পারি…
গাছটির গোড়া সুতো দিয়ে বাঁধা ও তার পাশাপাশি কয়েকটি সিঁদুরলিপ্ত শিলাখন্ড বেষ্টিত, যা প্রকৃতি উপাসনার আদি রূপটিকে সুন্দরভাবে চিত্রায়িত করেছে বলে অনুমিত হয়। পাশাপাশি বর্তমান মন্দিরের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যবৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করলাম, মন্দিরের গর্ভগৃহের প্রবেশপথের ঠিক উপরের দেওয়ালগাত্রে (façade & door jamb) ফুল-লতাপাতার অলঙ্করণ এবং তার সঙ্গে প্রবেশপথের পাশেই দেওয়ালগাত্রে অর্ধবৃত্তাকার খিলান সমন্বিত কৃত্রিম দ্বারের অবস্থান (৫.৫ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট)। যেটি ইসলামিক স্থাপত্যশৈলীগত প্রভাবের এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত বলে আমার মনে হয়েছে।
কোচবিহার দেবত্র ট্রাস্ট বোর্ডের পরিচালনাধীন এই বিখ্যাত অনুপম সৌধটির নয়নাভিরাম মন্দিরের বাস্তুতন্ত্র আলাদা আকর্ষণের দাবি রাখে। এটি জেলার সবথেকে অন্যতম জনপ্রিয় শক্তিমন্দিররূপেও খ্যাত। কোচবিহারের বহুমন্দিরের ন্যায় আলোচ্য দেবায়তনটিতেও নিত্যপুজোর দায়িত্বে রয়েছেন কামরূপী পুরোহিতগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত পুরোহিতগণ। মন্দিরটিতে নিত্যপুজোর পাশাপাশি বিশেষ বিশেষ তিথিতে বিশেষভাবে শক্তি আরাধনার রেওয়াজ রয়েছে যাকে কেন্দ্র করে মন্দিরপ্রাঙ্গনে সেসময় স্থানীয় ভক্তবৃন্দের জোয়ার পরিলক্ষিত হয়।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২০: সুন্দরবনের বসন্ত রোগ নিরাময়কারী দেবী শীতলা
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৭: কবির লেখা, লেখার গল্প
মূল মন্দিরের পাশাপাশি এখানে একটি ভোগমণ্ডপ ও অতিথিমণ্ডপও বর্তমান। আমার ধারণা, সৌধটি অপরাপর গুরুত্বপূর্ণ কোচ স্থাপত্যের (সিদ্ধনাথ ও বাণেশ্বর শিব মন্দির, গোসানিমারির কামতেশ্বরী দেবীর মন্দির) পাশাপাশি নবউদ্ভাবিত গঠনশৈলীসমন্বিত কোচস্থাপত্যের অগ্রগমনকে সূচিত করে, যা শৈলীগত দিক থেকে বিমিশ্র শৈলীর অন্তর্ভুক্ত কিন্ত স্থাপত্য পরিলেখে নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধশালী।
* মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ (Temples in North Bengal): অর্ক আচার্য (Arka Acharjee), অধ্যাপক ও গবেষক, ইতিহাস বিভাগ, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়, কোচবিহার। লেখকের গবেষণার বিষয়: ‘Origin and Development of Unique and Composite type of Temple Architecture from 16th to 19th Century in the Northern Region of Bengal.’